Thursday, June 27, 2024
Homeশিক্ষাবদর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা করুন

বদর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা করুন

প্রশ্ন: বদর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা করুনবিষয়: (IST-503) Al-Sirat Al-Nababiahকোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)



ভূমিকা

ইসলামের ইতিহাসে বদর যুদ্ধ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটাই মুসলমান আর অবিশ্বাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম সামরিক সংঘর্ষ। মক্কার কুরাইশ ও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মধ্যে ৬২৪ খ্রি. মোতাবেক দ্বিতীয় হিজরিতে মদিনার অদূরে ‘বদর’ নামক প্রান্তরে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে মহানবী (সাঃ) ও মুসলিম বাহিনী অভাবনীয়ভাবে বিজয় লাভ করে এবং কুরাইশ বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। এ যুদ্ধের ফলে প্রমাণিত হয় ইসলাম হল সত্য এবং অজেয়। আর মক্কার মুশরিকরা যে ভ্রান্ত তা প্রমাণিত হয়।

বদর যুদ্ধের কারণ

বদর যুদ্ধের প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ:

  • ইসলামের অগ্রযাত্রায় কুরাইশদের জ্বালাতন: হিজরতের পর মুহাম্মদ (স) মদিনায় একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেন। মহানবী (স) এর ক্রমবর্ধিষ্ণু ক্ষমতা ও ইসলামের অগ্রযাত্রায় কুরাইশদের মনে ঈর্ষা ও শত্রুতার উদ্রেক হয়। তারা উদীয়মান এ রাষ্ট্র এবং এর মহান নায়ককে ধ্বংস করার শপথ করে। বদরের যুদ্ধ এরই ফলশ্র্রুতি।
  • মদিনাবাসীদের উপর কুরাইশদের আক্রোশ: হযরত মুহাম্মদ (স) ও তাঁর সাথীদের মদিনাতে আশ্রয় দেয়ার কারণে মদিনাবাসীদের ওপর কুরাইশরা ক্ষেপে যায়। জন্মভূমি মক্কা হতে হযরতকে বিতাড়িত করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। তাঁকে এবং নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য তাঁরা ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।

আরো পড়তে পারেন: মহানবী (সা.)-এর মিরাজের ঘটনা ও ইসলামে এর তাৎপর্য বর্ণনা করুন


  • মুনাফিক আন্দুল্লাহ বিন উবাইর ষড়যন্ত্র: মহানবীর (সা:)-এর নেতৃত্ব খর্ব করার জন্য মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই গোপনে কুরাইশদের সাথে ষড়যন্ত্র করে। কারণ, তার মদিনার শাসক হবার আকাঙ্খা ছিল। কিন্ত নবীর আগমনে তা সম্ভব হয়নি।
  • মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র: মুনাফিক শ্রেণী ইহুদীদের সাথে গোপনে ষড়যন্ত্র করে এবং মহানবীর (সাঃ) তথা ইসলামের ধ্বংস সাধনের জন্য কুরাইশদের সাথে গভীর ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়।
  • ইহুদীদের ষড়যন্ত্র: মদিনায় হযরত (স)-এর ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি ইহুদিগণ সহ্য করতে পারেনি। মদিনা সনদের কথা ভুলে গিয়ে ধর্মীয় এবং নাগরিক স্বাধীনতার সত্ত্বেও তারা মহানবীর (সাঃ) বিনাশ সাধনে তৎপর হয়ে ওঠে। তারা মদিনায় মুসলামানদের গোপন সংবাদসমূহ মক্কার কাফিরদের কাছে সরবরাহ করে মদিনা আক্রমনের জন্য প্ররোচিত করতে থাকে।
  • মদিনা সনদের শর্তভঙ্গ: মুনাফিক গোষ্ঠী ও বিশ্বাসঘাতক ইহুদীরা মদিনা সনদের চুক্তির বরখেলাপ করে গোপনে সারা মদিনায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করে রেখেছিল। তারা মহানবীর (স) মহানুভবতা ও উদারতার সুযোগে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তৎপর হয়ে উঠে।
  • অর্থনৈতিক কারণ: নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ হারাতে পারে এ আশংকায় কুরাইশরা যুদ্ধের প্রস্ততি গ্রহণ করতে থাকে। ব্যবসায় ও তীর্থযাত্রা বন্ধ হলে কুরাইশরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে ভেবে ইসলামের মূলোৎপাটনে বাণিজ্যের অজুহাতে এক কাফেলা নিয়ে সিরিয়া যায়। সেখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার দিনার মূল্যের ধন-রত্ন এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করে দেশে প্রত্যাবর্তন করার পথে মুসলমানদের আক্রমনের ভয়ে মক্কায় সাহায্য চেয়ে পাঠায়। আবু জেহেল এক হাজার সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমনের জন্য রওয়ানা হয়।
  • দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ: মক্কার বাণিজ্য পথে বসবাসকারী বিভিন্ন আরব গোত্র কুরাইশদের পক্ষে কাজ করত এবং মহানবীর (স) বিরোধিতা করত। মদিনার সীমান্তবর্তী এলাকায় কুরাইশগণ ও তাদের সাহায্যকারী আরব গোত্র মুসলমানদের শস্যক্ষেত, ফলবান গাছপালা, উট, ছাগল লুট করে নিত এবং জ্বালিয়ে দিত, ধ্বংস করত এবং অপহরণ করত। সুতরাং মহানবীর (স) এ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
  • নাখলার খন্ডযুদ্ধ: কুরাইশদের ক্রমবর্ধমান লুটতরাজ ও অত্যাচার বন্ধ করার জন্য মহানবীর (স) আব্দুল্লাহ ইবন জাহাশের নেতৃত্বে ১২ জনের একটি টহলদার বাহিনী মক্কায় প্রেরণ করেন। হযরতের নির্দেশ ছিল শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ রাখা। কিন্ত সেখানে কুরাইশ দলের সাথে তাদের খন্ড বাঁধে। এই নাখলার খন্ডযুদ্ধকে বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।

আরো পড়তে পারেন: হিজরত বলতে কী বোঝায়? হিজরতের কারণ ও গুরুত্ব আলোচনা করুন


  • ইসলাম ও মহানবী (স)-কে নির্মূলের বাসনা: মক্কার কুরাইশরা ইসলাম ও তার মহান নায়ক মুহাম্মদ (স) কে নির্মূলের বাসনা পোষণ করত অহর্নিশ। ইসলামের অনির্বাণ দ্বীপ শিখাকে এক ফুঁৎকারে নিভিয়ে দেয়ার মানসেই তারা মদিনা আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়। আর মহানবী (স) আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হলে চুড়ান্ত সংঘর্ষ বাঁধে।
  • ওহীর নির্দেশ: মক্কার কুরাইশদের সমরাভিযানে হযরত (স) যখন খুবই বিচলিত; এমন অবস্থায় মহান আল্লাহ তায়ালা মহানবীর (স) কাছে প্রত্যাদেশ পাঠিয়ে দেন- ‘আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর’ যারা তোমার সাথে যুদ্ধ করে। তবে সীমালঙ্গন করো না, (আল-কুর‘আন ২:১৯০)

বদর যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব

বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের বিজয়ের গৌরব সূচনাকারী বদর ‍যুদ্ধের গুরুত্বের কতিপয় হচ্ছে-

মীমাংসাকারী যুদ্ধ

বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক চুড়ান্ত ‍যুগান্তকারী ঘটনা। এ চূড়ান্তকারী যুদ্ধে জয়লাভ না করলে ইসলাম পৃথিবীর বুক হতে চিরতরে মুছে যেত। মিথ্যার ওপর সত্যের, অজ্ঞতার ওপর জ্ঞানের জয় অবশ্যম্ভাবী; বদর যুদ্ধে জয়লাভ তাই প্রমাণিত হল।

কুরাইশদের দম্ভ খর্ব ও ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি

এতে কুরাইশদের গগন চুম্বী-খর্ব এবং সকল প্রকার অহংকার ধুলিস্যাৎ হয়। এ যুদ্ধে পরাজয় মক্কাবাসীদের গৌরব ও প্রতিষ্ঠার মূলে চরম আঘাত হানে। পক্ষান্তরে ইসলামের গৌরব ও শক্তি মদিনায় এবং মদিনার বাইরে বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে লাগলো। যে ধর্ম এতদিন আত্মরক্ষা চিন্তায় শঙ্কিত থাকত, সেই ধর্ম তখন বরং হামলা করার মত শক্তি সঞ্চয় করল।

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর শক্তিবৃদ্ধি

বদরের যুদ্ধ মুসলমানদের কাছে শুধু একটি যুদ্ধ নয়। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এই যুদ্ধ মুহাম্মদ (স) মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। এ জয়ের ফলে মহানবীর (স) বৈষয়িক শক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয়। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “সামরিক লড়াই হিসেবে বদরের যুদ্ধ যতই ছোট হোক না কেন, এতে হযরত মুহাম্মদ (স) এর পার্থিব শক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয়।”



অর্থনৈতিক লাভ

বদর যুদ্ধে মুসলমানো প্রচুর গনীমতের মাল লাভ করে এবং যুদ্ধবন্দী পণ দ্বারা আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হয়। যা একটি উদীয়মান শক্তির প্রয়োজন ছিল। এ যুদ্ধ পর্যায়ক্রমে মুসলমানদের ইসলাম বিস্তারের বাহন হয়ে দাঁড়ায় এবং মুসলিম বাহিনী শত্রুবাহিনীর পরিত্যক্ত অস্ত্র-শস্ত্র, ঘোড়া ও আরও অনেক মূল্যবান বস্তু লাভ করে। এ সমস্ত পণ্য দ্রব্য মুসলসানদের শক্তিবৃদ্ধিতে যতেষ্ঠ সাহায্য করে।

ইহুদি ও বেদুঈনের ওপর প্রভাব

এ যুদ্ধ ইহুদি ও আরবের বেদুঈনের প্রতি বেশি প্রভাব বিস্তার করে। তারা বুঝতে পারে যে, ইসলাম এক অজেয় শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ইয়াহুদি ও বেদুঈন জাতিও ইসলামের শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা লাভ করে। তারা শত্রুতা ত্যাগ করল না বটে। কিন্তু মুসলমানদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে সাহস পেল না।

নবযুগের সূচনা

মানবতার ইতিহাসে বদর যুদ্ধ নবযুগের সূচনা করেছে। মহানবী (স) উদারতায় মুগ্ধ হয়ে বন্দীদের অনেকেই ইসলামের ছায়াতলে আসে। তারা ইসলাম গ্রহণ করে শান্তির পরশ লাভ করে।

আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি

বদর যুদ্ধে মুসলমানগণ জয়লাভ করে ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতিতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। ধর্মের জন্য প্রাণদানের দৃঢ সংকল্পই পরবর্তীকালে মুসলমান জাতিকে অজেয় করে তুলেছিল। বদরের সফলতা মুসলমাদের মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে যে, ইসলামের শক্তির সম্মুখে যে কোন শক্তি পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য।



নিয়ম-শৃঙ্খলা ও ঈমানী শক্তির বিজয়

অপূর্ব কর্তব্যপরায়ণতা, অতুলনীয় নিয়ম-শৃঙ্কখলা, বীরত্ব-বিক্রম এবং অটুট ঈমানী শক্তিতেই মুসলমানগণ সর্বক্ষেত্র জয়লাভ করেছেন।

ইসলামের প্রচার-প্রসারে নতুন প্রেরণা

বদর যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইসলাম প্রচার ও বিস্তারেও বিশেষ উল্লেখযোগ্য নতুন প্রেরণা সংযোজিত হয়েছিল। এ সময় হতে ইসলামের অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটে। জোসেফ হেল-এর মতে, “বিধর্মীদের অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়।”

বিশ্বজয়ের সূত্রপাত

বদর যুদ্ধ মুসলমানদের বিশ্বজয়েরও সূত্রপাত করে। এতে সফলতা লাভের পর এক নতুন মনোবল ও সামরিক প্রেরণায় মুসলমানদের হৃদয় ভরে যায়। আর বিশ্বজয় করার অনুপ্রেরণা লাভ করে।

অভিনব ইতিহাস সৃষ্টি

ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ এক নতুন দিগন্ত উম্মেচন করে। মানবতার ইতিহাসে এ যুদ্ধ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। যুদ্ধ শেষে মহানবী (স) নিহত শত্রুদের পরিত্যক্ত লাশ সযত্নে সমাহিত করেছিলেন। বন্দীদের প্রতি তিনি মানবিক আচরণ ও উদারতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন-যার দৃষ্টান্ত মানবেতিহাসে বিরল। বিজয়ী হলেও মুসলমানরা কোনরূপ দম্ভ, অহংকার ও উল্লাসে মেতে ওঠেনি বরং মহান প্রভুর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। মহানবী (স) ও মুসলমানদের উদার এবং মানবিক আচরণ মুগ্ধ হয়ে যুদ্ধবন্দীদের অনেকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।



উপসংহার

হিজরি দ্বিতীয় সনের ১৭ রমযান বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এ দিনে হযরত মুহাম্মদ (স) মাত্র তিনশত তের জনের মুসলিম বাহিনী নিয়ে মদিনার ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক মাঠে আবু জেহেলের সুসজ্জিত এক হাজার দুর্ধর্ষ কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে মরণ-পণ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। আল্লাহর অসীম করুণায় মুসলমানগণ জয়ী হন। ৭০ জন কুরাইশ নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। মুসলমানদের মাত্র ১৪ জন শাহাদত বরণ করেন।


• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence

x

tiltony.com
tiltony.comhttp://www.tiltony.com
তিলটনি.কম একটি বাংলা ব্লগ সাইট। সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও পূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ কনটেন্ট প্রকাশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ওয়েবসাইটটি।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ‣ শিক্ষা ‣ স্বাস্থ্য ‣ জীবনযাপন ‣ পাঁচমিশালি ‣ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংবাদ পেতে ভিজিট করুন।
RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments