Friday, May 17, 2024
Homeশিক্ষাবিশ্বসভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান আলোচনা করুন।

বিশ্বসভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান আলোচনা করুন।

প্রশ্ন: বিশ্বসভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান আলোচনা করুন। বিষয়: IST-512 : Muslim Contribution to Science and Technology কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)



ভূমিকা

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের দান অপরিসীম। তাদের এ অবদান সম্পর্কে অধ্যাপক হিট্টি বলেছেন, অষ্টম শতকের মাঝামাঝি হতে ত্রয়োদশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত আরবী ভাষাভাষী লোকেরা সমগ্র বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান আলোর দিশারী ছিলেন। তাদের মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞান দর্শন এমনিভাবে পুনর্জীবিত, সংযোজিত ও সম্প্রসারিত হয়েছিল, যার ফলে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর উন্মেষ সম্ভবপর হয়। এ সময়ে মুসলিম পণ্ডিতদের সৃজনশীল মেধা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার উদঘাটন করে। তাদের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করেছিল।

বিশ্বসভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান আলোচনা করুন।

বিজ্ঞানের উৎস হিসেবে ইসলাম

ইসলামের সর্বপ্রথম বাণীই- পাঠ কর, পর্যবেক্ষণ কর, তন্নতন্ন করে দেখ, জ্ঞান অর্জনের জন্য তোমার রবের নাম স্মরণ করা থেকেই বিজ্ঞানের উৎস। পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা জ্ঞান আহরণের কথাই কুরআনের এ বাণীতে বলা হয়েছে। এ বাণী অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হিসেবে আরো বলা যায়, আল্লাহ মানুষকে দুনিয়ার ওপর তার খলীফা হিসেবে কাজ করার জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং এ বিশ্ব প্রকৃতিকে বুঝার ও অনুসন্ধানের জন্য তাকে ক্ষমতা দিয়েছেন। সুতরাং সে যতই প্রকৃতি বা ফিত্রাতকে বুঝতে পারবে, ততই বিশ্ব স্রষ্টার সম্পর্কেও সত্য জ্ঞান লাভ করবে।

কুরআন মানুষকে তার বুদ্ধি বিবেচনা পরিচালনা করে প্রাকৃতিক জগতের প্রতি লক্ষ করতে বলেছেন। কুরআন বৈচিত্র্যময় বা প্রকৃতির গুপ্ত তথ্যাদি আবিষ্কার করে তাকে মানুষের কাজে নিয়োজিত করার প্রেরণা দিয়েছে। প্রাকৃতিক জ্ঞানের এ সাধনা সমস্ত জিনিসের আদিকরণ বা খোদার সন্ধান লাভে তাকে সমর্থ করে। কুরআনে বর্ণিত আছে, যারা আকাশ এবং যমীন সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করে বলে— “ওহে আমাদের প্রভু! তুমি এ সমস্ত বৃথা সৃষ্টি করোনি।” অর্থাৎ, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শক্তিকে আল্লাহ মানুষের প্রয়োজনের জন্যই সৃষ্টি করেছেন, মানুষ জ্ঞান অনুশীলন দ্বারা এ শক্তিগুলোকে জয় করে নিজের কাজে লাগাবে-এই ইঙ্গিতই কুরআনের এ বাণীতে দেয়া হয়েছে।

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে মুসলমানদের জ্ঞান সাধনা শুরু হলেও বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত উমাইয়া যুগে শুরু হয় এবং তা পরিণতি লাভ করে আব্বাসীয় যুগে। স্পেনের মুরগণও বিজ্ঞান চর্চায় বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।

উমাইয়া যুগ

উমাইয়া খলীফাদের মধ্যে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান, আবদুল মালিক, প্রথম ওয়ালিদ, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, ওমর বিন আব্দুল আযীয, হিশাম বিন আব্দুল মালেক প্রমুখ খলীফাগণ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ আরবীতে অনূদিত হয়েছিল। চিকিৎসক মাসার যাওয়াহ্ সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক প্রণালীর চিকিৎসা গ্রন্থ আরবীতে অনুবাদ করেন। আবু হাসেম, খালেদ বিন ইয়াযীদ রসায়ন এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর বই লিখেন।

উল্লেখ্য, আরব জাতি যে জ্যোতির্বিদ্যা, ক্ষেত্রতত্ত্ব, বীজগণিত, নৌচালনা ইত্যাদি বিষয়ের উন্নতি সাধনা করে পরবর্তী যুগে উৎকর্ষ সাধন করতে সক্ষম হয়েছিল, উমাইয়া যুগে তার প্রাথমিক সূচনা পরিদৃষ্ট হয়।

আব্বাসীয় যুগ

আব্বাসীয় যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার এক স্বর্ণযুগ বলে ইসলামের ইতিহাসে পরিচিত। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে এ যুগের মনীষী ও পণ্ডিতদের সৃজনশীল অবদান আধুনিককালেও বিস্ময়কর বলে মনে হয়। এ যুগে চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত শাস্ত্র, রসায়ন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়।

চিকিৎসা শাস্ত্র

চিকিৎসা শাস্ত্রে ও অস্ত্র পাচার চিকিৎসায় এ যুগের মুসলমানদের অবদান অসামান্য। চিকিৎসা শাস্ত্রে ইবনে আব্বাস, ইবনে সিনা, ইবনে দুহর, ইবনে রুশদ, ওমর বিন খলদূন প্রমুখ যুগান্তর সৃষ্টি করেছিলেন। আলী ইবনে আব্বাস একজন প্রসিদ্ধ অস্ত্র চিকিৎসক ছিলেন। প্রখ্যাত দার্শনিক ইবনে সিনা চিকিৎসক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর তাঁর লিখিত ‘কানূন’ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে সর্বত্র সমাদৃত ছিল।

আলী ইবনে আব্বাস বার খণ্ডে চিকিৎসা শাস্ত্রের এক বই লিখেছিলেন। তিনি হিপোক্রেটিস এবং গিলেনের বহু ভুল তথ্য সংশোধন করেছিলেন।

একাদশ শতকের প্রসিদ্ধ অস্ত্র চিকিৎসক ছিলেন আবুল কাশেম খালেদ। অস্ত্রোপচারের দিক দিয়ে তিনি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পথিকৃৎ।

জ্যোতির্বিদ্যা

আব্বাসীয় যুগে জ্যোতির্বিদ্যারও প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। জ্যোতির্বিদদের মধ্যে মাশা আল্লাহ, সেন্দা বিন আলী, ইয়াহিয়া বিন মনসূর, আবূ মাসার প্রমুখ বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আবূ মাসারের লিখিত জিসবায়ে মাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানের উৎস বলে বিবেচিত হতো। আবুল হাসান দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে জ্যোতিঃশাস্ত্রের বিশেষ উন্নতি সাধন করেন। ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত বাতানীর জ্যোতিঃশাস্ত্রীয় তালিকাসমূহ বহু শতাব্দী ধরে ইউরোপের জ্যোতিঃশাস্ত্রের ভিত্তিরূপে গৃহীত হয়েছিল। খলীফা মামুনের প্রতিষ্ঠিত সামাহিয়ার মান-মন্দিরে প্রসিদ্ধ জোতির্বিদ আবূ জাফর মুহাম্মাদ বিন মূসা, খাওয়ারিজমী এ মানমন্দিরে গবেষণা করতেন।

আবুল ওয়াদা ত্রিকোণমিতি এবং জ্যোতিঃশাস্ত্র বিষয়ক গবেষণার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন এবং টলেমীর চান্দ্রিক মতবাদের ভ্রান্তি প্রদর্শন করে স্বাধীন ও নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন।

সুলতান মাহমূদের সময়কার আল বিরুনী একজন প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তাঁর লিখিত আল-কানূন আল মাসুদী অংক ও জ্যোতিঃশাস্ত্রে মৌলিক জ্ঞান ও গবেষণার পরিচয় পাওয়া যায়। কবি ওমর খৈয়ামও জ্যোতির্বিদ্যায় ও অংক শাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন ছিলেন।

গণিত শাস্ত্ৰ

গণিত শাস্ত্রে আরবদের অবদান বিস্ময়কর। আরবগণ পাশ্চাত্য জগতকে সংখ্যা গণনা পদ্ধতি শিক্ষাদান করে। আরব প্রতীক এখনও পৃথিবীর সকল জাতি ব্যবহার করে। তাঁরা দশমিক পদ্ধতিও প্রবর্তন করে। বীজগণিতকেও তারা পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করে। বীজগণিত ও আরবদের অন্যান্য গাণিতিক আবিষ্কারগুলো আরব বণিকগণ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়।

আরবগণ সর্বপ্রথম বীজগণিতকে জ্যামিতিতে ব্যবহার করেন। এরপর সমীকরণ আবিষ্কার করে দ্বিঘাত সমীকরণ ও দ্বিপদ উপপাদ্যের উন্নতি সাধন করেন। তাঁরা গোলক ত্রিকোণমিতি আবিষ্কার করেছিলেন এবং তাঁরাই জ্যামিতিকে অ্যালজাব্রিয়ায় প্রয়োগ করেন।

গণিত শাস্ত্রে মৌলিক অবদানের ক্ষেত্রে আল বাত্তানী, আল ফারাবী, আলবিরুনী, আল খাওয়ারিজমী, আবুল কাশেম মানশামা, ওমর খৈয়াম, নাসিরউদ্দিন তুসী, আর কায়বী প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

রসায়ন শাস্ত্র

আলকেমি হতে রসায়ন শাস্ত্রের জন্ম হয়েছে। এ শাস্ত্রের উন্নতিতে মুসলমানদের অবদান অপরিসীম। তাঁরাই প্রথম পাতন, পরিস্রবণ ও স্বচ্ছকরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

জাবির ইবনে হাইয়ানকে আধুনিক রসায়নের জনক বলা হয়। তিনি রসায়ন শাস্ত্রের ওপর প্রায় ৫০০ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি রসায়ন শাস্ত্রের দুটি মূলসূত্র ভস্মীকরণ ও লঘুকরণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আলোচনা করেন। জাবের বালীকরণ, ঊর্ধ্বপাতন, দ্রবীকরণ, স্ফটিককরণ প্রভৃতি পদ্ধতির উন্নতি সাধন করেন। তাছাড়া যবক্ষার এসিড, গন্ধক, দ্রাবক, জল-দ্রাবক ও অন্যান্য গবেষণা পদ্ধতিতে পরিণত করেন। এ যুগের অপর একজন বিখ্যাত রসায়নবিদ ছিলেন আল রাযি। তিনি যবক্ষার এসিডের পুনরাবিষ্কার করেন । বিখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনাও রসায়ন শাস্ত্রকে প্রণালীবদ্ধ করতে সাহায্য করেন।

উদ্ভিদ বিজ্ঞান

আব্বাসীয় যুগে উদ্ভিদ বিদ্যারও বহু উন্নতি হয়। মুসলমানগণ গ্রীকদের চেয়ে প্রায় দু’হাজার রকম গাছের শ্রেণীকরণ করেছিলেন। উদ্ভিদবিদদের মধ্যে ইবনে বাতরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লতাপাতা সম্পর্কিত তাঁর প্রবন্ধাদি আজও উদ্ভিদবিদদের নিকট মূল্যবান বলে বিবেচিত। তাছাড়া ভূতত্ত্ব ও প্রাণীতত্ত্বেরও তাঁরা প্রভূত উন্নতি সাধন করেন।

মুসলিম স্পেনে বিজ্ঞান চর্চা

স্পেনে মুসলিম খেলাফতের সময় মুসলমানগণ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগ বিশেষ করে জ্যোতিষশাস্ত্র ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে আশানুরূপ উন্নতি সাধন করেন। স্পেনের আন্দালুসিয়ায় জ্যোতির্বিদ্যার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। অধিকাংশ স্পেনের জ্যোতির্বিদ বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তীকালের ঘটনাবলী বহুলাংশে নাক্ষত্রিক প্রভাবে ঘটে থাকে। এ সময়ের জ্যোতির্বিদগণের মধ্যে প্রখ্যাত ছিলেন কর্ডোভার আল মাজরিত, টলেডোর আল-জারকালী এবং সেভিলের ইবনে আফলাহ। আবদুল ইবনে আহম্মেদ ছিলেন স্পেনের তথা মুসলিম জাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভিদ তত্ত্ববিদ।

উপসংহার

ইসলামে মহানবীর নেতৃত্বে মুসলমানগণ সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্যে তথা গোটা বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। জ্ঞান চর্চার দিক দিয়ে তাঁরা মধ্যযুগে সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রকৃত পক্ষে সুদীর্ঘ নয়শত বছর পর্যন্ত মুসলমান জাতিই জ্ঞানের আলোকবর্তিকা বহন করে দিক দিগন্তে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে দিয়েছিল। তবে দুর্ভাগ্যবশতঃ অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপের ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলে তারা অবশেষে নিজেরাই অন্ধকারের অতল তলে তলিয়ে গেল। শতাব্দীর ব্যবধানেও তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি।


এই উত্তরটি পিডিএফ ডাউনলোড করুন

সম্ভাব্য প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ (এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ)

• IST-507 : Study of Al-Hadith (Al-Mishkat Al-Masabih: Al-Iman, AlILM and Al-Salat (Selected Hadith) • IST-508 : Principles and History of Hadith literature • IST-509 : Muslim Personal Law and Law of Inheritance in Islam • IST-510 : Banking and Insurance in Islam • IST-511 : Study of Religions (Islam, Buddhism, Hinduism, Judaism, Christianity) • IST-512 : Muslim Contribution to science and technology

x

tiltony.com
tiltony.comhttp://www.tiltony.com
তিলটনি.কম একটি বাংলা ব্লগ সাইট। সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও পূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ কনটেন্ট প্রকাশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ওয়েবসাইটটি।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ‣ শিক্ষা ‣ স্বাস্থ্য ‣ জীবনযাপন ‣ পাঁচমিশালি ‣ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংবাদ পেতে ভিজিট করুন।
RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments