ঈদের পর দিন ঈদ

eider golpo, eider choto golpo, eider golpo choto baccader, ঈদের খুশির ছোট গল্প, ঈদের ছোট গল্প এলো খুশির ঈদ, ramadan, eid, romjaner oi rojar sheshe elo khushir eid, ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে, রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, eid song, o mon ramjaner oi rojer seshe elo khusir eid, romjan, শুভেচ্ছা জানানোর, ঈদ ছন্দ, ঈদের সেরা ছন্দ গুলো, eid sms,bangla eid, new song, ঈদের মজার গল্প, ঈদের মজার ছন্দ

0
1201
ঈদের পর দিন ঈদ
বাংলা গল্প ঈদের পর দিন ঈদ

এক. ঈদের পর দিন ঈদ

মাথা চুলকাতে চুলকাতে রানা বলল, ওকে শায়েস্তা করার একটা বিশেষ বুদ্ধি আমার মাথায় এসেছে।

ফয়সাল জিজ্ঞেস করল, কি বুদ্ধি?

উত্তরে রানা ব্যাখ্যা করল, কমন রুমের যে ক্যারাম বোর্ডটি আছে, সেখানে টিফিনের সময় গিয়ে আবিদের নামের সাথে প্লাস দিয়ে সুইটির নাম লিখে রাখব। এটি দেখলে ও ভয় পেয়ে যাবে। আর স্যারেরা দেখলে ওর ‘ভদ্র ছেলে’ খেতাব ছুটে যাবে।

রানার কথায় ফয়সালের মন্তব্য, বুদ্ধিটা মনে হচ্ছে কাজে লাগবে।

জহির সাবধান করে দিয়ে বলল, কাজটা টিফিন পিরিয়ডে করলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এটা করতে হবে অন্য সময়।  

ফয়সাল রানাকে নির্দেশনা দিয়ে বলল, রানা তোর বাড়ি তো কাছে। তুই কাল সকালে সাড়ে আটটায় স্কুলে চলে আসবি। এসে কমন রুমে ঢুকে এই কাজটা সেড়ে ফেলবি।

ওকে-ডান বলে তিনজনই যারযার মতো চলে গেল।

রানা, জহির ও ফয়সাল এই তিনজন বালিয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র। এলাকায় সবধরণের খেলা আয়োজনের পাশাপাশি সুচারুরূপে সেই খেলায় কোন একটা গন্ডগোল বাধানোতে রয়েছে তাদের বিশেষ দক্ষতা। ক্লাসে তাদের আচরণটা এরকম যেমন ইউনিভার্সিটির প্রথমবর্ষের জুনিয়রদের সাথে তৃতীয় বা চতুর্থবর্ষের সিনিয়ররা যেভাবে আচরণ করে ঠিক সেইরকম।তিনজনের বাড়িই স্কুল এবং বাজারের কাছেই। অর্থাৎ স্কুলের কাছেই বাজার। কিছুদিন আগে তাদের অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে এবং দুইদিন হলো ক্লাস শুরু হয়েছে। তিনজনের প্রত্যেকেই একটি বিষয়ে অকৃতকার্য থাকলেও প্রধান শিক্ষকের বিশেষ নির্দেশে তাদেরকে অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করে দেয়া হয়েছে।

বার্ষিক পরীক্ষায় আবিদের পাশে সিট পড়েছিল ফয়সালের, তারপর রানা এবং জহির। কিন্তু পরীক্ষার হলে ইশারায় এত ডাকাডাকি করেও তেমন কোন সদুত্তর পায়নি ফয়সাল। একমাত্র আবিদের অসহযোগিতার কারণে এক বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদেরকে নবম শ্রেণীতে উঠতে হয়েছে। এতবড় অপমানের চশমা তাদের পড়তে হয়েছে শুধুমাত্র আবিদের কারণে। এজন্যই আবিদের উপর যত ক্ষোভ। অন্যের কারণে তাদের মাথায় ‘অনুত্তীর্ণ’ নামক কলঙ্কের বোঝা, কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না! তাই আবিদকে শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদের এই ছোট্ট প্রয়াস।

পার্থিব রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ওই আবিদ, তুই চশমা পরিস না কেন?

আবিদের প্রশ্ন, মানে?

আবার রাগের সাথে একটু ব্যঙ্গ মিশিয়ে পার্থিব বলল, মানে বুঝ না, না! তুই ভাল ছাত্র, স্কুলের সবাই তোমাকে ‘ভদ্র ছেলে’ বলে জানে। সিনেমায় দেখোনি এরকম ছেলেরা চোখে চশমা পরে। একটু ভাব নিয়ে থাকে। তুমি সেটা পার না!!

অসহায় হয়ে পার্থিবের আবারও প্রশ্ন, আরে কি হয়েছে বল?

পার্থিবের উত্তর, চোখে একটা চশমা লাগিয়ে কমন রুমে যা। গিয়ে দেখ ক্যারাম বোর্ডে কি লেখা আছে।

টিফিন পিরিয়ডে আবিদকে কথাগুলো বলছিল পার্থিব। পার্থিব আর সজিব আবিদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তিনজনের বন্ধুত্বটা ইতিমধ্যে স্কুল-ক্লাস-খেলাধুলার গন্ডিটা পেরিয়ে তাদের পরিবার এবং এলাকাতেও স্বীকৃতি পেয়েছে।তিনজনের বন্ধুত্বের দৃঢ় এই রাসায়নিক বন্ধনে একটি প্রভাবক রয়েছে। সেটি হলো আবিদের বড় ভাই পার্থিবের বড় ভাই ক্লাসমেট ছিল। আর সজিবের চাচাত ভাই ও পার্থিবের বড় ভাই খুব ভাল বন্ধু। দুইজনের পরিবারের মধ্যে খুব ভাল সম্পর্ক। পার্থিব খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছে ঘটনাটি অন্য কেউ ঘটিয়েছে। আবিদ এই কাজ কখনোই করতে পারে না, এটা পার্থিবের বিশ্বাস। আর এই বিষয়গুলোর প্রতি আবিদের তেমন কোন খেয়ালই নেই। তাই আবিদের উপর একটু রেগেই এভাবে কথা বলছে পার্থিব। কথোপকথনের এ পর্যায়ে দুজনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে ফয়সাল। দুজনের মধ্যে কোন কথা হচ্ছিল কিনা বা কি কথা হচ্ছে এসব বিষয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই, অত্যন্ত গম্ভীরভাবে সে কথা বলা শুরু করে দিল। ফয়সালকে এরকম গম্ভীর ভাব নিয়ে কথা বলতে এর আগে কেউ দেখেনি। পুরোপুরি বিপরীত শব্দের মতো। এটা যেন অন্য কেউ, ফয়সাল না।

ফয়সাল হুরমুড় করে বলে যাচ্ছে, তুই সুইটিকে ভালোবাসিস সেটা ক্যারাম বোর্ডে লিখার কি দরকার। সুইটি তো আমাদের বাড়ি সামনে দিয়েই স্কুলে আসে। আমাকে বললেই, বলে দিতাম। চিঠি লিখে দিলে সেটাও দিয়ে দিতে পারতাম।

ফয়সালের কথা শেষ হতে না হতেই রানা এসে উপস্থিত। আরো দু’একজন এদিকেই আসছে। কোথাও কোন দুর্ঘটনা, আগুন লাগা বা রাজনৈতিক কোন ঘটনা ঘটলে টিভি-পত্রিকার সাংবাদিকরা কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঠিক তেমনি সবাই যেন কোত্থেকে এ খবর পেয়ে যাচ্ছে। আর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এদিকে আবিদের চোখ তো ছানাবড়া। সে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি ঘটনাটি কি। এত কথার ভিড়ে বারবার কথা বলতে চাইলেও কেউ তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। বলতে গিয়েও থেমে যেতে হচ্ছে। কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এরকমই হয়ে থাকে। কৌশলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কথা বলার কোন সুযোগই দেয়া হয় না। এখানে তারও স্বীকারোক্তি দেয়ার একটা সুযোগ থাকা উচিত। কোনঠাসা করার জন্যই আবিদকে কথা বলার কোন সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।

প্রতিদিন আমরা কি খাচ্ছি? একটু হলেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন

আরো চার-পাঁচজন চলে আসল। একেকজন একেক কথা বলতে লাগল। সবশেষে খুবই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে আবিদকে কোন কিছু না বুঝেই বিকেলে কৃষ্ণের দোকানে সবাইকে পুরি আর জিলাপি খাওয়ানোর ঘোষণা দিয়ে আপাত রেহাই পেতে হলো। অর্থাৎ অলিখিত একটা আপোষনামা করতে হলো। সেটা হলো- এখানে যারা এসেছে তাদের সবাইকে বিকেলে বাজারে কৃষ্ণের দোকানে পুরি আর জিলাপি খাওয়ালে বিষয়টি যারা যারা জেনেছে কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে। কেউ কাউকে জানাবে না। আর বোর্ডের লেখাটি ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা হবে।

দুই. ঈদের পর দিন ঈদ

বাজার থেকে ঠিক পশ্চিম দিকে এক কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই আলীয়ারপুর গ্রাম। আবিদদেরবাড়ি। প্রায় ছয়শত লোকের বসবাস এই গ্রামটিতে। শতকরা পনের ভাগ শিক্ষার হার বিশিষ্ট গ্রামটির বাসিন্দারা খুবই অলস প্রকৃতির। ভবিষ্যত নিয়ে তাদের ভাবনা খুবই স্বল্প দৈর্ঘে্যর। দুইটি মসজিদ এবং একটি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে গ্রামটিতে।

আবিদদের বাড়ি থেকে সোজা উত্তর দিকে দশ মিনিট হাটলে তিয়ানী খাল। বাঁশের সাঁকো দিয়ে খালটি পার হয়ে আবার পশ্চিম দিকে একটু এগিয়ে গেলেই বাড়ির সামনে বড় মসজিদ। মসজিদ ওয়ালা বাড়িটিই পার্থিবদের বাড়ি। এই এলাকার সবচেয়ে পুরাতন মসজিদ এটি। পুরান মসজিদ বললে এলাকার যে কেউই পার্থিবদের বাড়িটি দেখিয়ে দিবে।সাঁকোটি পাড়ি দিয়ে লোকজনকে বাজারে-শহরে স্কুল-কলেজে যেতে হয়। দুটি বাঁশ এক্স আকৃতিতে কাঁদার মধ্যে পুতে তার উপর একটি লিকলিকে বাঁশ বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে সাঁকোটি। একপাশে হাতে ধরে হাটার জন্য আরেকটি বাঁশ বেধে দেয়া হয়েছে। স্কুল-কলেজগামী মেয়েরা এবং গ্রামের মহিলারা যখন সাঁকোটি পাড় হন, তখন মনে হয় এ অনুশীলটা তাদেরকে আখিরাতে পুলসিরাত পাড় হতে খুবই সাহায্য করবে। এতোকিছুর পরও গ্রামের মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে এখানে একটি ব্রিজ হবে। শহর থেকে সরকারি লোকজন এসে মাপজোপ দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গেছে।

আর বাজার থেকে পূর্ব উত্তর দিকে বলরামপুর গ্রামে সজিবদের বাড়ি। বাজারকে প্রথম বিন্দু ধরে সোজা পূর্ব দিকে একটা লম্ব টেনে তার সাথে উত্তর দিকে ৩৫ ডিগ্রী কোণ করে রেখা টানলে সেই রেখা বরাবর ঠিক এক কিলোমিটার দূরে সজিবদের বাড়ি। এই এক কিলোমিটার পথ যেতে হয় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। বাজার থেকে পূর্ব দিকে পাকা রাস্তা ধরে আধা কিলোমিটার গিয়ে বায়ে মোড় নিয়ে আকাবাঁকা মাটির রাস্তা ধরে উত্তর পূর্ব দিকে দুই কিলোমিটার যেতে হবে। তারপর আবার একটি ব্রিজ পার হয়ে আরেকটু ছোট রাস্তা ধরে পৌছাতে হয় বাড়ি। মাটির রাস্তাটি বর্ষা মৌসুম শেষ হবার পর থেকে কিছু দিন পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় ভেঙ্গে গিয়ে সদ্য শেষ হওয়া বর্ষার অস্তিত্বটা ধরে রাখে। তারপর শীত মৌসুমে প্রচন্ড রোদ শুরু হলে পুরো রাস্তাটি হয়ে যায় ধুলোময়। বর্ষার কল্যাণে সৃষ্ট হওয়ার ভাঙ্গা-গর্তগুলো মেরামত করে দিনে দু’চারটা রিক্সাও চলাচল করে তখন। আবার বর্ষার প্রথমদিকে রাস্তাটি কাঁদা আর খানাখন্দকে ভয়ানক রূপ ধারণ করে। জুতা হাতে নিয়ে হেটে যেতে শীত মৌসুমের চেয়ে দ্বিগুণ সময় ব্যয় করতে হয়। আর পুরো বর্ষাতে রাস্তাটি পানিতে ডুবে গেলে সেই ৩৫ ডিগ্রী কোণে সরলরেখা বরাবর নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতে হয় গ্রামের মানুষজনদের।

স্কুলের ঠিক উল্টো দিকে বিএডিসির কৃষি ফার্ম। ফার্মের নারকেল তলায় প্রতি শুক্রবার বিকালে তিনবন্ধু একসাথে হয়। যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে এখানে আসতে তিনজনেরই খুব কষ্ট স্বীকার করতে হয়। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত আড্ডা দেয় তারা। প্রায়ই আড্ডায় শামিল হয় তাপস। আজ সে অনুপস্থিত। চাল-চলনগত বৈশিষ্ট্যে রানা-জহির-ফয়সালকেও টপকে যায় তাপস। এই আড্ডায় তাপসের যুক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো তার বাসা ফার্মের সাথেই। তার মতে, ফার্মের কোন একটি গাছ থেকে ডাব চুরি করে না খেলে সে গাছে নাকি পরের বছর ডাবই ধরে না। তাই গাছে ডাব ধরানোর মহান দায়িত্ব সে নিজের কাধেই নিয়েছে। পাশাপাশি সেই ডাব দিয়ে আবিদদের আপ্যায়নের মহৎ কাজটিও। তাপসের সবচাইতে বেশি ভাল সম্পর্ক পার্থিবের সাথে। যেখানে যত ভাল-খারাপ কাজ এবং মনের যত কথা সবই একমাত্র সে পার্থিবের কাছে বলে। ওই দিনের আবিদের ঘটনাটির বিস্তারিত পার্থিবকে গতকাল তাপসই জানিয়েছে। পার্থিব আজকের আড্ডায় পুরো ঘটনাটি তুলে ধরলো। কারা, কিভাবে এবং কেন ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আবিদের কথা- যা হবার হয়েছে, এখন এসব বাদ দে।

আড্ডার শেষ পর্যায়ে এসে আবিদ হঠাৎ করে প্রশ্ন করে বসলো, সুইটি অনেক পড়ে, তাই না। না হলে এত ভালো মার্কস তুলে কিভাবে?

পার্থিব বললো, এটা তুই সজিব কে জিজ্ঞেস কর।

নির্লিপ্তভাবে সজিবের উত্তর, খুব মুখস্ত করতে পারে।

আবিদ আর সুইটির ঘটনা নিয়ে এই প্রথমবার মুখ ফুটল সজিবের। সজিব এমনিতে খুবই সাবলীলভাবে অল্প কথায় উত্তর দিয়ে থাকে। কোন কথা শেষ করা মাত্রই তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় সে। যেমন- হ্যা- না, এটা হবে অথবা হবে না এই ধরনের। কোন ঘটনায় অনেক কথা বলে, ভাবনা চিন্তা করে সবাই যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, দেখা যায় সজিব প্রথমেই সে কথাটা বলেছিল।

সুইটি সম্বন্ধে সজিব সবচেয়ে বেশি ভালো জানে। ওদের দুই পরিবারের মধ্যে খুব ভাল সম্পর্ক। উৎসব আয়োজন ছাড়াও দুই পরিবারের মধ্যে আসা-যাওয়া হরহামেশাই ঘটে। সজিবের এবং সুইটির বাবার একই সাথে চাকরি হয়েছে এবং ট্রেনিংও করেছে একসাথে। পাশাপাশি গ্রামের বাসিন্দা তারা। চাকরি হওয়ার পর থেকে তাদের বন্ধুত্ব খুব ঘনিষ্ট। সুইটির বাবা বালিয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং সজিবের বাবা পাশের গ্রামের বড়ওয়াজান উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। ছোট বেলা থেকেই সুইটি আর সজিব একসাথে বড় হয়েছে।

বই পড়তেও প্রেসক্রিপশন লাগে???

স্কুলে বিতর্ক, আবৃত্তি, গান, অভিনয় এই সবগুলোই তার পদচারণা। খুবই মিশুক এবং চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে সুইটি। তবে ক্লাসের ছেলে মেয়েদের সাথে তার সখ্যতা তেমন ভাল নয়। এর মূল কারণ তিনটি। প্রথমত, সুইটির বাবা এই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। খুবই রাগী। তাই ক্লাসের ছেলে মেয়েরা ভয়ে সুইটির সাথে কথাবার্তা কমই বলে থাকে। দ্বিতীয়ত, ক্লাসের বাইরে সুইটির বেশিরভাগ সময় কাটে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে স্কুলের সিনিয়র এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে। তৃতীয়ত, পড়াশোনায় ভাল হওয়ার কারণে অনেকেই সুইটিকে হিংসার চোখে দেখে।

এভাবে ক্লাস, খেলাধুলা, কোচিং, নারিকেল তলায় আড্ডা, আবৃত্তি, পরীক্ষা, গান ইত্যাদি সবমিলিয়ে সময় গড়িয়ে যেতে যেতে নবম থেকে দশম শ্রেণী ও এসএসসি পরীক্ষা চলে আসল। এরই মধ্যে আবিদ নিজেই খেয়াল করে দেখল, প্রায়ই অবচেতন মনে সে সুইটি ভাবছে। সুইটি যেন তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, এমন সময়ে কি বলবে সে ভেবে উঠতে পারছে না। খুবই ইচ্ছা হয় সুইটির সাথে দু’একটি কথা বলে। শামুকের পানির মত স্বচ্ছ দুটি চোখ যেন সবসময় তার চোখের সামনেই থাকে। কিছুতেই সরানো যায় না। হৃদয়ে নাড়া দিয়ে উঠে। যা আগে কখনও হয়নি। কিন্তু কি করবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

তিন. ঈদের পর দিন ঈদ

এসএসসি পরীক্ষা শেষ। আবিদরা একেকজন একেক কলেজে ভর্তি হয়েছে। শুরু হয়ে গেল একমুখী যুদ্ধ। ভাল রেজাল্ট করে ভাল সাবজেক্টে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রাণান্তর চেষ্টা। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রভাবক চালনা করে যৌগের পরমাণু বন্ধনকে ছিন্ন করে উপাদানগুলোকে আলাদা করা হয়। ঠিক সেভাবে বাস্তবতা এবং পড়াশুনা নামক দুটি প্রভাবকের প্রভাবে আবিদদের বন্ধুত্বের বন্ধনগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে যেতে থাকলো।কলেজে এসে পড়াশুনার চাপ বেড়ে গেল। ক্লাস, কোচিং, প্রাইভেট এগুলো ভিন্ন সময়ে হওয়ায় তাদের যোগাযোগটা একেবারেই কমে গেল। তাছাড়া অনেকেই আবার জেলার বাইরে বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হয়েছে।

আগামীকাল ঈদ। ঠিক আট বছর পর ঈদের ছুটিতে এসে আজ সবাই একত্রিত হয়েছে শহরের ‘শান্তি ফুড কর্ণার’ এ। সেই নারিকেল তলা হয়তো এখনও তাকিয়ে আছে এদের দিকে। কিন্তু আবিদরা তো এখন আর সেই বালিয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র নয়। সবাই পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। মন-মানসিকতার পাশাপাশি স্ট্যাটাসেরও পরিবর্তন হয়েছে।দু’একজন ইতিমধ্যে বিয়ের অধ্যায়টা শেষ করে সংসারী হয়েছে। আর বালিয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীও খালি নেই। সেখানে পরের প্রজন্মের আবিদরা এসেছে। তাদের জন্য হলেও নারিকেল তলা ছেড়ে দিতে হবে।সজিব দেশে ফিরেছে ছয় বছর পর। এইচএসসি পাশ করে চলে গিয়েছিল ইউকে। সেখান থেকে পড়ালেখা শেষ করে গত সপ্তাহে দেশে ফিরেছে। বিশেষ করে তার উদ্যোগেই আজকের এই মহামিলন।

ইফতার পার্টির জন্য তিনটি টেবিল এবং বারটি চেয়ারসহ কফিশপ সাইজের কর্ণারটি ভাড়া নেয়া হয়েছে। ইফতারের পরেও আড্ডা দেয়ার জন্য রাত পর্যন্ত রিজার্ভ করে নেয়া হয়েছে। ইফতার শেষ করে সবাই এসে বসেছে। এসি ছেড়ে বড় লাইটগুলো নিভিয়ে শুধু রঙিন ডিম লাইটগুলো জ্বালানো হয়েছে। আবিদের মনে হচ্ছে বড় লাইটগুলো নিভিয়ে দেয়ায় আধুনিক শহরের চাকচিক্যময় যান্ত্রিকতাকে অন্য পাশে রেখেযেন নারিকেল তলায়ই বসে আছে। আর ডিম লাইটগুলো জ্বালিয়ে তারা যেন আবার সেই রঙিন শৈশবেই ফিরে গেছে। ইফতারের আগে যে উদ্দীপনা-চাঞ্চল্যতা সবার মধ্যে ছিল ইফতারের পর সেটা কেটে গিয়েছে। ঝড়ো বৃষ্টির পর নদী যেমন শান্ত হয়ে যায়, রুমটি এখন সেরকমই শান্ত।

শান্ত নদীকে আবারও তার গতিতে ফিরিয়ে নিতে আনোয়ার তার চিরচেনা হাস্যরসিকতা ভরে কথা বলা শুরু করল। আনোয়ার সব বিষয়কে সমান ভাবে দেখে। সিরিয়াস কোন বিষয় আর মজার কোন বিষয় যাই হোক না কেন, সে প্রথমে রসিকতার সাথেই সে বিষয়ের মুখোমুখি হবে। এটা তার অভ্যাস। আনোয়ার বলছে, বন্ধুগণ, আজ আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি শান্তি ফুড কর্ণারে। আমরা সবাই শান্তি চাই। আমরা কি  চাই, শান্তি চাই। যার মনের যত দুঃখ-ব্যাথা, অব্যক্ত মনের গোপন কথা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সবাই শান্তির পরশ গ্রহণ করবো। সজিব কথা বলতে চাচ্ছে এমন আঁচ করতে পেরে আনোয়ারের কথা শেষ না করেই মাঝ পথে ইস্তফা দিল।

সজিব শুরু বলা করল, আনোয়ার কথাটি রসিকতা করে বললে আমি সিরিয়াস ভাবেই বলছি। আজ আমি আমার কিছু অব্যক্ত কথা এখানে ফেলে রেখে যেতে চাই। কথাগুলো আজ না বললে হয়তো আর কোনদিন কারো সাথে বলা সুযোগও হবে না। রুমের শান্ত পরিবেশটি ক্রমেই গাঢ় স্তব্দতায় পরিণত হতে থাকে।

সজিব বলে যাচ্ছে, হাই স্কুল জীবনের প্রথম দিন থেকেই আবিদের সাথে আমার বন্ধুত্ব। তারপর থেকে সম্পর্কটি এমন অবস্থানে গিয়েছে যে একে বন্ধুত্ব বললে ‘বন্ধু’ সম্পর্কটিকেও একটু খাট করা হবে। সুইটি আর আমি একসাথেই বড় হয়েছি। জ্ঞান হবার আগে না বুঝে অনেক বলেছি- সুইটি আমি তোমাকে ভালবাসি। তখন বিষয়টি নিয়ে আমাদের অভিভাবক মহলে অনেক হাসাহাসি খুনসুটি হয়েছে। তারা বলেছেন, “এতটুকু বাচ্চা ঠিকমত কথাই বলতে পারে না। আর বলে কিনা ভালবাসি। আধুনিক যুগের ছেলেমেয়ে এরা।” কিন্তু যখন বুঝতে শিখেছি এবং আমার মনকে প্রশ্ন করে উত্তরও পেয়েছি তখন আর একবারও তাকে জানানো হয়নি তোমাকে ভালবাসি। একথাটি আজো হয়তো সুইটি জানে না, এমনকি যতদিন বেচে থাকবে। কিন্তু ক্লাস নাইনে ক্যারাম বোর্ডে সুইটি-আবিদের ঘটনাটির পর থেকেই আবিদের মনে সুইটির প্রতি ভাললাগা তৈরি হতে থাকে। তখন থেকেই আমি সুইটিকে আমার মন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকি।

এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করার পর জানতে পারি- চাকরি হবার পর একসাথে ট্রেনিং করছিলেন আমার বাবা আর সুইটির বাবা। এসময় সুইটির জন্ম হয়। খবর পেয়ে ওই সময় সুইটির বাবা আমার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন আমার সাথে সুইটির বিয়ে দিবেন। এক কথা জানার পর আমি অনেকটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যায়। আমি দেশে থাকলে সুইটিকে না পাওয়া কষ্টটা আবিদকে বহন করতে হবে। তাই আমার পরিবারের এমনকি নিজের মনের অসম্মতিতে আমি বিদেশ চলে যাই। আমি দেশে থাকলে আবিদ সুইটিকে পাবে না। আর আমি সেটা হতে দিতে পারি না…

কথা থেমে গেছে, সাথে জীবনও। কথাতেই তো জীবন, কথা থেমে গেলে জীবন কি আর চলতে থাকে?

বলা হয়নি আবিদেরও। না সুইটি, না সজিবকে। অন্তর্যামী ছাড়া কাউকেই বলা হয়নি। স্কুলের ওই ঘটনার পর থেকেই সুইটির প্রতি ভাললাগা তৈরি হতে থাকে। বিন্দু বিন্দু করে সেটা পরিণত হয় ভালবাসায়। একটা পা এগিয়ে দুপা পিছিয়ে এমন করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল মনের কথাটি সুইটিকে জানাবে। কিন্তু তার আগে তো সুইটি কাউকে পছন্দ করে কিনা সেটাও জানা দরকার। সজিব তখন ইউকে থাকায় পার্থিবকে জিজ্ঞেস করল সুইটি কাউকে পছন্দ করে কিনা। পার্থিব জানাল সুইটি কাউকে পছন্দ করে না। কিন্তু সজিব ছোট বেলা থেকেই সুইটিকে ভালোবাসে। আবিদ চিন্তা করল, তার পাঁচ বছরের ভালবাসাটা এখনো মনের মধ্যেই রয়ে গেছে। সেটা সহজেই নিয়ন্ত্রনে আনা যাবে। কিন্তু যে পচিশটি বছর ধরে ভালোবাসে। তার ভালোবাসা রক্তের প্রতিটি কণায় কণায়, শরীরের প্রত্যেকটি শিরায় শিরায় ছড়িয়ে গেছে। সেটা কি কখনো নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব? তাই বলা হয়নি আবিদের।

আগামীকাল ঈদ। ঈদের পর দিন ঈদ এসেছে সুইটি-জিসানের জীবনে। জিসান সিঙ্গাপুর প্রবাসী। একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে। এক বছর আগে সুইটির সাথে ফেসবুকে তার পরিচয়। তারপর প্রণয়। সুইটি পছন্দের কথা পরিবারকে জানায়। দুই পরিবারের সম্মতিতে জমকালো আয়োজনে বিয়ে। বর সংক্ষিপ্ত ছুটিতে দেশে ফিরেছে। তাই ঈদের পরদিনই বিয়ে।

x