▶ প্রশ্ন: শিক্ষায় মুসলমানদের অবদান আলোচনা করুন। ▶ বিষয়: IST-512 : Muslim Contribution to Science and Technology ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
শিক্ষার প্রতি ইসলাম সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। পবিত্র কুরআন ও হাদীস থেকে শিক্ষার অনুপ্রেরণা পেয়ে মুসলিম জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় এবং শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বিস্তারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। মুসলিমগণ সমগ্র বিশ্বের আলোকবর্তিকারূপে আবির্ভূত হয়ে শিক্ষা বিস্তার ও উন্নয়নের জন্য যে সব বাস্তব, কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার বিবরণ বিশদ আকারের।
মহানবীর (স) পদক্ষেপ
শিক্ষায় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে সকল অবদান রেখেছেন তা অনবদ্য। নিম্নে সেগুলোর উল্লেখযোগ্য কিছু আলোচনা করা হলো-
গৃহকে শিক্ষালয় ঘোষণা
হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবুওত লাভের পর থেকে তাঁর গৃহকে শিক্ষাগার হিসেবে প্রস্তুত করেন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে লোকদের শিক্ষা দিতেন। তাঁর স্ত্রী খাদীজা (রা) আজীবন শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তাঁর ইনতিকালের পর মদীনায় তাঁর স্ত্রীদের গৃহ নারীদের শিক্ষা দানের জন্য ছিল উন্মুক্ত। হযরত আয়িশা (রা), হাফসা (রা) ও উম্মে সালমা (রা) নারীদের মাঝে শিক্ষা দান কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
নবুয়ত লাভের প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কায় নিরিবিলি স্থানে অবস্থিত হযরত আরকাম (রা)-এর বাড়িকে (দারুল আরকাম) একটি শিক্ষায়তনে পরিণত করেন। এখানে মুসলিমগণ একত্রিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। যারা নতুন মুসলমান হত, তারা গোপনে এসে এখানে শিক্ষা গ্রহণ করতেন।
গোত্রে গোত্রে শিক্ষায়তন
নতুন কোন গোত্রের লোক ইসলাম গ্রহণ করলে, তাদের শিক্ষা দানের জন্য অভিজ্ঞ সাহাবীদেরকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হত। এভাবে গোত্রে গোত্রে বিভিন্ন সাহাবীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষায়তন গড়ে উঠতে থাকে।
শিক্ষার মহাকেন্দ্র স্থাপন
হিজরতের পর মদীনায় মসজিদে নববী শিক্ষার মহাকেন্দ্রের রূপ লাভ করে। মসজিদে নববীর প্রাঙ্গণে ‘সুফফা’ নামে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ও গড়ে তোলা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের বহু মানুষ এখানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য আসতেন। অনেক সাহাবী ‘সুফফা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন আবাসিক ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকায় ছিলেন। তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা মুসলমানদের দানে ও বাইতুল মালের ভাণ্ডার থেকে দেয়া হত। কূফা, বসরা, সিরিয়া, মিসর, রোম, পারস্য প্রভৃতি স্থান থেকে আগত শিক্ষার্থীরা মদীনায় এসে ভীড় জমাতেন।
মুক্তিপণ হিসেবে শিক্ষা
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও শিক্ষা বিস্তারে এত গুরুত্ব দিতেন যে, বদরের শিক্ষিত যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করেছিলেন— কয়েকজন নিরক্ষর মুসলিমকে শিক্ষা দান করার মাধ্যমে।
খুলাফায়ে রাশেদীনের পদক্ষেপ
ইসলামের প্রাথমিক যুগে শিক্ষা বিস্তার ও উন্নয়নে খুলাফায়ে রাশেদূনের চার খলীফা অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষা বিস্তার ও প্রসারে তাঁদের অবদান হচ্ছে-
মহানবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুগে কুরআন নাযিল হওয়ার কারণে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কুরআনকে একত্রে গ্রন্থাবদ্ধ করে যেতে পারেননি। পবিত্র কুরআনকে একত্রে গ্রন্থাকারে সংকলনের মহান দায়িত্ব পালন করেন প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা)। তিনি হযরত উমরের (রা) পরামর্শে ও সাহাবায়ে কিরামের সহযোগিতায় এ মহতী কাজ সম্পাদন করেন। আর পরবর্তীতে হযরত ওসমান (রা) একই পঠনরীতিতে কুরআনের সংকলন করেন।
হযরত আবু বকরের (রা) আমলে মসজিদে নববী ছিল প্রধান শিক্ষা কেন্দ্র। তাছাড়াও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে তিনি সাহাবীদের তত্ত্বাবধানে বহু শিক্ষায়তন গড়ে তুলেছিলেন।
খুলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে শিক্ষা বিস্তারের জন্যও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কোথাও সেনাবাহিনী প্রেরণের সময় সেনাপ্রধান নিয়োগ করা হত- শিক্ষিত অভিজ্ঞ নিষ্ঠাবান ব্যক্তিকে। তাঁরা বিজিত অঞ্চলে শিক্ষা দানে ব্যাপৃত হতেন।
হযরত ওমর (রা) রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসাধারণকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষা দানের জন্য উপযুক্ত উস্তাদ নিয়োগ করতেন এবং বাইতুলমাল থেকে তাদের বেতন-ভাতা দিতেন।
বাস্তুহারা অনগ্রসর বেদুইনদের জন্য হযরত ওমর (রা) কুরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। একাজে আবূ সুফিয়ান নামক এক সাহাবীকে নিযুক্ত করেন। কেউ কুরআন পড়তে না পারলে শাস্তি দেয়া হত। এভাবে রাষ্ট্রীয় পোষকতায় শিক্ষার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
উমাইয়া খলীফাদের পদক্ষেপ
উমাইয়া আমলে সাহাবায়ে কিরামের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিস্তারের কাজ গুরুত্ব সহকারে চলতে থাকে। তাদের আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি সাধিত হয়। যেমন-
- রাষ্ট্রীয়ভাবে হাদীস সংকলন: উমাইয়া খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীযের সময়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় হাদীস সংকলনের কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পাদন করা হয়। এসময় হাদীস শিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতি হয়। হাদীসের বহু সংকলন এসময় রচিত হয়।
- শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন: সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে হাদীস চর্চা ও শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী এসব শিক্ষাকেন্দ্রে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষা গ্রহণ করে। দামেস্ক, কূফা, বসরা, মক্কা, মদীনা প্রভৃতি অঞ্চলে শিক্ষা কেন্দ্রগুলো ছিল খুবই বিশাল। সেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা লাভের জন্য বিশ্বের দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসত।
- ফিকহ সম্পাদনা: উমাইয়া খিলাফত আমলে ফিক্হ চর্চা ও সম্পাদনার কাজ সুচারুরূপে চলতে থাকে। এসময়ে ইসলামের ধর্মীয় আইন-কানুন প্রণীত হয়। এবং বিধিবদ্ধ মাযহাব সৃষ্টি হয়।
- বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা: উমাইয়া খলীফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অনেক উন্নতি সাধিত হয়। খলীফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক বই পুস্তক আরবীতে অনূদিত হয়। জ্যোতির্বিদ্যা, ক্ষেত্র তত্ত্ব, চিকিৎসা, বীজগণিত, নৌ-চালনা, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ের উন্নতির সূচনা করে উমাইয়া শাসকগণ।
আব্বাসীয় খলীফাদের অবদান
আব্বাসীয় যুগকে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণ যুগ বলা হয়। শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায়ই তাদের অবদানে সমৃদ্ধ। আব্বাসীয় আমলে সাম্রাজ্যের সকল অঞ্চলে অসংখ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় । বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোভায় উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হত। শিক্ষাকে সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য এসময়ে অনেক পাঠাগার স্থাপন করা হয়। পাঠাগারসমূহে বইয়ের সংখ্যা ছিল অগণিত। পাঠাগারে থাকত গবেষণা বিভাগ, অনুবাদ বিভাগ।
খলীফা আল-মামুনের সময় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গভীর গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় মান-মন্দির। ‘বায়তুল হিকমা’ নামে এ মান-মন্দির ছিল ইতিহাস বিখ্যাত । এটি একটি শিক্ষা সংস্থা ছিল। এতে লাইব্রেরিও ছিল। ইসলাম বিষয়ক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন- হাদীস, তাফসীর, ফিক্হ, আকাইদ প্রভৃতি বিষয়সমূহের চর্চা ও গবেষণা ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। এসব বিষয়ে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। ফিক্হকে বিধিবদ্ধ শাস্ত্র হিসেবে এ সময়েই সম্পাদনা করা হয়। সিহাহ সিত্তাহর হাদীসসমূহ সংকলন করা হয়।
আব্বাসীয় যুগে সাহিত্য কলা ও সংস্কৃতির বিপুল উৎকর্ষ সাধিত হয়। ভাষাতত্ত্ব, অলংকার, উপন্যাস, কবিতা প্রভৃতি সাহিত্যকলা চরম উন্নতি লাভ করে। প্রাচীন আরবী কবিতাসমূহ পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে এ যুগের মনীষী ও পণ্ডিতদের সৃজনশীল অবদান আধুনিককালেও বিস্ময়কর বলে মনে হয়। এ যুগে চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত শাস্ত্র, রসায়ন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়।
খলীফাদের মধ্যে আল মানসূর, হারুন-অর-রশীদ, আল মামুনের রাজত্বকাল স্বর্ণালী আভায় চিরভাস্বর হয়ে আছে। এঁদের সময়কালকে আব্বাসীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ বলা হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে খলীফা হারুন-অর রশীদের অবদান অসামান্য। বায়তুল হিকমা, দারুল ইল্ম বা মিজানুল হিকমা নামে বিশাল বিজ্ঞান গবেষণাগার তাঁর সময়ের সবচেয়ে বড় অবদান।
খলীফা আল মামুনের শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবদান সবচেয়ে বেশি। তাঁর সময়ে ‘বায়তুল হিকমা’ পূর্ণতা লাভ করে। তিনি রাষ্ট্রের সর্বত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে লাখেরাজ জমি দান করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল স্বায়ত্তশাসিত।
উপসংহার
ইসলাম ও মুসলমানগণের শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান অপরিসীম। শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণেও তারা এনেছিল অভূতপূর্ব জাগরণ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে তাই বিশ্বের অগ্রদূত বলা হয়ে থাকে।
সম্ভাব্য প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ (এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ)
• IST-507 : Study of Al-Hadith (Al-Mishkat Al-Masabih: Al-Iman, AlILM and Al-Salat (Selected Hadith) • IST-508 : Principles and History of Hadith literature • IST-509 : Muslim Personal Law and Law of Inheritance in Islam • IST-510 : Banking and Insurance in Islam • IST-511 : Study of Religions (Islam, Buddhism, Hinduism, Judaism, Christianity) • IST-512 : Muslim Contribution to science and technology •