পানি পান করা নিয়ে একটি ভুল ধারণা
অতিরিক্ত-পানি-পান-করার-অপকারিতা | প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করা প্রয়োজন? | পানি পানের সাধারণ কিছু নিয়ম | পানি নিয়ে কয়েকটি চমকপ্রদ ও মজার তথ্য | পানি পান করার সুন্নাত
ছোট বেলার একটি ঘটনা। ৮-৯ বছর বয়স হবে তখন। বিকেল বেলা খেলতে গিয়ে প্রায়ই আমরা বাজি ধরতাম এক কল (টিউবওয়েল) পানি কে খেতে (পান করতে) পারবে। অর্থাৎ টিউবওয়েলের মুখ ধরে রেখে হাতল ধরে চাপ দিতে থাকবে। পুরো টিউবওয়েলটি পানিতে ভরে উপচে পড়লে এটাকে বলা হবে এক কল। এই এক কল পানি কে কে খেতে (পান করা) পারে এটা নিয়ে আমাদের মাঝে প্রতিযোগিতা হতো। বিশেষ করে গরমের দিনে যখন রোদে খেলতে যেতাম। তখন এই প্রতিযোগিতাটা হতো বেশি। প্রচন্ড গরমে অনেক তৃষ্ণার্থ থাকতাম। সেই সাথে বাজি ধরা। সেই জন্য মোটামুটি সবাই এক কল পানি খেতো। এক কল পানি খেলে আমাদের ওই বয়সে পুরোপুরিভাবে পেট ভরে যেতো। এমনকি অনেক সময় খাওয়ার পর হাটতে কষ্ট হতো।
একটু বড় হয়ে আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে শুনি পানি শরীরের জন্য খুবই ভালো। এর কোন ক্ষতিকর দিক নেই। পানির অপর নাম জীবন। পানি যতো বেশি পান করা যায় ততই ভালো। তাহলে প্রশ্ন আসে, পানি যেহেতু ভালো জিনিস সেহেতু অনেক বেশি বা অতিরিক্ত পানি পানে কি কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই? অতিরিক্ত পানি পান করাতে শারীরিক কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা নেই?
কিছুদিন আগে এই প্রশ্নগুলো আমার মনে উদ্রেক হয়। এর আগে এতো বছর এটাই জানতাম যে, পানি যতো বেশি পান করা যায় ততোই ভালো। এতে ক্ষতির কোন সম্ভবনা নেই।
এই লেখায় আমি পানি পান করা নিয়ে আমাদের মাঝে প্রচলিত ভুল ধারণা, পানি পান করার সঠিক নিয়ম ও পরিমাণ, বেশি পানি পানের অপকারিতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি।
অতিরিক্ত পানি পান করার অপকারিতা
বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণ পানি পান করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। অতিরিক্ত পরিমাণ পানি পান করার জন্য বলেননি। অতিরিক্ত পরিমাণ পানি পান করা শারীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত পানি পানের ফলে যে সমস্যাগুলো তৈরি হতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হলো-
- ভমি ভমি ভাব হওয়া অথবা বমি হওয়া
- মাথা ধরা বা মাথা ব্যাথা হওয়া
- পেশির দুর্বলতা, শারীরিক দুর্বলতা
- শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তি অনুভব করা
- খিঁচুনি
- জ্ঞান হারিয়ে ফেলা
একজন মানুষ যতটুকু পানি পান করেন তা আমাদের কিডনি পরিশোধন করে। পরিশোধনের পর তা শরীরের বিভিন্ন কাজে লাগে। অতিরিক্ত পানি পান করলে কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। কিডনির স্বাভাবিক কাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যার ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সেই সাথে বেশি পরিমাণ পানি পান করায় শরীরে পানি এবং সোডিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করা প্রয়োজন?
বয়স, লিঙ্গ এবং অবস্থার কারণে শরীরের পানির প্রয়োজনীয়তার পরিমাণে তারতম্য ঘটে। যেমন মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের শরীরে পানির পরিমাণ বেশি লাগে। তাছাড়া দিনের বেলায় তাপমাত্রা বেশি থাকলে, এমনকি গরমের দিনে স্বাভাবিকভাবেই পানির প্রয়োজন হয় বেশি। সেই সাথে যারা শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন তাদেরও বেশি পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। ছকের বর্ণনায় বয়স অনুযায়ী প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করা প্রয়োজন তা জেনে নিতে পারেন।
বয়স | পানির পরিমাণ (লিটারে) | পানির পরিমাণ (গ্লাসে) |
০১-০৩ বছর | ১.৩ লিটার | ০৬ গ্লাস |
০৪-০৮ বছর | ১.৭ লিটার | ০৭ গ্লাস |
০৯-১৩ বছর | ||
ছেলে | ২.৪ লিটার | ১২ গ্লাস |
মেয়ে | ২.১ লিটার | ১১ গ্লাস |
১৪-১৮ বছর | ||
ছেলে | ৩.৩ লিটার | ১৬ গ্লাস |
মেয়ে | ২.৩ লিটার | ১১ গ্লাস |
১৮-৭০+ বছর | ||
পুরুষ | ৩.৭ লিটার | ১৮ গ্লাস |
মহিলা | ২.৭ লিটার | ১৩ গ্লাস |
বয়স ভেদে প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করবেন, ছকটি প্রিন্ট করার উপযোগী পিডিএফ এবং ইমেজ আকারে ডাউনলোড করে নিতে পারেন। পিডিএফ ডাউনলোড করুন | ছবি/ইমেজ ডাউনলোড করুন।
পানি পানের সাধারণ কিছু নিয়ম
- অনেকেই কিছুক্ষণ পরপর পানি পান করেন। অযথা কিছুক্ষণ পরপরই পানি পানের কোন প্রয়োজন নেই। পিপাসা লাগলে পানি পান করুন। শরীরে পানির প্রয়োজন অনুভূত হলে পানি পান করুন। এছাড়া প্রসাবের রং দেখে পানি পান করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।
- কোন কিছু খাবার পর আমরা পানি পান করে থাকি। সে পানি পান করে শেষের দিকে একটু পানি মুখে নিয়ে কুলির মতো করে মুখ পরিস্কার করে পানি টুকু গিলে নিন। এতে মুখের ভিতরে ও দাঁতের ফাঁকে লেগে থাকা খাবারের কণাগুলো পেটের ভিতরে চলে যাবে।
- পানি পান করার এর দিকে মনোযোগ দিন। পানি পান করার সময় কথা বলা বা অন্য কো কিছু করা থেকে বিরত থাকুন। পুর্ণ মনোযোগ দিয়ে পান করুন।
- পরিস্কার গ্লাসে করে পানি পান করার অভ্যাস করুন। কাঁচের গ্লাস ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে পানি পানে মনোযোগ বাড়বে।
- একসাথে অনেক বেশি পানি পান করা থেকে বিরত থাকুন।
- দাঁড়িয়ে, শুয়ে, কাত হয়ে পানি পান করবেন না। বসে পানি পান করার চেষ্টা করুন এবং বসে পান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- অবশ্যই আপনার পানিটুকু বিশুদ্ধ কিনা নিশ্চিত হয়ে তারপরই পান করুন।
পানি নিয়ে কয়েকটি চমকপ্রদ ও মজার তথ্য
- মানুষের মস্তিষ্কের ৭৫% পানি।
- একটি জীবন্ত গাছের ৭৫%-ই পানি।
- একজন ব্যক্তি খাবার ছাড়া প্রায় একমাস বেঁচে থাকতে পারেন। কিন্তু পানি ছাড়া বাঁচতে পারবেন মাত্র এক সপ্তাহ।
- পানি দুটি উপাদান হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন নিয়ে গঠিত। 2 হাইড্রোজেন + 1 অক্সিজেন = H2O।
- বিশ্বের প্রায় ৯৭% পানি হলো লোনা পানি। এর মধ্যে ২% বরফ এবং হিমবাহে ঢাকা। আর মাত্র ১% মানুষ তার প্রয়োজনে ব্যবহার করে।
- পানি পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
- পানি মানবদেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, কোষগুলিতে পুষ্টি এবং অক্সিজেন বহন করে। জয়েন্ট এবং টিস্যুগুলিকে সুরক্ষা দেয় এবং শরীরের বর্জ্য অপসারণ করে।
- বরফ পানির চেয়ে হালকা। তাই বরফ পানিতে ভেসে থাকে।
- পৃথিবী যখন তৈরি হয়েছিল, তখন পৃথিবীর সমপরিমাণ পানি পৃথিবীতে ছিল।
- আধা লিটার (এক পিন্ট) বিয়ার তৈরিতে ২০ গ্যালন পানি ব্যবহৃত হয়।
- পৃথিবীতে প্রায় ৭৮০ মিলিয়ন মানুষ বিশদ্ধ পানি বঞ্চিত।
- পৃথিবীতে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২০০ শিশু মারা যায় অনিরাপদ পানির কারণে।
- একটি শশার ৭৫% হালো পানি।
- বিশ্বের প্রায় ৮০% রোগ পানি ঘটিত।
- এক টন স্টীল তৈরিতে ৩০০ টন পানির প্রয়োজন হয়।
- যদি পুরো পৃথিবীর পানিতে একটি ৪লিটারের জগে ভরা হয়, তাহলে সেখান থেকে মাত্র এক টেবিল চামচ পরিমান খাওয়ার পানি পাওয়া যাবে।
- বায়ুমন্ডলে যে পরিমান পানি রয়েছে তা পৃথিবীর সমস্ত নদীগুলোর চেয়েও বেশি।
- একটি নতুন গাড়ি তৈরি করতে প্রায় ৪০,০০০ গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়।
পানি পান করার সুন্নাত
জীবনধারণে মানুষের পানি পান করা আবশ্যক। যেমন আবশ্যক, বেঁচে থাকার জন্য খাবার। জীবন বাঁচাতে পানির বিকল্প নেই। মানুষের জন্য পানি পানে রয়েছে কিছু ইসলামি নিয়ম ও পদ্ধতি। মানুষকে প্রতিদিন অনেকবার পানি পান করতে হয়। যদিও কাজটি খুবই ছোট। আমরা অনেকেই এটি খুব গুরুত্বের সাথে দেখি না। পানি পানের সময় মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুনির্দিষ্ট কিছু আমল করতেন। পানি পানের সুন্নত হচ্ছে ৬টি। এই তরীকাগুলো মেনে পানি পান করলে পানি পান করাও হবে। গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নতও আদায় হবে।
- পানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা। শুধু পানি পানের সময়ই নয়, বরং যে কোনো কিছু খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হয়। এমনকি সব ভালো কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হয়। নিঃসন্দেহে পানি পান করা একটি ভালো কাজ।
- ডান হাতে পানি নিয়ে পান করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কখনো খাবার এবং পানীয় বাম হাতে গ্রহণ করবে না। কেননা শয়তান বাম হাতে খাবার গ্রহণ করে।’ (মুসলিম)। বাম হাতে খাবার খাওয়া ও পানি পান করা শয়তানের কাজ। অনেকেরই জন্মগতভাবে বাম হাত ব্যবহারের অভ্যাস রয়েছে। চেষ্টা করবেন ডান হাত ব্যবহার করার জন্য। কারণ বাম হাত ব্যবহার শয়তানে কাজ। ‘বিসমিল্লাহ’ বলার মতো সব ভালো কাজে ডান হাত ব্যবহার করা উত্তম। পোশাক পরার সময় প্রথমে ডান দিক থেকে শুরু করা।
- বসে পানি পান করা। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (আগে) বসুন এবং পানি করুন। স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বলা হয়েছে, বসে পানি পান করার জন্য। দাঁড়িয়ে পানি পান করার চেয়ে বসে পান করা বেশি ভালো।
- তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কখনো এক নিঃশ্বাসে পানি পান করোনা। বরং তোমরা দুই কিংবা তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করো। অনেকেই আছেন যারা এক নিশ্বাসেই প্রয়োজনীয় পানি পান কেরে নেন। আর বিশেষ করে যারা বোতল ব্যবহার করে পানি পান করেন, তাদেরও তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করা হয় না। তাই গ্লাস ব্যবহার অনেক শ্রেয়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানেও বলা হয়েছে, পানের সময় অল্প অল্প করে ২/৩ বারে পানি পান করা।
- গ্লাসের পানিতে বা গ্লাসে নিঃশ্বাস না ছাড়া। হাদিসে ‘পানি পান কিংবা খাবার গ্রহণের সময় মুখ থেকে পানি কিংবা খাবারে নিঃশ্বাস না ছাড়ার জন্য বলা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানে বলা হয়েছে যে, মুখে বা মুখের সামনে ব্যাকটেরিয়া বা জীবানু থাকতে পারে। পানি বা খাবারে ফুঁ দেয়া বা নিঃশ্বাস ফেলানোর ফলে এ জীবানু পানি ও খাবারের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। আর এই জীবাণু মানুষের শরীরের বিভিন্ন ধরণের রোগ সৃষ্টি করে।
- পানি পান শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা। পানি পানের পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় স্বরূপ সবসময় ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা। পানি, আল্লাহর অনেক বড় একটি নেয়ামত। তাই এই নেয়ামত গ্রহণ করে শুকরিয়া আদায় করা জরুরী।
তথ্য সূত্রসমূহ | References
- https://www.epa.gov/
- https://www.seametrics.com/blog/water-facts/
- https://science.howstuffworks.com/environmental/earth/geophysics/run-out-of-water.htm
- https://www.unwater.org/water-facts/
- https://www.treehugger.com/eye-opening-facts-about-water-4858731
- https://www.water-for-health.co.uk/
- https://www.healthline.com/health/food-nutrition/why-is-water-important