▶ প্রশ্ন: খ্রিস্ট ধর্ম কি? খ্রিস্ট ধর্মের মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্যগুলো বিস্তারিত লিখুন। ▶ বিষয়: IST-511 : Study of Religions (Islam, Buddhism, Hinduism, Judaism, Christianity) ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
খ্রিষ্টান (Christian) বলতে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বোঝায়। খ্রিষ্টধর্ম একটি একেশ্বরবাদী আব্রাহামীয় ধর্ম যার মূল ভিত্তি নাজারেথীয় যিশুর জীবন ও শিক্ষা। খ্রিষ্টানরা যিশুকে আদি বাইবেল/হিব্রু বাইবেল কথিত মসিহা এবং ঈশ্বরপুত্র মনে করে। সারা বিশ্বে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসরণকারী আছে প্রায় ২.১ বিলিয়ন। বর্তমানে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম। ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা, ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জ ও ওশেনিয়া অঞ্চলে খ্রিস্ট ধর্ম প্রধান ধর্ম হিসেবে পালিত হয়।
খ্রিস্ট ধর্মের পরিচয়
গ্রীক শব্দ Christus থেকে ইংরেজী Christ শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। যাকে হিব্রু ভাষায় Messiah বলা হয়। খ্রিস্ট শব্দের অর্থ স্বর্গীয় মহামান্বিত ব্যক্তি বা ঈশ্বরের প্রেরিত বা নির্ধারিত প্রতিনিধি। অন্যদিকে যীশু অর্থ হল মুক্তিদাতা। যীশু খ্রিস্ট অর্থ হল যীশু তাকে স্বর্গীয় মুক্তিদাতা হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।
আল্লামা বায়যাভী বলেন, হিব্রু ভাষায় একে আবশু এবং আরবী ভাষায় একে ঈসা বলা হয়।
খ্রিস্ট ধর্মের পরিচয় দিতে গিয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে, এটা সেই ধর্ম যা তার মৌলিকত্বকে নাসিরাবাসী ইয়াসূর সাথে সম্পর্ক করে থাকে এবং তাকে আল্লাহর মনোনীত মাসীহ বলে বিশ্বাস করে।
আলফ্রেড এ গারভে খ্রিস্ট ধর্মের সংজ্ঞা দিয়ে গিয়ে বলেন যে, এটা এমন এক ঐতিহাসিক, নৈতিক ও একেশ্বরবাদী সার্বজনীন ধর্ম যা প্রায়শ্চিত্তে বিশ্বাস করে এবং যাতে প্রভূ ইয়াস মাসীহের ব্যক্তিত্ব ও কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক গড়ে তুলে।
কেদারনাথ টেওয়ারি বলেন, Chirstianity can well be regarded as an extension of Judaism in a more elevated direction.
Maktolent বলেন, এই ধর্ম ইয়াহুদী ধর্ম মতের উপর ভিত্তি করে খ্রীষ্টের নাম দ্বারা প্রবর্তিত একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম।
খ্রিস্টান ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যাবলী
খ্রিস্টান ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
- একত্ববাদে বিশ্বাসী: মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রেরিত অন্যান্য নবী-রাসূলের মত ঈসা (আলাইহিস সালাম) তথা যীশু খ্রিস্ট কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম একত্ববাদের প্রচার করেছে। তিনি বলেছেন, হে বনী ইসরাঈল, তোমাদের প্রতি আমার প্রথম আজ্ঞা সষ্টিকর্তা এক ও অদ্বিতীয়। তোমাদের সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে তাকে ভালভাসো এবং তার উপাসনা কর। বাইবেলে বলা হয়েছে, I am the first, last the only God there is no God but me. এছাড়া ইঞ্জিল ইওহান্নাতে বলা হয়েছে, প্রথমে কালাম ছিলেন, কালাম আল্লাহর সাথে ছিলেন এবং কালাম নিজেই আল্লাহ ছিলেন।
- ত্রিতত্ত্ববাদে বিশ্বাসী: খ্রিস্টানগণ একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হলেও এর উপর ত্রিতত্ত্ববাদের একটি বিশ্বাস বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। তারা তিন খোদাতে বিশ্বাসী যারা হল ইশ্বর, পুত্র ও আত্মা। তারা বিশ্বাস করে ঈশ্বর একজন কিন্তু তার আবির্ভাব ঘটে তিনটি রুপে। তাদের মধ্যকার এই ধারনাটি নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ইঞ্জিলের ইওহান্নাতে বলা হয়েছে, সেই কালাম মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন এবং তোমাদের মধ্যে বসবাস করেলন। পিতার একমাত্র পুত্র তার মহিমা, সেই মহিমা আমরা দেখছি।
- ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস: খ্রিস্টনগণ মুসলিমগণের মত ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস রাখে। তারা বিশ্বাস রাখে যে, ফেরেশতাগণ আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট প্রতিনিধি।
- একনিষ্ঠভাবে ইবাদত: খ্রিস্টানরা একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে থাকে। এই বিষয়ে বাইবেলে বলা হয়েছে, তোমরা একনিষ্ঠভাবে প্রার্থনা করবে যখন তোমরা প্রার্থনা করবে। ভন্ডদের মত প্রার্থনা করবে না। তারা রাস্তায় মানুষকে দেখানোর জন্য প্রার্থনা করে। তোমরা এমনভাবে প্রার্থনা করবে যেন ঈশ্বর তোমাকে না দেখলেও ঈশ্বরকে তোমাকে দেখছে।
- সিয়াম সাধনা: আত্মশুদ্ধি লাভের অন্যতম একটি উপায় হল সিয়াম-সাধনা করা। সিয়াম-সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভের জন্য যীশু খ্রিস্ট সিয়াম-সাধনার উপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। তাই খ্রিস্টান ধর্মে বলা হয়েছে, লোকদের বুঝানোর জন্য মুখ কাল করে রোজা রেখো না বরং এই সময় মাথায় তেল দিও এবং মুখ ধুয়ে ফেল যেন লোকেরা বুঝতে না পারে।
- আত্মিক পরিশুদ্বতা: খ্রিস্টান ধর্মে মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধতা অর্জন করার উপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করে থাকে। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে, আত্মিক পরিশুদ্ধতা ছাড়া কখনও ঈশ্বরের করুনা লাভ করা যায় না। তাই বাইবেলে বলা হয়েছে, Blessed are those who had a clean hear, they will see God.
- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: ভালবাসা ও ন্যায়বিচার হল ঈশ্বররের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যীশু তার শিষ্যদের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে, Blessed are those who hungers and thirsts after righteousness for they shall be filled.
- প্রতিশ্রুতি রক্ষা: প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খ্রিস্টান ধর্মে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। যীশু খ্রিস্ট তার অনুসারীদের বলেন, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তোমাদের কর্তব্য।
- ব্যাভিচার নিষিদ্ধ: খ্রিস্ট ধর্মের দৃষ্টিতে ব্যভিচার একটি চরম অন্যায় এবং জঘন্য অপরাধ। শুধুমাত্র সরাসরি ব্যাভিচার নয় বরং, কু-দৃষ্টি প্রদান করা একটি জঘন্য অপরাধ যার দ্বারা ব্যভিচারের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়। যীশু বলেছেন, যে নারীর দিকে তাকায় সে মনে মনে তার সাথে যিনা করা যা তার অন্তরের পবিত্রতাকে নষ্ট করে ফেলে।
- সহনশীলতা প্রদর্শন: খ্রিস্টান ধর্ম একজন অপরের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করতে বলে থাকে। যীশু বলেন, তোমাদের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ করবে না। ক্ষমা করে দিও। তার এই উপদেশের দ্বারা খ্রিস্ট ধর্মের সহনশীলতার কথা প্রকাশ পায়।
- ধন-সম্পদের সঞ্চয় নয়: খ্রিস্ট ধর্মে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যীশু বলেছন, তোমরা এই পৃথিবীতে নিজেদের জন্য ধন-সম্পদ জমা করে রাখবে না। কারণ নষ্ট হয় ও চুরি হয়। কিন্তু স্বর্গে চুরি হয় না, আবার নষ্টও হয় না।
- অভিপ্রায় শুদ্ধিতা: যীশু বলেন, স্বর্গে তোমার প্রতি যেভাবে করুনা করা হয় তুমিও সেরকম করুনাময় হও। অর্থাৎ, তোমার অভিপ্রায় সত্য ও সুন্দর।
- পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালন করা: যীশু পিতা-মাতার অধিকার রক্ষা করার ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করে বলেছন, তোমরা পিতা-মাতার সাথে সদ্বব্যবহার কর।
- স্ত্রী পরিত্যাগ করা: একান্ত উপায় ছাড়া স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা খ্রিস্ট ধর্মের দৃষ্টিতে একটি জঘন্য অপরাধ। যীশু বলেন, যে ব্যাভিচারের কারণ ছাড়া স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে, সে যেন তাকে ব্যাভিচারিনী করে তুলে।
- ভ্রাতৃত্ববোধ: খ্রিস্টান ধর্ম খ্রিস্টানদেরকে পারষ্পরিক শত্রুতাকে পরিত্যাগ করে ভ্রাতৃত্বময় পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে অধিক গুরুত্বারোপ করেছে। যীশু বলেন, যে তোমাদের শত্রু ভাবে তাকে তুমি প্রেম-ভালবাসা দিয়ে জয় করে নাও। তোমরা ঝগড়া-বিবাদ না করে মিমাংসা করে নাও তোমাদের বিরোধসমূহ।
- শ্রদ্ধাবোধ: যীশু খ্রিস্ট বড়দের শ্রদ্ধা এবং ছোটদের প্রতি আদর যত্ন করার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে।
- অন্যের দোষ অন্বেষণ: অন্যের দোষ অন্বেষণ না করার বিষয়ে যীশু বলেন, তোমরা অন্যের দোষ ধরো না। কেননা তোমরা যেভাবে দোষারূপ করবে, সেভাবে তোমাদেরও দোষ ধরা হবে।
- শরীয়াতের শিক্ষা দেয়া: শরীয়াতকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের জন্য যীশু খ্রিস্ট প্রেরিত হয়েছেন। নিউ টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে, তোমরা এই কথা মনে করবে না যে আমি তোমাদের মাঝে মূসার শরীয়াত বাতিল করতে আসি এসেছি। বরং, এসেছি পূর্ণ করতে।
- ক্রোধ সংবরণ: যীশু খ্রিস্ট মানুষকে ক্রোধ সংবরণ করে মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করতে বলেছেন। এ ব্যাপারে যীশু বলেন, কেউ তোমাকে আঘাত করলে, তুমি তাকে আঘাত করো না। ক্রোধ সংবরণ করে তাকে ভালবাসা দাও। সে তার পাপের প্রায়শ্চিত্য পাবে।
- শপথ করার বিধান: খ্রিস্টান ধর্মে মিথ্যা শপথ করা অবৈধ। তাই বাইবেলে বলা হয়েছে, মিথ্যা শপথ করবে না, শপথ করলে প্রভূর নামে কর।
- প্রতিশোধের শিক্ষা: খ্রিস্ট ধর্ম মানুষকে শত্রুর প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করার কথা বলেছে। যীশু খ্রিস্ট বলেন, তোমাদের যদি কেউ ডান গালে চড় মারে তাহলে তাকেও অন্য পেতে দাও চড় দেয়া জন্য। তোমরা শত্রুদের ভালবাসো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর যাতে তোমরা স্বর্গীয় পিতা হতে পার।
- উপাসনার মূলনীতি ও পদ্ধতি: খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিতরা চারটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে উপাসনা করে থাকে। যা হল মাসীহ (আঃ) যেই ত্যাগ-তীতিক্ষা স্বীকার করেছে তা কেবলমাত্র ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য, সঠিক উপাসনা রুহের দ্বারা পাওয়া সম্ভব, উপাসনা একটি সমষ্টিগত কর্ম যা চার্চে সম্পন্ন হয় এবং উপাসনা হল চার্চের মূল কাজ এরই মাধ্যমে চার্চ মাসীহের দেহ হিসেবে নিজেকে দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করে। খ্রিস্টানগণ প্রশংসা পাঠ এবং ব্যাপটাইজের মাধ্যমে উপাসনা করে থাকে।
উপসংহার
খ্রিস্টান ধর্ম মানুষকে শান্তি ও নৈতিকতার শিক্ষা প্রদান করে থাকে। খ্রিস্টান ধর্ম বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম একটি ধর্ম। ইহুদি ধর্মের বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্যের সাথে খ্রিস্টান ধর্মের বৈশিষ্ট্যের সাদৃস্য রয়েছে।
সম্ভাব্য প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ (এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ)
• IST-507 : Study of Al-Hadith (Al-Mishkat Al-Masabih: Al-Iman, AlILM and Al-Salat (Selected Hadith) • IST-508 : Principles and History of Hadith literature • IST-509 : Muslim Personal Law and Law of Inheritance in Islam • IST-510 : Banking and Insurance in Islam • IST-511 : Study of Religions (Islam, Buddhism, Hinduism, Judaism, Christianity) • IST-512 : Muslim Contribution to science and technology •