পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়সীমা, নামাযের মুস্তাহাব ও নিষিদ্ধ সময় আলোচনা করুন।
ভূমিকা
ইসলামী শরীয়াতে প্রতিদিন মোট ৫ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়েছে। সাথে সাথে এগুলো আদায়ের পাঁচটি সময়ও নির্ধারিত রয়েছে যাতে করে বান্দা এ সময়ানুবর্তিতার মাধ্যমে তার প্রতিপালকের সাথে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে। একই ওয়াক্তে পাঁচটি নামায আদায় করা ফরয করা হলে বান্দার মাঝে ক্লান্তি ও বিরক্তিবোধ উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তাই পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পাঁচটি সালাত আদায় করা ফরয করা হয়েছে- যেন বান্দার মাঝে অবসন্নতা ও বিরক্তিবোধ না আসে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তায়ালা অধিক প্রজ্ঞাবান।
No posts
পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময়সমূহ
ফজর: ফজর নামাজের সময় শুরু হয় সুবহি সাদিক হওয়ার সাথে সাথে এবং সূর্য উদয়ের পূর্ব পর্যন্ত এর সময় থাকে। রাতের শেষে আকাশের পূর্ব দিগন্তে লম্বা আকৃতির যে আলোর রেখা দেখা যায় তাকেই বলে সুবহে সাদিক।
যোহর: দুপুরের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লেই যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়। ছায়া আসলি বাদে কোনো বস্তুর ছায়া দ্বিগুন হওয়া পর্যন্ত এর সময় থাকে। কোনো বস্তুর ঠিক দুপুরের সময় যে ক্ষুদ্র ছায়া থাকে তাকেই বলে ছায়া আসলি।
আসর: যোহরের সময় শেষ হলেই আসরের সময় শুরু হয় এবং সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। তবে সূর্যের রং হলুদ হওয়ার আগেই আসর সালাত আদায় করা উচিত।
মাগরিব: সূর্যাস্তের পর থেকে মাগরিবের সময় শুরু হয় এবং পশ্চিম আকাশে যতক্ষন লালিমা বিদ্যমান থাকে ততক্ষণ সময় থাকে।
সূর্যোদয় শুরু হওয়ার সময় থেকে পুরোপুরি সূর্যোদয় সম্পূর্ণ হওয়ার সময় পর্যন্ত নামায পড়া নিষিদ্ধ।
যখন সূর্য সরাসরি মাথার উপর থাকে, তখন নামায পড়া নিষিদ্ধ; এবং
সূর্যস্ত শুরু হওয়ার সময় থেকে সূর্যটি পুরোপুরি অস্ত যাওয়া বা ডুবে যাওয়ার সময় পর্যন্ত নামায পড়া নিষিদ্ধ।
উপসংহার
আল্লাহ তা‘আলা নামাযকে সময়ের সাথে খাস করে দিয়েছেন। প্রত্যেক নামাযের নির্ধারিত সময় রয়েছে। প্রত্যেক নামাযকে তার নির্ধারিত সময়ে আদায় করা ফরয। গ্রহণযোগ্য কোনো ওযর ছাড়া এক নামায অন্য নামাযের সময়ে আদায় করলে কবীরা গুনাহ হবে। হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মে‘রাজ থেকে এসে নামাযের প্রাকটিক্যাল ট্রেনিং, নামাজের ওয়াক্ত এসব কিছু সাহাবাদের রা. যুহরের সময় জানালেন। ফজরের সময় যেহেতু সকলকে একত্র করা কঠিন ছিল, তাই এসব কিছু যুহর থেকে শুরু করলেন। এজন্য হাদীসের কিতাবেও নামাযের ওয়াক্তের বর্ণনা যুহর থেকে শুরু করা হয়েছে।
নাজাসাত কাকে বলে? তা কত প্রকার কি কি? বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করুন।
ভুমিকা
পবিত্রতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। বিশেষ কোন ইবাদতের ক্ষেত্রে পবিত্রতা অর্জন করা পূর্বশর্ত ও অত্যাবশ্যক। যেমন: নামায, তাওয়াফ, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি। তাই আমাদের জানতে হবে কিভাবে পেশাব-পায়খানা ও অন্যান্য অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। অযু, গোসল ও তায়াম্মুম করার পদ্ধতি কী? শরীর, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অন্যান্য বস্তু পবিত্র করার নিয়ম পদ্ধতি কী? এসব কিছু না জানলে সঠিকভাবে পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব নয়।
নাজাসাত কাকে বলে
‘নাজাসাত’ অর্থ অপবিত্রতা ও অপবিত্র বস্তু। নাজাসাত এটা আরবি শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে, নাপাক। যে কোনো নাপাকক্ই নাজাসাত বলা হয়। মানুষ বা জীব-জন্তুর শরীর থেকে যে অপবিত্র ও নাপাক বস্তু বের হয়, একে শরীআতের পরিভাষায় ‘নাজাসাত’ বলা হয়।
No posts
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (র) বলেন, নাজাসাত বলতে এমন বস্তুকে বোঝায় যাকে সুস্থ প্রকৃতি অপবিত্র বলে মনে করে, যাকে সে পরিহার করে এবং কাপড়ে লাগলে ধুয়ে ফেলে। যেমন, মল-মূত্র, রক্ত, পুঁজ, মদ ইত্যাদি।
নাসাজাতের প্রকারভেদ
নাসাজাত দুই প্রকার। (১) নাজাসাতে গলীজা (যে নাপাকীর হুকুম শক্ত) ও (২) নাজাসাতে খফীফা (যার হুকুম কিছুটা হালকা)। নিম্নে এই দুই প্রকার নাসাজাতের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
মানুষের মল মূত্র, মানুষ ও প্রাণীর রক্ত, বীর্য, মদ, সব ধরনের পশুর পায়খানা, সব ধরনের হারাম পশুর পেশাব এবং পাখীর মধ্যে শুধু হাঁস ও মুরগির বিষ্টা হল নাসাজাতে গলীজা বা শক্ত নাপাকী।
গরু, মহিষ, বকরী ইত্যাদি সকল হালাল পশুর পেশাব, কাক চিল ইত্যাদি সকল হারাম পাখির বিষ্ঠা এবং ঘোড়ার পেশাব হল নাসাজাতে খফীফা।
হাঁস, মুরগি ও পানকৌড়ি ব্যতীত অন্যান্য হালাল পাখির বিষ্ঠা (যেমন কবুতর, চড়ই, শালিক ইত্যাদির বিষ্ঠা) এবং বাদুর ও চামচিকার পেশাব পায়খানা পাক।এমনিভাবে মশা, মাছি, ছারপোকা এবং মাছের রক্তও পাক।
নাসাজাত কম হোক বা বেশী হোক পানিতে পড়লে সেই পানি নাজাছাত বা নাপাক হয়ে যাবে- নাজাছাতে গলীজা পড়লে পানিও নাসাজাতে গলীজা হয়ে যাবে এবং নাজাছাতে খফীফা পড়লে নাসাজাতে খফীফা হবে। তবে প্রবাহিত পানিতে বা ১০০ বর্গহাত কিংবা তার চেয়ে বড় কোন কুয়া হাউজ ইত্যাদিতে নাপাকী পড়লে তা নাপাক হবে না। তবে নাপাকী পড়ার কারণে তার রং স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তিত হয়ে গেলে নাপাক হয়ে যাবে। যে পানি দ্বারা কোন নাপাক জিনিস ধৌত করা হয়, সে পানি নাপাক হয়ে যায়। মৃতকে যে পানি দ্বারা গোসল দেয়া হয় সে পানিও নাপাক।
নাসাজাতে গলীজার মধ্যে যেগুলো তরল, যেমন রক্ত পেশাব ইত্যাদি, তা এক দেরহাম (গোলকৃত ভাবে একটা কাঁচা টাকা অর্থাৎ, হাতের তালুর নীচ স্থান পরিমাণের সমান) পর্যন্ত শরীর বা কাপড়ে লাগলে মাফ আছে অর্থাৎ, তা না ধুয়ে নামায পড়লে নামায হয়ে যাবে, তবে বিনা ওজরে স্বেচ্ছায় এরূপ করা মাকরূহ। আর এক দেরহাম পরিমাণের চেয়ে বেশী হলে তা মাফ নয় অর্থাৎ, তা পাক না করে নামায পড়া জায়েয নয়।
নাসাজাতে গলীজার মধ্যে যেগুলো গাঢ় যেমন গোবর, পায়খানা ইত্যাদি তা এক সিকি পরিমাণ পর্যন্ত (অর্থাৎ, ৪.৮৬ গ্রাম পর্যন্ত) কাপড় বা শরীরে লাগলে মাফ কিন্তু তার চেয়ে অধিক পরিমাণ লাগলে মাফ নয়।
নাসাজাতে খফীফা শরীর বা কাপড়ে লাগলে যে অঙ্গে লেগেছে তার চার ভাগের এক ভাগের কম হলে মাফ, আর পূর্ণ চার ভাগের এক ভাগ বা আরও বেশী হলে মাফ নয়। জামার হাতা, কলি, কাপড়ের আঁচল, পায়জামার দুই মুহরীর প্রত্যেকটা ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ (অংশ) বলে গণ্য হবে।
রাস্তা-ঘাটে বা বাজারে যে পানি বা কাদার ছিটা কাপড়ে কিংবা শরীরে লাগে তাতে স্পষ্টতঃ কোন নাপাক জিনিস দেখা গেলে তা নাপাক আর স্পষ্টতঃ কোন নাপাক জিনিস দেখা না গেলে নাপাক নয়। এটাই ফতওয়া; তবে মুত্তাকী লোকদের জন্য- যাদের হাটে বাজারে যাওয়ার অভ্যাস নয়, যারা সাধারণতঃ খুব পাক ছাফ থাকেন- তাদের শরীরে বা কাপড়ে এই পানি কাদা লাগলে তাতে কোন নাপাক জিনিস দেখা না গেলেও ধুয়ে নেয়া উচিৎ।
গাভী, বকরী দহন করার সময় যদি দুই একটি লেদা বা সামান্য গােবর দুধের মধ্যে পড়ে এবং সাথে সাথে তা বের করে ফেলা হয় তাহলে তা মাফ। কিন্তু যদি লেদা বা গোবর দুধের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যায়, তাহলে সম্পূর্ণ দুধ নাপাক হয়ে যাবে, তা খাওয়া জায়েয হবে না।
উৎপন্ন ফসল মাড়াই করার সময় গরু অথবা অন্য কোন পশু তার উপর পেশাব করলে তা নাপাক হবে না। তবে মাড়াবার সময় ব্যতীত অন্য সময় পেশাব করলে নাপাক হয়ে যাবে।
কুকুর, শুকর, বানর এবং বাঘ, চিতাবাঘ প্রভৃতি হিংস্র প্রাণীর ঝুটা নাপাক। (খাদ্য বা পানীয় বস্তুতে মুখ লাগিয়ে ত্যাগ করলে তাকে ঝুটা বা উচ্ছিষ্ট বলা হয়)।
বিড়ালের ঝুটা পাক, তবে মাকরূহ। কোন পানিতে বিড়াল মুখ দিয়ে থাকলে তা দ্বারা উয়ু করবে না। অবশ্য যদি অন্য পানি না পাওয়া যায় তবে ঐ পানি দ্বারাই উযু করবে। আর দুধ বা তরকারী ইত্যাদি খাদ্য খাবারের মধ্যে মুখ দিয়ে থাকলে যদি মালিক অবস্থাপন্ন হয় তাহলে তা খাবে না- খাওয়া মাকরূহ হবে। যদি গরীব হয় তবে তার জন্য তা খাওয়া মাকরুহ নয়। তবে বিড়াল যদি সদ্য ইঁদুর ধরে এসে তৎক্ষণাৎ কোন পানি বা খাদ্য খাবারে মুখ দেয় তবে তা নাপাক হয়ে যাবে। আর যদি কিছুক্ষণ দেরী করে নিজের মুখ চেটে চুষে পরিষ্কার করে তারপর মুখ দেয় তখন নাপাক হবে না- এখন পূর্বের মাসআলার ন্যায় মাকরূহ হবে।
যে সব প্রাণী ঘরে থাকে যেমন সাপ, বিচ্ছু, ইদুর, তেলাপোকা, টিকটিকি এবং মুরগি- যেগুলো সর্বত্র ছাড়া থাকে- এদের ঝুটা মাকরূহ তানযীহী। ইঁদুর যদি রুটির কিছু অংশ খেয়ে থাকে সেদিক দিয়ে কিছুটা ছিড়ে ফেলে অবশিষ্ট অংশ খাবে।
হালাল পশু ও হালাল পাখীর ঝুটা পাক। ঘােড়ার ঝুটাও পাক। যে কোন রকম পোষা পাখী যদি মরা না খায় এবং তার ঠোটে কোন রকম নাপাকী থাকার সন্দেহ না থাকে তবে তাদের ঝুটাও পাক ।
হালাল পশু ও হালাল জানোয়ারের ঝুটা পাক। তাদের ঘামও পাক। যাদের ঝুটা মাকরূহ তাদের ঘামও মাকরূহ।
মুসলমান অমুসলমান সব লোকের ঝুটা পাক, তবে কোন নাপাক বস্তু তার মুখে থাকা অবস্থায় পানি উচ্ছিষ্ট করলে ঐ পানি নাপাক হয়ে যাবে। জানা অবস্থায় বে-গানা পুরুষের ঝুটা খাদ্য ও পানি নারীর জন্য খাওয়া মাকরূহ। অনুরূপ বে-গানা নারীর ঝুটাও পুরুষের জন্য মাকরূহ। অবশ্য না জানা অবস্থায় খেয়ে ফেললে মাকরূহ হবে না।
উপসংহার
ইসলাম বাহ্যিক নাসাজাত থেকে পবিত্রতা অর্জনের পাশাপাশি মনের পবিত্রতার ওপর খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসলামের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাবগুলো যথাযথভাবে আদায়ের মাধ্যমে মনের পবিত্রতা অর্জন করা যায়। কোনো মুমিন যদি ইবাদাতের পাশাপাশি হালাল খাদ্য গ্রহণ করেন, হারাম থেকে বেঁচে থাকেন, কুরআন তিলাওয়াত করেন এবং সদা আল্লাহর যিকির করেন তবে তাঁর অন্তর পবিত্র থাকবে।
গোসল ও তায়াম্মুম-এর সংজ্ঞা দিন। উভযের ফরয কয়টি ও কি কি? আলোচনা করুন।
ভূমিকা
ঈমানদারকে সবসময় শারীরিক পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখতে হয়। উযুর পাশাপাশি তাকে সময়-সুযোগ ও সুবিধা-আবশ্যিকতা অনুপাতে গোসলও করতে হয়। এমনকি প্রয়োজন এবং অবস্থার প্রেক্ষাপটে তায়াম্মুম করার মাধ্যমেও পবিত্র অর্জনের সুযোগ রয়েছে ইসলামী শরীয়াতে। রাসুলুল্লাহ (সা.) অপবিত্রতা দূর করার জন্য গোসল করার তাগিদ দিয়েছেন। গোসলের তিনটি ফরজ ও ছয়টি সুন্নত রয়েছে। মুমিনরা এগুলো একনিষ্ঠভাবে পালন করেন। যথাযথভাবে এসব ফরয পালন না করলে— ফরয গোসল ঠিকমতো হয় না। এতে গোসলকারী অপবিত্র থেকে যায়।
গোসল কাকে বলে
গোসল আরবী শব্দ। এ শাব্দিক অর্থ হলো ধৌত করা। আর শরী’আতের পরিভাষায় গোসল অর্থ হলো, পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সর্বাঙ্গ ধৌত করা। যেহেতু গোসল অর্থ পরিষ্কার, পবিত্রতা বা শরীরের ময়লা পরিষ্কার করা, তাই গোসলের সংঙ্গা এভাবে করা যায় -শরীরের ময়লা দূরিকরনার্থে সমস্ত অঙ্গে পানি প্রবাহিত করার নামকেই গোসল বলে। আবার বলা যায় আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্য নাপাক দূরিকরনার্থে সমস্ত শরীর ধৌত করাকে গোসল বলে।
গোসলের প্রথম ফরজ হলো- গড়গড়াসহ কুলি করা। মুখের ভেতর অনেক সময় খাবারের উচ্ছিষ্ট জমে থাকে। গলার ভেতরেও কফ জমে থাকে। তাই গড়গড়াসহ কুলি করলে গলার কফ ও মুখের ভেতর জমে থাকা খাবারের উচ্ছিষ্ট দূর হয়ে যায়।
২. নাকে পানি দেওয়া
গোসলের আরেকটি ফরয হলো- নাকের ভেতর পানি দেওয়া। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাকে পানি দিয়েছেন। এ সম্পর্কিত একাধিক হাদিস বর্ণিত রয়েছে।
এমনভাবে গোসল করতে হবে— যাতে শরীরের কোনো অঙ্গ শুকনো না থাকে। এ প্রসঙ্গে একাধিক হাদিস রয়েছে। সেসব হাদিস অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন গোসল করতেন, তখন তার শরীরের সব অংশ ভেজা থাকতো।
তায়াম্মুম কাকে বলে
তায়াম্মুম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা, সংকল্প করা, ইচ্ছা পোষণ করা ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় পবিত্রতা অর্জনের লক্ষ্যে মাটি ব্যবহারের ইচ্ছা পোষণ করে তা বাস্তবায়ন করার নাম তায়াম্মুম। আল-মুজাম্মল ওসিয়ত গ্রন্থে বলা হয়েছে, মাটি দ্বারা মুখমন্ডল ও উভয় হাত মাসেহ করাকে তায়াম্মুম বলে।
তায়াম্মুমের ফরয
তায়াম্মুমের ফরয তিনটি। যথা- ১. নিয়ত করা, ২. মুখমন্ডল মাসেহ করা, ৩. উভয় হাত কনুই পর্যন্ত মাসেহ করা।
হে মুমিনগণ! তোমরা যখন নামাযের জন্য উঠবে তখন নিজেদের চেহারা ও কনুই পর্যন্ত নিজেদের হাত ধুয়ে নিবে, নিজেদের মাথাসমূহ মাসেহ করবে এবং টাখনু পর্যন্ত নিজেদের পা (ও ধুয়ে নেবে)। তোমরা যদি জানাবত অবস্থায় থাক তবে নিজেদের দেহ (গোসলের মাধ্যমে) ভালোভাবে পবিত্র করে নেবে। তোমরা যদি পীড়িত হও বা সফরে থাক কিংবা তোমাদের মধ্যে কেউ শৌচস্থান থেকে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে দৈহিক মিলন করে থাক এবং পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করবে এবং তা (মাটি) দ্বারা নিজেদের চেহারা ও হাত মাসেহ করবে। আল্লাহ তোমাদের উপর কোনও কষ্ট চাপাতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নিয়ামত পরিপূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা শুকরগোযার হয়ে যাও।
উপসংহার
ইসলাম মানব কল্যাণ মুখী জীবন ব্যবস্থা। সর্বক্ষেত্রে ইসলাম মানুষের জন্য সহজ বিধান প্রবর্তন করেছে। তায়াম্মুমের বিধান তার-ই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামে অসুস্থ কিংবা অফারেগ ব্যক্তিদের জন্য জোরজবরদস্তি নেই। অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রয়েছে অসুস্থ ব্যক্তির বিধান। যদি কোন ব্যক্তি পানি ব্যবহারে অক্ষম হয় তাহলে তার তায়াম্মুম এর বিধান।
সাওম কাকে বলে? সাওম এর প্রকারভেদ ও সাওমের উপকারিতা বর্ণনা করুন।
ভূমিকা
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি স্তর হলো সাওম বা রোজা। ইসলামী শরীয়াতে যতগুলো ইবাদাত রয়েছে তার সাওম অনন্য ও অন্যতম। অন্যান্য ইবাদাতের তুলনায় সাওমের মধ্যে অনন্য একটি বিশেষত্ব রয়েছে। যা মুসলিম মিল্লাতের তাকওয়া অর্জনের শ্রেষ্ঠতম হাতিয়ার হিসেবে ফরজ করে দিয়েছেন। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি ও অধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে সাওম বা রোজা একটি অপরিহার্য ইবাদত।
সাওম কাকে বলে
সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিয়ত করার মাধ্যমে পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার প্রক্রিয়াকে সাওম বলে।
অভিধানে صيام (সিয়াম)-এর সাধারণ অর্থ হল, বিরত থাকা। আর এ জন্যই কথা বলা থেকে যে বিরত থাকে -অর্থাৎ চুপ ও নিস্তব্ধ থাকে তাকে صائم (সায়েম) বলা হয়।
No posts
প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেকটি মানুষ অর্থাৎ নারী ও পুরুষ উভয়ের উপর রমজান মাসের একমাস রোজা বা সাওম পালন করা ফরজ।
সাওমের সংজ্ঞা: সাওম হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত যাওয়ার পর্যন্ত পুরো একটি দিন পানাহার এবং বিরত থাকার প্রক্রিয়া।
সাওম কত প্রকার ও কি কি
ইসলামী শরীয়াতে সাওম বা রোজা-কে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা-
ফরয রোজা: প্রত্যেক বান্দার উপর ফরজ করা হয়েছে আদায় করার জন্য।
ওয়াজিব রোজা: এটি ফরজ এর সমতুল্য একটি সাওম, যার মাধ্যমে ফরজের সমতুল্য নেকি অর্জন করা সম্ভব।
মুস্তাহাব রোজা: এটির সুন্নতের সমতুল্য তবে সুন্নত নয়, এই সকল রোজা আমাদের প্রিয় নবী আদায় করতে পছন্দ করতেন।
সুন্নত রোজা: সুন্নত রোজা হচ্ছে আমাদের প্রিয় নবীর সবচেয়ে পছন্দের রজাগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এই রোজাগুলো তিনি কখনো ছেড়ে দিতেন না।
নফল রোজা: নফল রোজা আদায় না করলে কোন ধরনের গুনাহ লেখা হয় না এবং আদায় করলে নেকি লেখা হয়। এই সকল রোজার বিষয়ে কোন ফরজ, সুন্নত ও ওয়াজিবের বিধান নেই।
সাওমের উপকারিতা
সাওম বা রোজার ইহকালীন, পরকালীন, শারীরিক, মানসিক, স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন ধরণের উপকারিতা রয়েছে। যা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
রোজাদার ব্যক্তিকে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থাকতে হয়। যারা আল্লাহর এ নির্দেশ পালন করে তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ সওয়াব ও প্রতিদানের ঘোষণা। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘বান্দার সব নেক আমলের সওয়াব দানের জন্য একটি নিয়ম থাকে। নেক আমল অনুযায়ী সওয়াব দেওয়া হয়। তা দশ গুণ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু রোজার বিষয়টি সাধারণ নিয়মের উর্ধ্বে। আল্লাহ বলেন, বান্দা আমার জন্যই পানাহার ত্যাগ করেছে, যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থেকেছে। সুতরাং আমি নিজে তাকে বিশেষ প্রতিদান ও সওয়াব দেব।’
রোজা রাখলে জীবনের পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাসের সঙ্গে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, আল্লাহ তাআলা তার আগের (জীবনের) সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’
রোজাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার দুর্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘রোযা হলো জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার শক্ত ঢাল এবং সুরক্ষিত বিশেষ দুর্গ।’
রোজা কেয়ামতের দিন রোজাদারের জন্য শাফায়াত করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ! আমার জন্য এ বান্দা পানাহার ত্যাগ ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করেনি। সুতরাং এ বান্দাকে ক্ষমা করে দাও হে প্রভু! তখন আল্লাহ তাআলা রোজার সুপারিশ গ্রহণ করে নেবেন।
রোজা মানুষের জন্য পশুত্বের স্বভাব থেকে বিরত থাকার অন্যতম প্রশিক্ষণ। কেননা পশুর বৈশিষ্ট্য হলো, যখন ইচ্ছে খায়, ইচ্ছে হলেই পান করে কিংবা যৌন কাজে জড়িয়ে পড়ে। আর মানুষ রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে পশুত্বের সে স্বভাব থেকে ফিরে নিজেদের মধ্যে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও পরিমিতবোধ তৈরি করে থাকে।
রোজার সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো, তাকওয়া তথা মহান আল্লাহ তাআলা ভয় অর্জন করা। নিজেদের চরিত্রকে নিষ্কলুষ করে গড়ে তোলা। আল্লাহর হুকুম পালনে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হওয়া। শুধু তাই নয়, রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষ কম খাওয়া, কম ঘুমানো ও কম কথা বলার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে। আর তাতে মানুষের আত্মার অনেক উন্নতি হয় ও সৌন্দর্য বেড়ে যায়।
সাওমের আত্মিক উপকারের মধ্যে রয়েছে এটি মানুষকে ধৈর্য শিক্ষা দেয় ও তাকে শক্তিশালী করে। ব্যক্তিকে আত্মনিয়ন্ত্রণ শিক্ষা দেয় এবং এর ওপর চলতে সাহায্য করে। সাওমের মাধ্যমে মানুষ তাকওয়া অর্জন করে এবং সাওম মানুষকে তাকওয়া শিক্ষা দেয়।
সাওমের সামাজিক উপকারের মধ্যে রয়েছে এটি জাতিকে শৃংখলা, একতা, ন্যায়পরায়নতা ও সমতা বজায় রাখতে অভ্যস্ত করে। মুমিনের মধ্যে ভালোবাসা, রহমত ও সচ্চরিত্র ইত্যাদি গুণ অর্জনে সাহায্য করে। এছাড়াও সমাজকে সব ধরণের অন্যায় ও বিশৃংখলা থেকে মুক্ত রাখে।
সাওমের শারীরিক উপকারিতা হলো: সাওম মানুষের নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করে ও পাকস্থলী সুস্থ রাখে। শরীরকে অতিরিক্ত ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখে ও অতিরিক্ত ওজন কমায়।
রোজা রেখে সতর্ক থাকতেও পরামর্শ দিয়েছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অন্য কারো মন্দ কথার জবাব না দিয়ে নিজেকে রোজাদার হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মাধ্যমে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখবে, তখন দিনের বেলা সে যেন মুখে কোনো অশ্লীল কথা না বলে, হৈ চৈ না করে। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসে কিংবা গালিগালাজ করে; তাহলে সে যেন শুধু এটুকু বলে চুপ থাকে যে, ‘আমি রোজাদার’, আমি রোজাদার।’
রোজা যেহেতু আল্লাহর নির্দেশ ও ফরজ ইবাদত। সুতরাং তা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ও সক্ষম মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য পালন করা আবশ্যক। আর যখন মানুষ রোজার বিধান পালন করে ছোট বড় সব গুনাহ থেকে বিরত থাকবে, তখনই রোজার সব সুফলগুলো পাওয়া যাবে।
উপসংহার
সেহরি ও ইফতার রোজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমরা যদি এটিকে সুন্নত হিসেবে পালন করি তবে তা শুধু শারীরের পক্ষেই ভালো নয় বরং প্রভূত কল্যাণ ও উপকারিতা পাওয়ার কারণও হয়ে থাকে। তাই সময় মতো সেহরি খাওয়া যেমন সুন্নত তেমনি সময় মতো ইফতার করাও সুন্নত। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনই করতেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সেহরি খাও; কারণ এতে বরকত রয়েছে। আর খেজুর দিয়ে ইফতার করা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত।
তাহারাত-এর সংজ্ঞা দিন। উযু ভঙ্গের কারণ, উযুর ফরয, সুন্নত ও মুস্তাহাবগুলো বর্ণনা করুন।
ভূমিকা
ইসলামী শরীয়তে তাহারাত তথা পবিত্রতার গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্রতা ছাড়া কোন ইবাদাত গ্রহণযোগ্য নয় । আর পবিত্রতা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো পবিত্র পানি ।
তাহারাত এর সংজ্ঞা
আরবি শব্দ طهارة, তাহারাত তথা পবিত্রতা হল ইসলামের একটি অত্যাবশ্যক অংশ। এটি নাজাসাতের বিপরীত, যা হল ধর্মীয়ভাবে অপবিত্র হওয়ার অবস্থা। এটি প্রাথমিকভাবে শারীরিক অপবিত্রতা (যেমন, মূত্র) দূরীকরণের মাধ্যমে আর তারপর অজু বা গোসলের দ্বারা ধর্মীয় পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
শরীয়তের নির্দেশিত পন্থায় পবিত্রতা অর্জন করাকে তাহারাত নামে অভিহিত করা হয়। যেমন- অযু, গোসল ও তায়াম্মুম দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা।
এক বা একাধিক কারণে ওযু ভঙ্গ হতে পারে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো-
পেশাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে কোন কিছু বের হওয়া। পেশাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে প্রস্রাব, পায়খানা, বায়ু, কৃমি, মযী, মনি এবং মেয়েদের হায়েয বা নিফাসের রক্ত বের হলে ওযু ভঙ্গ হয়ে যায়।
শরীরের যেকোন অঙ্গ থেকে নাপাকি বের হওয়া। অপারেশন করে পাইপের মাধ্যমে প্রস্রাব-পায়খানা বের করলে বা শরীরের কোন ক্ষতস্থান থেকে বেশি পরিমাণ রক্ত, বমি বা পুঁজ বের হলে ওযু ভঙ্গ হয়ে যায়।
গোসল ফরয হয় এমন কিছু ঘটে যাওয়া। যেসব কারণে গোসল ফরয হয় সেসব ঘটনায় ওযূও ভঙ্গ হয়ে যায়।
শুয়ে, চিৎ হয়ে বা ঠেস দিয়ে ঘুমানো। শুয়ে বা হেলান দিয়ে ঘুমালে ওযু ভঙ্গ হয়। কিন্তু বসে বসে ঘুমালে ওযু ভঙ্গ হয় না।
হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলা। পাগল, বেহুঁশ বা মাতাল হয়ে যাওয়া বা কোন ঔষধ সেবনের কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে ওযূ ছুটে যায়। মস্তিষ্কের বিকৃতি বা চেতনা হারিয়ে ফেললেও ওযু থাকে না।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় সমস্যাসমূহ আলোকপাত করুন।
ভূমিকা
বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থার পূর্ণাংগ ইসলামিকরণ সময়ের দাবী। বেসরকারি খাতে যে দু’টো ইসলামি ব্যাংক কাজ করছে তারা বিভিন্ন সমস্যার কারণে প্রয়োজনীয় গতিশীলতা অর্জন করতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকার নীতিগতভাবে দেশের সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থা ইসলামিকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও আজ অবধি কোন ব্যাপক ও কর্যকর পন্থা গৃহীত হয়নি।
বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় ইসলামিকরণের পথে অন্তরায়
নিম্নে বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণের পথে অন্তরায়সমূহের কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হলো-
সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব
প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থাকে ইসলামি ব্যবস্থায় রূপান্তর করার জন্য প্রথম এবং প্রধান যে পদক্ষেপ দরকার তা হচ্ছে- এ ব্যাপারে ইতিবাচক ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবধর্মী একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন । কাজ যত মহৎ এবং কল্যাণকর হোক সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা ব্যতীত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকার যদিও এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ১৯৭৫ বাংলাদেশ ওআইসি বেং আইডিবি-এর গঠনতন্ত্রের সাথে একমত হয়ে এ ব্যাংকের সদস্য পদ গ্রহণ করে। ১৯৮১ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়-
Strict adherence to Islam and Islamic Principles and values, as a way of life, constitutes the highest protection for Muslim against the dangers which confront them. Islam is the only path which can lead them to strength, dignity, prosperity and a better future.
অর্থাৎ “মুসলিমগণ যেসব বিপদের সম্মুখীন হয় তা থেকে রক্ষা পেতে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম, ইসলামি নীতি ও মূল্যবোধ কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরাই হচ্ছে আসল কাজ। ইসলামই হচ্ছে একমাত্র পন্থা যা তাদেরকে শক্তি, সম্মান, উন্নতি এবং উন্নত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।” উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত থেকে এ ঘোষণার সাথে বাংলাদেশ ঐকমত্য পোষণ করে। আমাদের দেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্বে বিভিন্ন দেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও এর মাধ্যমে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইসলামিকরণ সরকারের প্রচেষ্টায়ই সম্ভব।”
ইরান, পাকিস্তান ও সুদানের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয় যে, কেবল সরকারি পদক্ষেপই ব্যাংকিং তথা গোটা অর্থনীতিকে ইসলামিকরণ করার ক্ষমতা রাখে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর পদক্ষেপগ্রহণ অপরিহার্য। উল্লেখ্য যে, সুদের ন্যায় একটি জঘন্য হারাম থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর প্রধান দায়িত্ব এদেশের সরকারেরই।
ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণের দ্বিতীয় অন্তরায় হচ্ছে প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাব। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার ব্যবস্থা নেই । এমনকি, বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামি ব্যাংক তার কার্যক্রম চালু করলে এ এখন পর্যন্ত বিএ/বিএ পাস, বিএ/বিএসএস অনার্স কোর্সেও ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬টির অধিক ইসলামি ব্যাংক চালু থাকলেও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়েও তা পড়ানো হচ্ছে না। ফলে লোকজন শিক্ষিত হচ্ছে বটে কিন্তু ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং এর দিক দিয়ে অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। তারা অন্যান্য ব্যবস্থার সাথে ইসলামি ব্যবস্থার তুলনা করতে সুযোগ পাচ্ছে না। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশ জুড়ে এর অসংখ্য শাখা থাকলেও দেশে ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়টিকে ব্যাপকভাবে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করায় নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন-
এক নতুন উদ্যোগ হিসেবে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও অগ্রগতির জন্য যে ব্যাপক গবেষণা, পুস্তকাদি প্রণয়ন ও পথ নির্দেশনা দরকার এবং এজন্য যে ধরনের প্রতিভাধর যোগ্য লোক প্রয়োজন তা তৈরি হচ্ছে না।
ইসলামি ব্যাংক পরিচালনার জন্য যে দরণের যোগ্যতা সম্পন্ন জনশক্তির প্রয়োজন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তা সরবরাহ করছে না। এছাড়াও গোটা ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণের জন্য যে বিপুল সংখ্যক জনশক্তির প্রয়োজন তাও তৈরি হচ্ছে না।
দক্ষ জনশক্তির অভাব
ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামিকরণের পথে তৃতীয় বড় অন্তরায় হচ্ছে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির অভাব। প্রচলিত ব্যাংকসমূহ ইসলামিকরণ করতে হলে প্রথমে ব্যাংকে কর্মরত লোকদেরকেই তা করতে হবে। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকের ধারণা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কর্মনীতি প্রচলিত ব্যাংক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ নব ব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন ছাড়া ব্যাংকসমূহ পরিচালনা করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই ব্যাংকসমূহ এবং সরকারের যৌথ প্রশিক্ষণ একাডেমী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সহজেই এ সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
দেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্টা লাভ করেছে বটে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় আইন আজও প্রণীত হয়নি। এ দিকে প্রচলিত আইনের সাথে সামঞ্জস্য না থাকায় ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না। ইসলামি ব্যাংকিং লেন-দেনে চুক্তি ভংগ হলে ইসলামি আইন অনুসারে গঠিত আদালতে তার সমাধান হওয়া উচিত। কিন্তু আজও তা কায়েম হয়নি।
ইসলামি বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব
দেশে ইসলামি বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় ইসলামি ব্যাংকসমূহকে বিনিয়োগ বিমুখ করে রাখছে এবং রাখবে। এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে ইসলামি মুদ্রাবাজার, পুঁজিবাজার গঠন হওয়া দরকার। ইসলামি নীতিমালা মুতাবেক আর্থ-সামাজিক কাঠামো ঢেলে সাজানো না হলে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারবে না।
আয়কর আইন
দেশের প্রচলিত আইন ইসলামি ব্যাংকিং এর পক্ষে এক বড় সমস্যা। আয়করের উচ্চহার ও আয়কর প্রশাসকের অমনোযোগের দরুণ দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আয়কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বৰ্তমান রয়েছে। করের হার কমিয়ে এমন ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে যাতে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা আদৌ না থাকে। এং যাকাতের মত অবশ্য দেয়সহ অন্যান্য জনকল্যাণমূলক দান যাতে আয়কর মুক্ত হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
কোম্পানি আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর অভাব
বর্তমান কোম্পানি আইন রচিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। সময়ের আবর্তনে এ আইন আজ স্বাধীন দেশের জন্য যথেষ্ট উপযোগী বলে প্রমাণিত হচ্ছে না। এ আইন সংশোধন করে কোম্পানি গঠনকে আরো গণমুখী ও গতিশীল করা এবং ইসলামি ব্যাংকিং কোম্পানি প্ৰতিষ্ঠা ও পরিচালনা সহজতর করা দরকার। তা না হলে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাধাগ্রস্থ হবে।
প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও প্রচারণার অভাব
ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে সর্বমহলে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কোন সার্বিক ও ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ থাকা বাঞ্ছনীয়। ইসলামি ব্যাংক ট্রেনিং এন্ড রিসার্চ একাডেমী এবং ইসলামি ইকনমিক রিসার্চ ব্যুরো যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় উল্লেখযোগ্য নয়।
সার্বিক কার্যক্রম শরী’আতের সীমার মধ্যে পরিচালনা করা সত্ত্বেও কেবল টাকার জন্য সুদী কোম্পানীর দারস্থ হতে হয়। এতে ব্যাংকের পুরো আয় সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণের সাথে বীমাকেও ইসলামিকরণ জরুরি। তবে ইদানীং কয়েকটি ইসলামি বীমা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সরকার এ ব্যাপারে বাস্তব সহযোগিতা প্রদান করলে এবং অন্যান্য বীমা কোম্পানীকে ইসলামিকরণের উদ্যোগ নিলে সম্পূর্ণ অর্থনীতিকে ইসলামিকরণ সহজতর হবে।
ইসলামি ফিনান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্টের অভাব
ইসলামি শরীআ অনুসারে বিভিন্ন ধরন ও মেয়াদী ফিনান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্টের অভাব ইসলামি ব্যাংকিংকে কার্যকর বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত করছে। এজন্য মুদারাবা সার্টিফিকেট, ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেট, মুদারাবা বন্ড, পার্টিসিপেশন টার্ম সার্টিফিকেট, ইসলামিক কমার্শিয়াল পেপার, সলিডারিটি বন্ড ইত্যাদি চালু করা প্রয়োজন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণের লক্ষ্যে গবেষণা কোষের অভাব
বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণে যথেষ্ট অবদান রাখছে। আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক- বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯২ তারিখে “ইসলামি অর্থনীতি সেল” নামে একটি সেল গঠন করা হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত এ সেলের কার্যক্রম যথাযথভাবে শুরু হয়নি।
No posts
সরকারি অর্থায়নে সুদবিহীন সার্টিফিকেট চালুর অভাব
সরকারের অর্থ ঘাটতি পুরণের জন্য বিভিন্ন মেয়াদী সুদমুক্ত বন্ড, সার্টিফিকেট তৈরি না হলে ইসলামি ব্যাংকসমূহ তাদের উদ্বৃত্ত তারল্য খাটাতে পারবে না। সরকার যদি সুদমুক্ত বন্ড, সার্টিফিকেটের পরিবর্তে লাভ-ক্ষতিজনক বন্ড চালু করত, তবে ইসলামি ব্যাংকসমূহে স্বীয় অলস অর্থ এরূপ বন্ডে খাটাতে পারত। ফলে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাও অধিকতর কার্যকর হত।
উপসংহার
বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানে ইসলামি শরী’আ বিশ্বজনীনভাবে কাজ করে আসছে। যা শত শত বছর যাবত মানুষের কল্যাণ সাধন করে চলছে। মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে ইসলামের একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের আর্থিক সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে ব্যাংকিং সমস্যা সমাধানেও ইসলাম যে সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারে আজকের ইসলামি ব্যাংকের উত্তরোত্তর অগ্রগতি এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
মজুদদারী, কালোবাজারি, ভেজাল মেশানো এবং ওজনে কম দেয়ার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টি ভঙ্গি আলোচনা করুন।
ভূমিকা
ইসলাম একটি শাশ্বত, সর্বজনীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। সৃষ্টি জগতের এমন কোন বিষয় নেই যে ব্যাপারে ইসলাম নির্দেশনা প্রদান করেনি। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট এবং এতদুভয়ের এতদুভয়ের মধ্যে যা রয়েছে তা সংশয় মুক্ত।
মজুদদারী, কালোবাজারি, ভেজাল মেশানো এবং ওজনে কম দেয়ার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টি ভঙ্গি
নিম্নে এসকল অনৈতিক কার্যাবলীতে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা হলো-
মজুদদারী
ইসলাম মানুষকে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছে। তবে এ সুযোগে মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী মজুদ রেখে বাজারে পণ্য সকট সৃষ্টি করে মুনাফা অর্জন ইসলামে বৈধ নয়। কেননা এতে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠে এবং নিম্ন আয়ের মানুষেরা দুর্ভোগের শিকার হয়। আল্লাহর সৃষ্টি জীবকে কষ্ট দিয়ে বাজারে তথা অধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে পণ্য মজুদ করে রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
“যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত পযন্ত খাদ্য-এব মজুদ করবে সে মহান আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং তার সঙ্গে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না।”
আল্লামা শামী (রহ.) বলেন, দুর্ভিক্ষের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া যদি সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তবে বিচারক বা আদালত মজুদদারকে খাদ্যশস্য বিক্রি করে দেয়ার জন্য আদেশ জারী করবেন। যদি মজুদদার হুকুম তামিল না করেন তবে বিচারক তার খোরাকি বাবদ খাদ্য দ্রব্য রেখে বাকীগুলো বিক্রি করে দিবে। যদি জনগণের খাদ্য দ্রব্য ক্রয় করার টাকা না থাকে তবে বিচারক ক্রমশ তা বণ্টন করে দিবেন। পরে তাদের নিকট খাদ্য দ্রব্য আসলে বিচারক আদালত তাদের নিকট থেকে উসূল করে দাতার নিকট পৌঁছে দিবে। নিজের জমির ব্যাপারেও এ বিধান। তবে কেউ যদি জমির ফসল হতে নিজের ও পরিবারের বাৎসরিক প্রয়োজন পূরণের জন্য সঞ্চয় রাখে তবে তাতে দোষ নেই।
কালোবাজারী
অধিক লাভের আশায় পণ্য সামগ্রি ক্রয় করে মজুদ করে রাখা এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হলে সে মজুদকৃত পণ্য অধিক লাভে পশ্চাতদ্বারে বিক্রি করাকে কালোবাজারী বলে অসৎ ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় এ পন্থা অবলম্বন করে। এতে জনসাধারণ চরম দুর্ভোগের শিকার হয়। কালোবাজারীর কারণে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায় এবং তা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এজন্য কালোবাজারী ইসলামে নিষিদ্ধ। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকার উৎপাদিত লাল চিনি নির্ধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি কেজিতে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বেশি দামে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
বর্তমানে পণ্য দ্রব্যে ভেজাল নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে ঔষধ পর্যন্ত প্রায় সকল পণ্যে ভেজালের উপস্থিতি লক্ষনীয়, পণ্য-সামগ্রীতে ভেজাল হিসাবে এমন কিছু উপাদান ব্যবহার করা হয় যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দিন দিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। খাদ্য-দ্রব্যে ভেজাল দেওয়া ইসলামে নিষিদ। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যে ও ঔষধে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। মাছ গোশত শাক-সবজি ফলমূল থেকে শুরু করে ঔষধেও ভেজালে সয়লাভ হয়ে গেছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “ক্ষতিগ্রস্থ হয়ো না এবং কারো ক্ষতি করো না।”
ইসলাম ধর্মে এ ধরণের কাজ চরমভাবে নিন্দিত। এ ভেজাল মিশ্রনের সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধ জড়িয়ে আছে। যেমন প্রতারণা অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন, আত্মসাৎ, সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রন, অমানবিকতা এবং সাধারণ মানুষের জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
এসব কাজ ইসলামে মহাপাপ। যারা খাদ্যে ভেজাল মেশায় তাদের আল্লাহর নির্দেশের প্রতি সাবধান হওয়া উচিত। চিন্তা করা উচিত যে নিজের বৈধ পণ্যের ব্যবসায় ভেজাল মেশানোর ফলে ব্যবসাটি হারামে পরিণত হচ্ছে। আরও ভাবনার বিষয় হল শরীয়তে হারাম পদ্ধতিতে উপার্জিত মাল যারা ভক্ষণ করে তাদের ইবাদত কবুল হয় না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাত করেন, “কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদের পাপীরুপে উঠানো হবে তবে যেসব ব্যবসায়ী আল্লাহকে ভয় করে, কল্যানের কাজ করে ও সত্যতা ধারণ করে তারা ব্যতীত”।
No posts
ওজনে কম দেয়া
পণ্য সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ক্রেতাকে পরিমাপে কম কিংবা মেপে নেয়ার সময় বেশী নেয়াকে ইসলামে নিষিদ্ধ করেছে। ও হাদীসে এমন কর্মকাণ্ডকে অত্যন্ত্য নিরদলীয় ও পরকালীন দুর্ভোগের কারণ বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“তিনি আকাশকে করেছেন অমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদণ্ড (দাঁড়িপাল্লা), যাতে তোমরা সীমালংঘন না কর তুলাদন্ডে। তোমরা ন্যায্য ওখন কায়েম কর এবং ওজনে কম দিও না।”
এজন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওজনে কম না দিয়ে বেশি দেয়ার জন্য হুকুম করেছেন। তিনি বলেন, “ওজন কর এবং কিছু বেশি দিয়ে দাও।”
উপসংহার
বর্তমানে ব্যবসায় হারাম ও হালাল বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দ্রুত সম্পদশালী হওয়ার আশায় বিভিন্ন অনৈতিক কাজ যেমন- মজুদদারী, কালোবাজারি, ওজনে কম দেয়া ও ভেজাল মেশানো ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হচ্ছে। ব্যবসায়ী মহলকে এসব বিষয়ে সচেতন ও সাবধান করা এখন সময়ের দাবী।
মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কল্যাণ অর্জনের পথ প্রশস্ত করার জন্যই ইসলামে অংশীদারি ব্যবসায়কে হালাল করা হয়েছে। সমাজে অনেকের কাছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি থাকে। এ পুঁজির দ্বারা এককভাবে কোনো কল্যাণকর উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি সমন্বয়ে বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হয়। ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় ও বেকারত্ব হ্রাস পায়। সর্বোপরি ইসলামী সমাজের ভ্রাতৃত্ব ও ভালো কাজের সহযোগিতার বিষয়টিও মুশারাকা পদ্ধতির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
বাইয়ে মুশারাকা এর পরিচয়
‘বাইয়ে’ আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো ক্রয়-বিক্রয়। আর মুশারাকা শব্দটি আরবী শিরকাতুন থেকে এসেছে। শিরকাত অর্থ শরীক হওয়া বা অংশীদার হওয়া তাই শাব্দিক দিক থেকে মুশারাকা অর্ধ অংশীদারিত্ব। অন্য কথায় বলতে গেলে মুশারাকা অর্থ হলো কোনো বিষয়ে পরস্পর একে অন্যের অংশীদার হওয়া।
No posts
মুশারাকার প্রকারভেদ
মুশারাকা বলতে সাধারণত ‘শিরকাতুল আকদ’ কে বুঝায়। শিরকাতুল আকদ হলো চুক্তি ভিত্তিক অংশীদারি ব্যবসা (Partnership Business)। শিরকাতুল প্রধানত চার প্রকার। যেমন-
শিরকাতুল আকদের প্রত্যেক প্রকারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে তুলে ধরা হলো:
শিরকাতুল মুফাওয়াদা বা সমতাভিত্তিক অংশীদারিত্ব
ব্যবসায়ে অংশীদারদের পুঁজি ব্যবস্থাপনা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সমতা থাকলে তাকে শিরকাতুল মুফাওয়াদা বা সমতাভিত্তিক অংশীদারিত্ব বলে। সমঅংশীদারি কারবারে সকল অংশীদারের মূলধন লাভ লোকসান ও দায়দায়িত্ব সমান হয়। এ কারবারে পুঁজির কমবেশি বয়সের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক, ও জাতি ভেদ ভিন্ন হলে তা বৈধ হবে না। ইমাম আযম আবু হানিফা ও ইমাম মালিক (রহ.) এটাকে অবৈধ বলেছেন কারণ সকল পর্যায়ে সমতা বজায় রেখে অংশীদার কারবার করা খবুই কষ্ট এবং অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অপকারিতা ও ক্ষতির দিক লক্ষ্য করা যায়।
শিরকাতুল ইনান বা অসম অংশীদারিত্ব
অসম অংশীদারিত্ব বা স্বাধীন অংশীদারিত্বকে ইনান বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ ক্ষেত্রে মূলধন, ব্যবস্থাপনা ও লাভে সমান অংশীদারিত্ব বাধ্যতামূলক নয়। একজনের চেয়ে অন্যের মূলধন কমবেশি হতে পারে। একজন অংশীদারকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও দেয়া যেতে পারে। এভাবে লাভও সমানভাবে বণ্টিত হওয়া বাধ্যতামূলক নয় এবং চুক্তিতে লাভের অনুপাত যেভাবে উল্লেখ থাকবে ঠিক সেভাবেই বণ্টিত হবে। অন্যদিকে লোকসান হলে চুক্তি হারে মূলধনের অনুপাতে সবাই বহন করবে।
যে অংশীদারি ব্যবসা সুনাম (good will) কে পুঁজি করে পরিচালিত হয় তাকে শিরকাতুল উজুহ বা সুনাম ভিত্তিক অংশীদারিত্ব বলে। এ ধরনের ব্যবসায় একাধিক ব্যক্তি ব্যবসায়ে পুজি বা মূলধন বিনিয়োগ না করে ব্যবসায়ী মহলে তাদের সুনাম ও বিশ্বস্ততাকে ব্যবহার করে অন্যের নিকট থেকে বাকিতে দ্রব্য ক্রয়পূর্বক নগদে বিক্রি করার মাধ্যমে ব্যবসা করে থাকে এবং তা থেকে অর্জিত লাভ চুক্তি অনুযায়ী ভাগ করে নেয়। ব্যবসায়ে প্রত্যেক অংশীদারের মালিকানা তাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারণ করা, সেভাবে লাভ ভাগ করে নেয়া এবং সে অনুযায়ী লোকসান বহন করাই হলো শিরকাতুল উজুহ বা সুনামভিত্তিক অংশীদারিত্বমূলক ব্যবসার মূল লক্ষ্য।
শিরকাতুল আবদান বা স্বশরীরে উপস্থিতিমূলক অংশীদারিত্ব
শ্রম ও দক্ষতাকে পুঁজি করে পরিচালিত অংশী ব্যবসাকেকে শিরকাতুল আবদান বলা হয়। এ পদ্ধতিতে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা পক্ষ একটি অংশীদার ব্যবসা করবে। তারা তাদের শ্রম ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। অর্জিত মুনাফা চুক্তি অনুযায়ী তাদের নামে বণ্টন হয়ে নেবে। যেমন দু’ জন মিলে কোনো বইয়ের ব্যবসা শুরু করল এবং এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হলো যে, তা যা লাভ করবে তা নিজেদের মধ্যে ৫০ : ৫০ অথবা ৪৫ : ৫৫ অনুপাতে ভাগ করে নেবে। মূলত এ ধরনের অংশীদারি ব্যবসাকে শিরকাতুল আবদান বলা হয়।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, উক্ত চার প্রকার অংশীদারমূলক কারবারে শিরকাতুল মুফাওয়াদা যদিও মতানৈক্য রয়েছে কিন্তু শিরকাতুল ইনান, শিরকাতুল উজুহু ও শিরকাতুল আবদান এর ক্ষেত্রে শরীয়তে কোনো বাধা বা মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয় না।
বাইয়ে সালাম কাকে বলে? বাইয়ে-সালাম বৈধ হওয়ার শরয়ী ভিত্তি আলোচনা কর।
ভূমিকা
মহান আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। এই বিধানকে কার্যকরী করতে গিয়ে ইসলামী শরীয়তের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্ন সুদবিহীন ব্যবসা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাইয়ে-সালাম তার মধ্যে অন্যতম। বাইয়ে সালামের মাধ্যমে বিক্রেতা তার পণ্যকে অগ্রিম মূল্যে বিক্রি করে অভূতপূর্ব লাভবান হয় এবং ক্রেতা অগ্রিম পণ্য ক্রয়ের দুশ্চিন্তা থেকে স্বস্তি লাভ করে।
বাইয়ে সালাম এর পরিচয়
বাইয়ে সালাম শব্দের আভিধানিক অর্থ-
No posts
আল্লামা ইবনে ইমাম (রহ.) উল্লেখ করেছেন যে, আরবী সালামুন শব্দটি তাসলীম মাসদার থেকে উৎসারিত। যার অর্থ হলো– হস্তান্তর করা, অর্পন করা। যেহেতু বাইয়ে-সালামের মাঝে দ্রব্য মূল্য মজলিসেই অর্পণ করা অপরিহার্য।
বাইয়ে-সালামের আরেকটি পরিভাষা হচ্ছে বাইয়ে-সালাফ। অভিধানে “সালাম” অর্থ সমর্পণ করা এবং “সালাফ” অর্থ–অগ্রিম প্রদান করা। চুক্তির মজলিসে পণ্যের মূল্য বিক্রেতার কাছে সমর্পণ করা হয় বলে একে বাইয়ে সালাম বলা হয়। অনুরূপভাবে পণ্যের মূল্য বিক্রেতাকে অগ্রিম প্রদান করা হয় বলে একে বাইয়ে– সালাম বলে।
আল ইযাহ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে “সালাম” শব্দের আভিধানিক অর্থ কোনো কিছু দ্রুত চাওয়া বা কোনো কাজ দ্রুত করা। যেহেতু বাইয়ে– সালাম এর মাঝে দ্রব্য হাতে আসার আগে দ্রব্যমূল্য দ্রুত গ্রহণ করা হয়।
কারো কারো মতে সালাম এর আভিধানিক অর্থ হলো দ্রুত কোনো কাজ করা বা দ্রুত কিছু চাওয়া আর বাইয়ে- সালাম হলো বিক্রয়ের প্রকৃত সময় আসার পূর্বেই সম্পন্ন হয়।
বাইয়ে-সালাম ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সম্পাদিত এমন এক চুক্তি যার আওতায় বিক্রেতা কোনো পণ্য বা উৎপাদিত বস্তু ক্রেতার কাছে একটি সম্মত মূল্যে বিক্রি করে। ক্রেতা চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার সাথে সাথে তার মূল্য পরিশোধ করে। কিন্তু ভবিষ্যতের কোন নির্দিষ্ট সময়ে এবং কোনো নির্দিষ্ট স্থানে পণ্যের স্থিরীকৃত আকার, গুণ ও পরিমাণ অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করে থাকে। অর্থাৎ ভবিষ্যতের নির্ধারিত কোনো সময়ে সরবরাহের শর্তে এবং তাৎক্ষণিক সম্মত মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরীয়াহ অনুমোদিত পণ্য সামগ্রী অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয় করাকে বাইয়ে-সালাম বলে।
সেন্ট্রাল শরীয়াহ বোর্ড ফর ইসলামী ব্যাংকস অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত ও প্রস্তাবিত “ইসলামী ব্যাংক কোম্পনি আইন” এ বাইয়ে-সালাম এর সংজ্ঞা হলো–
“বাইয়ে- সালাম বলতে এমন এক ক্রয় বিক্রয়ের চুক্তিকে বুঝায় যেখানে ভবিষ্যতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করার শর্তে ব্যাংক গ্রাহকের সাথে তার সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত ক্রয় মূল্য আগাম পরিশোধ করবে। এই চুক্তি সম্পাদনের সময় পণ্যের গুণগত মান, পরিমাণ, ধরণ, সরবরাহের স্থান ও সময় উল্লেখ করতে হবে।
AAOIFI বাইয়ে সালামের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হলো–“সালাম লেনদেন হলো আগাম দাম শোধের বিপরীতে ভবিষ্যতে সরবরাহের শর্তে পণ্য ক্রয়। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সরবরাহ করা হবে এমন পণ্যের বিপরীতে পণ্যের দাম চুক্তির সময় আগাম পরিশোধ করা হয়।
ইবনে কায়উম বলেছেন, “অগ্রিম মূল্য পরিশোধের বিপরীতে ভবিষ্যতে সরবরাহের শর্তে ক্রয় করাকে বাইয়ে-সালাম বলে। স্মরণযোগ্য যে, এ পদ্ধতিতে ব্যাংক কাউকে ঝণ দেয় না। বরং পণ্য ক্রয় করার জন্য অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে থাকে। পরবর্তীতে ব্যাংক তার ক্রয়কৃত পণ্য বাজারে বিক্রি করে। এক্ষেত্রে যদি বিক্রয় মূল্য ক্রয় মূল্য থেকে বেশি হয় তাহলেই ব্যাংকের মুনাফা অর্জিত হয়।
বাইয়ে সালাম বৈধ হওয়ার শরয়ী ভিত্তি
প্রকাশ থাকে যে, ইসলামী শরীয়তের প্রত্যেকটি ব্যবসা বা কারবার বৈধ হওয়ার জন্য কুরআন, হাদীস, ইজমা ও প্রয়োজন বোধে কিয়াসের দলীল বিদ্যমান থাকে। বাইয়ে–সালাম এর বৈধতা প্রশ্ন কুরআন, হাদীস ও ইজমার দলীল সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো-
আল্লাহ তায়ালার বাণী
বাইয়ে সালাম একটি শরীয়াহ স্বীকৃত বিনিয়োগ পদ্ধতি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- “আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রকে হালাল সাব্যস্ত করেছের আর সুদকে করেছেন হারাম।” এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সুদমুক্ত সকল ব্যবসাকে বৈধ করা– বাইয়ে সালাম একটি স্বীকৃত বাইয়ে বা কারবার হওয়ায় তা আয়াতে আলোচিত বৈধ ক্রয়-বিক্রয়ের আওতায় গণ্য করেছে।
এছাড়া আল্লাহ পাক পবিত্র আল কুরআনুল কারীমের সূরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াতে ঘোষণা দিয়েছেন যে, হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট মেয়াদে কোনো ঋণের লেনদেন কর তখন তা লিপিবদ্ধ করে রাখো।
একথা প্রণিধানযোগ্য যে, উল্লিখিত আয়াতের তাফসীরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, সালাফ “বাইয়ে সালাম” নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদানকৃত একটি চুক্তি। এটাকে মহান আল্লাহ তায়ালা তার কিতাবে হালাল করেছেন। এদ্ব্যতীত তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, সুরা বাকারার ২৮২নং আয়াতটি বাইয়ে-সালাম সম্পর্কে নাযিল করা হয়েছে।
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বাণী
বিখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) মদীনায় আগমন করলে লোকেরা এক বছর বা দুই বছরের জন্য বাইয়ে-সালাম (বাইয়ে-সালাম) করত। রাসূল (সা.) বলেছেন খেজুরের ক্ষেত্রে কেউ সালাফ (বাইয়ে-সালাম) করলে, সে যেন তার নির্দিষ্ট পরিমাণ ও নির্দিষ্ট পরিমাণ খেজুরের মধ্যে করে।” অন্য এক বর্ণনায় আছে কোনো বস্তুতে কেউ সালাফ করলে সে যেন তা নির্দিষ্ট পরিমাপ, পরিমাণ ও নির্দিষ্ট মেয়াদে করে”।
ইজমা
আল্লামা শায়খ আল ইমাম আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে কুদামাহ তার লিখিত অলমুগনি কিতাবের ৪র্থ খণ্ডে বলেন যে, বাইয়ে-সালামা বৈধ হওয়ার পক্ষে ইজমা সংঘটিত হয়েছে বলে আল্লামা ইবনুল মুনজির বর্ণনা করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, বাইয়ে-সালাম এর ব্যাপারে সাহাবীদের ঐকমতো পাওয়া গেছে। তাদের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য হলো “একে অন্যের সাথে নির্দিষ্ট ধরনের পণ্যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ ও পরিমাপে এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে বাইয়ে সালাম করতে পারে।
এ ইজমাকে আরো সুদৃঢ় করেছে যে বিষয়টি তা হল নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে, এবং খোলাফায়ে রাশেদার অন্যতম খলিফা হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর এর যুগে সাহাবীগণ বাইয়ে-সালাম পদ্ধতিতে কারবার বা লেনদেন করেছেন এবং কেউ এর বিপক্ষে অবস্থান নেননি। এছাড়া সকল মাযহাব এর ফকীহ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতে বাইয়ে সালাম বৈধ। এটা বৈধতার বিপক্ষে কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন এমনটি পরিলক্ষিত হয়নি।
কিয়াস
আল্লাহ তায়ালা যেহেতু কুরআনে “দাইন” বা ঋণের চুক্তির কথা বলেছেন। ঋণ যেহেতু মানুষ প্রথমে নগদ গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে মেয়াদের মধ্যে তা পরিশোধ করে। তাই বলা যায় যে, বাইয়ে সালাম এর কারবারে পণ্য পরবর্তীতে প্রদান সাপেক্ষে নগদ মূল্য পূর্বে গ্রহণ করে থাকে। অতএব, কুরআনে বর্ণিত ঋণের চুক্তির সাথে বাইরে- সালামের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
উপসংহার
উল্লিখিত আলোচনান্তে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বাইয়ে সালাম কুরআন-হাদীস ও ইজমা দ্বারা স্বীকৃত একটি বৈধ ব্যবসা। সুতরাং পরবর্তীতে পণ্য সরবরাহের শর্তে অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে কুরআান হাদীস ও ইজমার বিধানকে যথাযথ অনুসরণ একান্ত কাম্য।
ইসলামি ব্যাংকের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করুন।
ভূমিকা
বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং-এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। একই বছর ‘ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ একটি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর ১৯৮৭ সালে আল-বারাকা ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৫ সালে আরো দু’টি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ দুটি ব্যাংক হলো সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিঃ ও আল-আরাফা ইসলামি ব্যাংক লিঃ। এদেশে ইসলামি ব্যাংকের প্রাথমিক সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও ইসলামী ব্যাংকি সিস্টেম চালু করে। যেগুলোতে জনসাধারণের আগ্রহ উল্লেখ করার মত।
ইসলামি ব্যাংকের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
নিম্নে ইসলামি ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
সুদমুক্ত লেনদেনের পরিবেশ সৃষ্টি: ইসলামি ব্যাংকের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী সুদমুক্ত লেনদেনের স্বার্থে। আল্লাহ পাক সুদকে সম্পূর্ণভাবে হারাম করেছেন। এমতাবস্থায় কোন মুসলমান সুদভিত্তিক লেনদেন করতেই পারে না। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকের অনুপস্থিতিতে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই একজন মুসলমানকে সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে হয়। ইসলামি ব্যাংক এই দুর্বিসহ অবস্থা থেকে মুসলমানদের মুক্তি দেয় এবং সুদমুক্ত লেনদেনের সুযোগ তৈরী করে।
স্বল্পবিত্তের লোকদের সুদমূক্ত ঋণ সুবিধা দান: সুদ ভিত্তিক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ সাধারণত সহায়ক জামানত ছাড়া ঋণ প্রদান করেনা। যার অর্থ হলো, যারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি অথবা কমপক্ষে জামানত দেয়ার মত যথেষ্ট স্থাবর সম্পত্তি আছে সেই-ই শুধু ঋণ পাওয়ার যোগ্য। এ ব্যবস্থায় স্বল্প বিত্তের মানুষ ঋণ পায়না। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেরও বেশীরভাগ মানুষ হয় বিত্তহীন নয়তো স্বল্পবিত্তের। ফলে সুদী ব্যাংকসমূহ থেকে তাদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য চাই জামানতবিহীন ঋণের নিশ্চয়তা। কেবল ইসলামি ব্যাংকই জামানতবিহীন সুদমুক্ত ঋণ/ লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম।
উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান: সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ঋণের মাধ্যমে শিল্প বা ব্যবসায়ে অর্থায়ন করা হলে যদি কোন কারণে লোকসান হয় তবে ব্যাংক সে লোকসানের দায় বহন করেনা। সম্পূর্ণ ক্ষতি বহন করতে হয় উদ্যোগী ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ী বা ফার্মকে। উদ্যোক্তা এক্ষেত্রে যুগপৎভাবে তিন ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
উদ্যোক্তা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় উদ্যোগ বা প্রয়াসের সুযোগ ব্যয় করে অর্থাৎ যে শ্রম বা প্ৰয়াস নিয়োজিত করার পর উদ্যোক্তা আলোচ্য লোকসানের সম্মুখীন হলেন তার সেই নিজস্ব শ্রম বা প্ৰয়াস অন্য কোন ফার্মের নিকট বিক্রি করলে অবশ্যই একটা দাম পেতেন। অন্য কথায়, উদ্যোক্তা অন্য কোথাও চাকুরী করলে প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট বেতন পেতেন কিন্তু সেই শ্রম লাভের আশায় নিজের প্রতিষ্ঠানে বিনা পারিশ্রমিকে বিনিয়োগ করেছেন। এখন যখন নিজের প্রতিষ্ঠানে লোকসান হলো, তখন উদ্যোক্তা না পেলেন লাভ না পেলেন বেতন।
আলোচ্যক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা তার শিল্প বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব যে পরিমাণ মূলধন নিয়োগ করেছিলেন, লোকসান হওয়ার ফলে তার উপর প্রত্যাশিত মুনাফা তো পাচেছনই না উপরন্তু পুরা কারবারের ক্ষতি তাকেই বহন করতে হচ্ছে যার অর্থ তার স্বনিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ কমে যাওয়া।
উদ্যোগ ও মূলধনের এই বিরাট ক্ষতির বোঝার উপর শাকের আঁটি হিসেবে এবার যোগ হয় সুদে অর্থলগ্নিকারী ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের সুদ বাবদ পাপ্য বিরাট অংকের টাকা যা কোন অবস্থাতেই মওকুফযোগ্য নয়।
No posts
বলা বাহুল্য, এ ধরনের ঋণদানব্যবস্থা নতুন পুরাতন সকল প্রকারের উদ্যোক্তাকেই নিরুৎসাহিত ও সর্বশান্ত করতে বাধ্য। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের জন্য এ ধরণের ঋণদানব্যবস্থা কোনক্রমেই উৎসাহব্যঞ্জক হতে পারেনা। একারণেই স্বাধীনতার তিন যুগের অধিক সময় পার হওয়ার পরও বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ অশিক্ষিত ও হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যুবক শিল্পোদ্যোগ গ্রহণে এগিয়ে আসেনি। এরফলে একদিকে দেশের শিল্পায়ন ব্যহত হয়েছে অন্যদিকে অগণিত উদ্যমী কর্মপ্রার্থী যুবক হয়ে গেছে বেকার, যা তাদের মধ্যে জন্ম দিয়েছে মাকে হতাশা, আর এ সর্বব্যাপী হতাশাই তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে সর্বনাশা নেশার কবলে কিংবা দাঁড় করিয়েছে রাস্তায় খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, মাস্তানী আর সন্ত্রাসের নিয়ামক হিসেবে।
ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা এ চরম হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা থেকে এ দেশে বাণিজ্যকে যেমন রক্ষা করতে পারে তেমনি হতাশাগ্রস্ত অথচ সম্ভাবনাময় এই বিরাট যুবসমাজকে দিতে পারে সম্মানজনক জীবিকা ও কাজের সন্ধান। কেননা ইসলামি ব্যাংকের মুদারাবা পদ্ধতিতে ব্যাংক যদি কোন উদ্যোগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা পরিচালনা বা শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ প্রদান করে তবে প্রকৃত লোকসানের সবটাই বহন করবে ব্যাংক। বিশেষকরে স্বল্পবিত্তের জামানতবিহীন সৎ, যোগ্য ও উদ্যমী নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য এ যে কতবড় সুসংবাদ তা বুঝতে কারো কষ্ট হবার কথা নয়। কেউ ভাবতে পারেন যে, এ ব্যবস্থায় উদ্যোগী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকান্ডের মাধ্যমে লোকসান ডেকে আনতে পারে কিংবা হিসাবপত্রে অসাধুতার আশ্রয় নিয়ে প্রকৃত লাভকে লোকসান দেখিয়ে ব্যাংকের বারোটা বাজাতে পারে? এ ধারণা মোটেই যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবভিত্তিক নয়। কারণ-
প্রথমতঃ প্রকৃত লোকসানে উদ্যোক্তার দায় না থাকলেও প্রকৃতলাভে তার অবশ্যই অংশ রয়েছে। সুতরাং অবহেলার মাধ্যমে নিজের লভ্যাংশ খুইয়ে দেয়া স্বাভাবিক আচরণ নয় ।
দ্বিতীয়তঃ আধুনিক হিসাব পদ্ধতি এতই জটিল ও স্বপ্রমাণিত যে, প্রকৃত লাভকে লোকসানে রূপান্তরিত করা খুবই কঠিন, বলা যায় অসম্ভব ব্যাপার।
তৃতীয়তঃ মুদারাবা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কারবার পরিচালনার মৌল নীতিমালা ও শর্তাবলীর বিষয়ে ইসলামি ব্যাংক ও মুদারিব ব্যক্তি বা সংগঠনের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি মুদারিব কর্তৃক যথাযথ অনুসৃত হচ্ছে কি-না তা তদারক করার জন্য ইসলামি ব্যাংক (ছাহেবে মাল) একটি মনিটরিং সেল গঠণ করে থাকে যার ফলে মুদারিবের পক্ষে চুক্তির শর্ত লংঘন করে বা এড়িয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে কারবারকে ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করানো খুব সহজ হবেনা। অন্যকথায়, উদ্যোক্তা কখনোই এককভাবে ব্যবসার ভাগ্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না।
অত্যাবশ্যকীয় উৎপাদন নিশ্চিত করা: সুদী ব্যবস্থায় উৎপাদকের পরিচালনা ব্যয়ের (operating cost) পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট আর্থিক ব্যয় (financial cost) ও থাকে। এ আর্থিক ব্যয় সাধারণত সুদের হারের সমান। ইসলামি বিনিয়োগ পদ্ধতিতে কোন নির্দিষ্ট ব্যয়ের বালাই নেই। যেমন, প্রচলিত ব্যবস্থায় সুদের হার যদি ১৫% হয়, তার অর্থ হচ্ছে উৎপাদককে সমুচচ বিন্দুতে পৌছার জন্য (break even point) তার উৎপাদন খরচের অতিরিক্ত কমপক্ষে ১৫% লাভ করতেই হবে। অন্যকথায় জাতীয় স্বার্থে একটি প্রকল্প যতই গুরুত্বপূর্ণ হোকনা কেন তা থেকে উপার্জনযোগ্য লাভের হার কমপক্ষে ১৫% না হলে সুদী ব্যবস্থায় সে প্রকল্পে বিনিয়োগের কোন সুযোগই নেই। বাংলাদেশের অনেকগুলি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানী কেন জীবন রক্ষাকারী ঔষধের চেয়ে কেবল অধিক লাভের জন্য জীবন সাজানোর প্রসাধনী সামগ্রী উৎপাদানে অধিকমাত্রায় ঝুঁকে পড়ছে তার যথার্থ ব্যাখ্যা হচ্ছে এ সুদী লগ্নী ব্যবস্থা। ১৩ কোটি মানুষের এ বাংলাদেশে জীবন সাজানোর চেয়ে জীবন বাঁচানোর সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অনেক বেশী প্রয়োজন। বলাই বাহুল্য, ইসলামি ব্যাংকব্যবস্থাই এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য কাংঙ্খিত সেই দ্রব্যাদির উৎপাদন নিশ্চিৎ করতে সক্ষম।
দেউলিয়াত্বের হাত থেকে ব্যাংকিং সেক্টরকে বাঁচানো: ব্যাংকিং ব্যবসাকে বলা হয় পরের ধনে পোদ্দারি। সে কারণেই ব্যাংক ব্যবসা শতকরা একশত ভাগ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। কোন ব্যাংকের উপর একবার মানুষের আস্থা বিনষ্ট হলে তা ফিরে পাওয়া খুবই কঠিন। আর কোন ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার অর্থ আমানতকারীদের চূড়ান্ত সর্বনাশ। সুদী ব্যাংকিং জগতে প্রায়শঃ এ দুর্ঘটনাটি ঘটছে। বাংলাদেশে বি.সি.আই এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বি.সি.আই.সি কেলেঙ্কারি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। এমনকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত পুজিবাদী রাষ্ট্রে ও প্রায় প্রতি বছরই শতাধিক ব্যাংকে দেউলিয়ার ঘটনা ঘটে। অথচ গত প্রায় তিন যুগের মধ্যে সমগ্র পৃথিবীতে কোন ইসলামি ব্যাংক দেউলিয়া গ্রন্থ হয়নি। কারণ, ইসলামি ব্যাংকের গঠন কাঠামোতে এমন উপাদান সন্নিবেশিত আছে যার ফলে একটি প্রকৃত ইসলামি ব্যাংক কখনো দেউলিয়া হতে পারেনা। ইসলামি ব্যাংকের ধাক্কা সামলাবার ক্ষমতা (shock absorbing capacity) সুদী ব্যাংকের তুলনায় অনেক অনেক বেশী। সাময়িকভাবে কোন ইসলামি ব্যাংকের আর্থিক লোকসান হতেও পারে। কিন্তু যেহেতু- ইসলামি ব্যাংকের সাথে আমানতকারীর সম্পর্ক মুনাফা বন্টন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই ব্যাংকের প্রকৃত ক্ষতি আমানতকারীকেই বহণ করতে হয়। অর্থাৎ, লোকসানের বেলায় ইসলামি ব্যাংককে আমানতকারীর আমানতের উপর কোন নির্দিষ্ট লাভ তো করতে হয়-ই না, উপরন্তু আনুপাতিকভাবে আমানতকারীর আমানত হ্রাস পায় । এভাবেই ইসলামি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা পায়। এদিক থেকে বিচার করলেও বাংলাদেশের মত অস্থিতিশীল অর্থনীতির একটি দেশে ইসলামি ব্যাংকই হতে পারে সর্বোত্তম পছন্দ।
ব্যাংক সৃষ্ট মুদ্রাস্ফিতি দুর করা: প্রচলিত সুদী ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যাংকসমূহ কম আমানত সৃষ্টি করে থাকে। একে ঋণসৃষ্টি বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। সুদভিত্তিক বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকের ন্যায় ক্রয় বিক্রয় করে না বরং ঋণদান করে। ব্যাংক যখন কোন মক্কেলকে ঋণদান করে তখন তাকে ঋণের অর্থ হাতে হাতে না দিয়ে দুতরফা দাখিলার নিয়মানুসারে ব্যাংকে রক্ষিত মক্কেলের হিসাবে মঞ্জুরকৃত ঋণের অর্থ জমা করে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকে (secondary deposit) মাধ্যমিক আমানতের সৃষ্টি হয়, ফলে ব্যাংকের মোট আমানতের পরিমাণ বেড়ে যায়। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদানক্ষমতা যেহেতু আমানতের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল তাই ঋণসৃষ্টির প্রক্রিয়া প্রবৃদ্ধি পাইলে কাজগুলো (fictitious) আমানতের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদানক্ষমতা ও বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, কোন সুদী ব্যাংকের প্রাথমিক আমানতের পরিমাণ ১ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনগত রিজার্ভ অনুপাত (legal reservse ratio) ৪%। এমতাবস্থায় ঐ বাণিজ্যিক ব্যাংকটি তার এক কোটি টাকার প্রকৃত আমানত থেকে ১০% বাদ দিয়ে সর্বাধিক ৯০ লাখ টাকা ঋণদান করতে পারবেন। এ টাকা মক্কেলকে সরাসরি নগদ টাকায় না দিয়ে ব্যাংকে রক্ষিত তার একাউন্টে জমা করার ফলে ব্যাংকের মাধ্যমিক আমানত (secondary deposit) সৃষ্টি ৯০ লাখ টাকা। এ ৯০ লাখ টাকা থেকে আইনগত রিজার্ভের অনুপাত ১০% (৯,০০০ টাকা) বাদ দিয়ে বাকী ৮১,০০০ টাকা ব্যাংক নতুন করে ঋণদান করতে পারবে। এ ভাবে সুদী বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রত্যেকটি ঋণদান নতুন আমানতের সৃষ্টি করতে থাকে এবং ব্যাংক ঋণের পরিমাণও বাড়তে থাকে। এ ধরণের কাগুজে (fictitious) ঋণদান অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় যা মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে, ইসলামি ব্যাংক অর্থের লগ্নি করেনা বরং পণ্যের কেনাবেচাই ইসলামি ব্যাংকের মূল ভিত্তি। এ ইসলামি বিনিয়োগ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি ত করেইনা বরং উল্টা মুদ্রাস্ফীতি দূর করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
অংশগহণমূলক আয়ন নিশ্চিৎ করা: ইসলামি ব্যাংক ঝুঁকিতে অংশগহণ করে মূলত উদ্যোক্তাকে শুধু উৎসাহিতই করেনা বরং ব্যাংক তার অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও তত্ত্বাবধান দিয়ে মক্কেলের ব্যাবসার সাফল্য নিশ্চিৎ করতে চায়। কারণ, ইসলামি বিনিয়োগ পদ্ধতিতে মক্কেলের ব্যবসার সাফল্য ও ব্যর্থতার সাথে ব্যাংকের স্বার্থও জড়ানো থাকে। একের সাফল্য অন্যকে উদ্বুদ্ধ করে আর এভাবেই জোয়ার আসে শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে।
জাতীয়ভাবে সঞ্চয় বৃদ্ধি: এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ অধিবাসী মুসলিম। ইসলাম সকল প্রকার সুদকে চূড়ান্তভাবে হারাম করেছে। আল-কুরআনে সুদখোরের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সঃ) এর পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হাদীস শরীফে সুদের আদান প্রদানকে নিজের মায়ের সাথে সত্তর বার ব্যভিচারের সমতুল্য গণ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবে খুবই ধর্মপ্রান বিধায় দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ সুদের ভয়ে কখনোই তাদের সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রাখেনা। কেবল অধিক সংখ্যায় ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এসব সঞ্চয় সংগ্রহ ও তা উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ করা সম্ভব।
ঈমানদার আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা: মুসলমানদের মধ্যে যারা সুদী ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন তাদের অনেকেই ধর্মীয় কারণে জমাকৃত অর্থের উপর সুদ গ্রহণ করেন না। যার অর্থ হলো, ক্ষুদ্র আমানতকারীগন তাদের ঈমান রক্ষার প্রয়োজনে আমানতের উপর ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হচেছন এবং এ অর্থ থেকে যাচেছ ব্যাংক মালিকের কাছে যে প্রকৃতপক্ষে এর হকদার নয়। এ ব্যবস্থা আমানতকারীদের নিরূৎসাহিত করতে বাধ্য। দেশে ইসলামি ব্যাংক কর্মরত থাকলে ক্ষুদ্র ঈমানদার আমানতকারীগণকে তাদের আমানতের উপর আয় থেকে বঞ্চিত হতে হয় না ।
উপসংহার
বাংলাদেশে প্রথমে যারা ইসলামি ব্যাংকের যাত্রা শুরু করেন তাদের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল, প্রশিক্ষিত জনশক্তি ও উপায় উপকরণের অভাব ছিল। তা সত্বেও গত দুই যুগের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং-এর অভিজ্ঞতায় সাফল্য ও সম্ভাবনার যে ইংঙ্গিত লক্ষ্য করা গেছে তাতে এ দাবি খুবই যুক্তিসঙ্গত যে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের সকল ব্যাংক ব্যবস্থাকেই ইসলামিকরণ করা উচিৎ।