কুরআন ও সুন্নাহ-তে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের আলোচনার পর নামাযের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। সেটা সময়মতো আদায় করা হোক, অথবা ওয়াক্তের পর কাযা করা হোক। বস্তুত শরী‘আতে ঈমানের পরেই নামাযের স্থান এবং নামায ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কেউ যদি কোনো কারণে সময়মতো নামায পড়তে না পারে তাহলে পরবর্তীতে তা কাযা করা জরুরি।
নিম্নে কুরআন-সুন্নাহ থেকে এ সম্পর্কিত দলীল উল্লেখ করা হলো:
(১) পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নিসার ১০৩ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا
‘নিঃসন্দেহে মুমিনদের প্রতি নামায অপরিহার্য রয়েছে, যার সময়-সীমা নির্ধারিত’।
এ আয়াতে নামাযের সময়-সীমা নির্ধারিত হওয়ার বিষয়টি যেমন বলা হয়েছে, তেমনি নির্ধারিত সময়ে নামায আদায় করা না হলে পরবর্তীতে উক্ত নামাযের কাযা আদায় করার বিষয়টিও পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে। কারণ এটা আল্লাহ তা‘আলার ঋণ, আর ঋণ সময়মতো আদায় না করতে পারলে পরবর্তীতে তা আদায় করা জরুরী। যেমন, সামনের হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে:
(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এক মহিলা নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে বললো, আমার মা মান্নত করেছিলেন যে, তিনি হজ্জ করবেন। কিন্তু তা পুরা করার আগেই তিনি মারা যান। (এখন আমার করণীয় কী?) নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে,
حُجِّي عَنْهَا، أَرَأَيْتِ لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ أَكُنْتِ قَاضِيَةً؟ اقْضُوا اللَّهَ فَاللَّهُ أَحَقُّ بِالوَفَاءِ»
‘তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ করে নাও। বলতো, যদি তোমার মা কারো নিকট ঋণী হতেন তুমি কি তার ঋণ পরিশোধ করতে? মহিলা বললো, হ্যাঁ। তখন প্রত্যুত্তরে নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে, তবে তোমরা আল্লাহর ঋণকেও পরিশোধ করো। কেননা তিনি তাঁর প্রাপ্য পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। (সহীহ বুখারী: ১/২৪৯, হা. নং ১৮৫২; নাসাঈ: ২/২, হা. নং ২৬৪৩)
এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা গেলো, যে ইবাদাত বান্দার উপর ফরয বা অবশ্য কর্তব্য, তা বান্দার উপর আল্লাহ তা‘আলার পাওনা বা ঋণ। এ ঋণ থেকে দায়মুক্তির পথ হলো, তা আদায় করা। যেমনিভাবে মানুষের পাওনা ঋণের নির্ধারিত সময় পার হওয়ার দ্বারা মানুষের ঋণ থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় না, তেমনি নির্ধারিত সময় পার হওয়ার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার ঋণ থেকেও দায়মুক্ত হওয়া যায় না। আর শরী‘আতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত নামাযের ক্ষেত্রে এ মূলনীতি যে পুরোপুরি প্রযোজ্য হবে, জ্ঞানী-মাত্রই তা বুঝতে সক্ষম হবেন।
(৩) একরাতে নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবীগণকে নিয়ে সফর করছিলেন। শেষরাতে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে সফর বিরতি দিলেন। হযরত বিলাল রা.কে ফজরের নামাযের জন্য জাগিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দিলেন। অতঃপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে হযরত বিলাল রা.-এর তন্দ্রা এসে গেলো। ফলে সবার ফজরের নামায কাযা হয়ে গেলো। নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুম থেকে জেগে সূর্য উঠার কিছুক্ষণ পর সবাইকে নিয়ে ফজরের নামায কাযা করলেন। এ বিষয়টিই অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ঘুম বা বিস্মৃতির কারণে যার নামায ছুটে গেলো, যখন সে জাগ্রত হবে তখন যেনো সে তা আদায় করে নেয়। (বুখারী হা.নং ৫৯৭, মুসলিম হা.নং ৬৮১)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, সেই দুই রাকা‘আত নামায যা নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাযা হিসেবে আদায় করেছেন, আমার নিকট তা সমগ্র দুনিয়ার মালিকানা লাভ করার চেয়েও অধিক পছন্দনীয়। (মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৮১, হা. নং ২৩৪৯; মুসনাদে আবী ইয়ালা: ৩/২২-২৩, হা. নং ২৩৭১)
(৪) খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরার দিন নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবীদেরকে বনূ কুরাইযা অভিমুখে পাঠানোর সময় বললেন,
لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ العَصْرَ إِلَّا فِي بَنِي قُرَيْظَةَ
‘তোমাদের কেউ যেনো বনী কুরাইযায় না পৌঁছে আসরের নামায না পড়ে’। (সহীহ বুখারী: ১/১২৯, হা.নং ৪১১৯, সহীহ মুসলিম: ২/৯৬, হা. নং ১৭৭০)
সাহাবায়ে কিরাম রা. রওনা হলেন। পথে আসরের নামাযের সময় অতিবাহিত হওয়ার উপক্রম হলে কতক সাহাবী পথেই সময়ের ভিতর আসর পড়ে নেন। আর কতক সাহাবী বনী কুরাইযায় পৌঁছার পর আসরের নামায কাযা পড়েন। নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ঘটনা শুনলেন। কিন্তু পরে কাযা আদায়কারীগণকে একথা বলেননি যে, নামায শুধুমাত্র নির্ধারিত সময়েই আদায়যোগ্য। সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এর কোনো কাযা নেই।
সুতরাং এ হাদীস থেকে পরিষ্কার বুঝা গেলো যে, কোনো কারণবশত নামায ওয়াক্ত-মতো না পড়তে পারলে সেই নামায অবশ্যই কাযা পড়তে হবে। এ কারণে যারা কাযা পড়েছিলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকেও সমর্থন করেছিলেন।
(৫) খন্দকের যুদ্ধের সময় স্বয়ং নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কয়েক ওয়াক্তের নামায কাযা হয়ে গিয়েছিলো। যুদ্ধের কারণে সময়মতো পড়া সম্ভব হয়নি। এ নামাযগুলি তিনি কাযা হিসেবে পড়ে নিয়েছিলেন। (বুখারী: ১/১৬২, ২/৩০৭, হা. নং ৪১১২)
(৬) এ প্রসঙ্গে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দলীল হলো, ইজমায়ে উম্মত। মুসলিম উম্মাহর সকল মুজতাহিদ ইমাম এ বিষয়ে একমত যে, ফরয নামায নির্ধারিত সময়ে আদায় করা না হলে সময়ের পরে তা কাযা করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে কাযা করা, বা ওযরবশত কাযা হয়ে যাওয়া উভয় প্রকারের বিধানই সমান।
যেমন, মালেকী মাযহাবের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. বিনা ওযরে অনাদায়কৃত নামায কাযা করা অপরিহার্য হওয়ার পক্ষে শরঈ প্রমাণাদি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
وَمِنَ الدَّلِيلِ عَلَى أَنَّ الصَّلَاةَ تُصَلَّى وَتُقْضَى بَعْدَ خُرُوجِ وَقْتِهَا كَالصَّائِمِ سَوَاءً وَإِنْ كَانَ إِجْمَاعُ الْأُمَّةِ الَّذِينَ أُمِرَ مَنْ شَذَّ مِنْهُمْ بِالرُّجُوعِ إِلَيْهِمْ وَتَرْكِ الْخُرُوجِ عَنْ سَبِيلِهِمْ يُغْنِي عن الدليل فِي ذَلِكَ (الاستذكار: 1/302)
ফরয রোযার মতো ফরয নামাযও সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে কাযাঃ
‘ফরয রোযার মতো ফরয নামাযও সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে কাযা করতে হয়। এ ব্যাপারে যদিও উম্মতের ইজমাই যথেষ্ট দলীল, যার অনুসরণ করা ঐসব বিচ্ছিন্ন মতের প্রবক্তাদের জন্যও অপরিহার্য ছিলো। তারপরও কিছু দলীল উল্লেখ করা হলো। যথা, নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীসমূহ….(আলইসতিযকার: ১/৩০২-৩০৩)
হাদীসের প্রত্যেক কিতাবে ‘বাবু কাযাইল ফাওয়ায়েত’ তথা ‘ছুটে যাওয়া নামায কাযা করার অধ্যায়’ নামে কাযা নামায পড়ার পদ্ধতির ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। কাযা নামায আদায় করা জরুরী হওয়ার বিষয়ে এটাও মজবুত প্রমাণ।
তাছাড়া, এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস ও সাহাবা কিরামের ফাতাওয়া রয়েছে। বেশি দীর্ঘ হওয়ার আশংকায় এখানে শুধুমাত্র একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর দ্বারাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কাযা নামায আদায় করা জরুরি। উম্মতের নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কিরামও এ বিষয়ে একমত।
তারপরও আমাদের কিছু দীনী ভাই যারা নিজেদেরকে ‘আহলুল হাদীস’ বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন, তারা কাযা নামায আদায়ের বিধানকে সহীহ হাদীসের খেলাফ মনে করেন এবং মুসলিম জনসাধারণকে কিছু হাদীসের বাহ্যিক অর্থ দ্বারা বিভ্রান্ত করে থাকেন। এ সম্পর্কে তারা যে-সব দলীল পেশ করে থাকেন সেগুলো নিম্নরূপ:
(১) নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَرَكَ الصَّلَاةَ فَقَدْ كَفَرَ»
‘যে ব্যক্তি নামায ছেড়ে দিলো সে কাফির হয়ে গেলো’। (সহীহ ইবনে হিব্বান: হা. নং ১৪৬৩, খ. ৪, পৃ. ৩২৩)
আর অপর এক হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
أَنَّ الْإِسْلَامَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ؟ وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا
‘ইসলাম গ্রহণ করলে অতীত গুনাহসমূহ আল্লাহ তা‘আলা মাফ করে দেন। অনুরূপভাবে, হিজরত করলেও হিজরতের পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’ (সহীহ মুসলিম হা. নং ১২১)
সুতরাং উল্লিখিত দুই হাদীসের আলোকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, নামায পরিত্যাগ করার কারণে মুসলমান কাফির হয়ে যায়। এখন পুনরায় মুসলমান হওয়া তার কর্তব্য। যখন সে পুনরায় মুসলমান হয়ে যাবে তখন তার কাযা নামায আদায় করার প্রয়োজন নেই। কারণ মুসলমান হওয়ার দ্বারা আগের সব গুনাহ মাফ হয়ে গেছে। সংক্ষেপে এই হচ্ছে আহলে হাদীস ভাইদের অভিমত।
অথচ নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত কোনো ইমাম বা হাদীস ব্যাখ্যাকারী এ হাদীস দু’টির এরূপ ব্যাখ্যা করেন নি। একমাত্র আহলুল হাদীস ভাইয়েরাই এ ব্যাখ্যা করেছেন। উল্লিখিত উভয় হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
প্রথম হাদীসের ব্যাখ্যা: যে ব্যক্তি নামায পরিত্যাগ করলো তার এ কাজটি এমন যেনো কাফিরদের কাজের মতো হলো। কিন্তু লোকটি এর দ্বারা কাফির হবে না।
দ্বিতীয় হাদীসের ব্যাখ্যা: কোনো অমুসলিম মুসলমান হলে আল্লাহ তা‘আলা মেহেরবানী করে তার অতীত গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু কোনো ইমাম এই অর্থ করেননি যে, কোনো মুসলমান নামায ত্যাগ করে কাফির হয়ে পুনরায় মুসলমান হলে তার পিছনের কাযা নামায পড়া লাগবে না। বরং পূর্বোল্লিখিত আয়াত, হাদীস ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, উমরী কাযা নামায আদায় করা তেমনি ফরযে আইন, যেমনটি সময়মতো আদায় করা ফরযে আইন।
তথ্য সূত্র
- তুহফাতুল হাদীস • লেখক: মুফতী মনসূরুল হক