Sunday, December 22, 2024

ভূলস্বর্গ • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূলস্বর্গ • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



ভূলস্বর্গ • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূলস্বর্গ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লোকটি নেহাত বেকার ছিল। 
তার কোন কাজ ছিল না, কেবল শখ ছিল নানারকমের। 
ছোটো ছোটো কাঠের চৌকোয় মাটি ঢেলে তার উপরে সে ছোটো ছোটো ঝিনুক সাজাত। দুর থেকে দেখে মনে হত - যেন একটা এলোমেলো ছবি, তার মধ্যে পাখির ঝাক; কিম্বা এবড়ো- খেবড়ো মাঠ, সেখানে গোরু চরছে; কিম্বা উঁচু নিচু পাহাড়, তার গা দিয়ে ওটা বুঝি ঝর্ণা হবে কিম্বা পায়ে চলা পথ।  
বাড়ির লোকের কাছে তার লাঞ্চনার সীমা ছিল না। মাঝে মাঝে পণ করতো পাগলামি ছেড়ে দেবে, কিন্তু পাগলামি তাকে ছাড়তো না। 

২ 

কোনো কোনো ছেলে আছে, সারা বছর পড়ায় ফাঁকি দেয়, অথচ, পরিক্ষায় খামকা পাস করে ফেলে। এর সেই দশা হল। 
সমস্ত জীবনটা অকাজে গেল, অথচ মৃত্যুর পরে খবর পেলে যে, তার স্বর্গে যাওয়া মঞ্জুর। কিন্তু নিয়তি স্বর্গের পথেও মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না। দূতগুলো মার্কা ভূল করে তাকে কেজো লোকের স্বর্গে রেখে এল। 
এই স্বর্গে আর সবই আছে, কেবল অবকাশ নেই। 
এখানে পুরুষরা বলছে, হাঁফ ছাড়বার সময় কোথা? ‘মেয়েরা বলছে চললুম ভাই কাজ রয়েছে পড়ে।’ সবাই বলে, ‘সময়ের মূল্য আছে।’ কেউ বলে না ‘সময় অমূল্য’। ‘আর তো পারা যায় না’ বলে সবাই আক্ষেপ করে, আর খুশি হয়। ‘খেটে খেটে হয়রান হলুম' এই নালিশটাই সেখানকার সংগীত। 
এ বেচারা কোথাও ফাঁক পায় না, কোথাও খাপ খায় না। রাস্তায় অন্যমনস্ক হয়ে চলে, তাতে ব্যস্ত লোকের পথ আটক করে। চাদরটি পেতে যেখানেই আরাম করে বসতে চায়, শুনতে পায়, সেখানেই ফসলের খেত, বীজ পোতা হয়ে গেছে। কেবলই উঠে যেতে হয়, সরে যেতে হয়। 

৩. 

ভারি এক ব্যস্ত মেয়ে স্বর্গের উৎস থেকে রোজ জল নিতে আসে। 
পথের উপর দিয়ে সে চলে যায় যেন সেতারের দ্রুত তালের গতের মতো। 
তাড়াতাড়ি সে, এলো-খোঁপা বেঁধে নিয়েছে। তবু দু-চারটে দুরন্ত অলক, কপালের উপর ঝুকে পড়ে তার চোখের কালো তারা দেখবে বলে উকি মারছে। 
স্বর্গীয় বেকার মানুষটি, একপাশে দাড়িয়ে ছিল, চঞ্চল ঝর্ণার ধারে তমাল গাছটির মতো স্থির। জনালা দিয়ে ভিক্ষুককে দেখে রাজকন্যার যেমন দয়া হয়, মেয়েটির তেমনি দয়া হল। 
‘আহা তোমার হাতে বুঝি কাজ নেই।’ 
নিশ্বাস ছেড়ে বেকার বললে, ‘কাজ করব তার সময় নেই।’
মেয়েটি ওর কথা কিছুই বুঝতে পারলেনা। বললে, ‘আমার হাত থেকে কিছু কাজ নিতে চাও?’
বেকার বললে, ‘তোমার হাত থেকেই কাজ নেব বলে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘কী কাজ দেব?’
‘তুমি যে ঘড়া কাঁধে করে জল তুলে নিয়ে যাও, তারই একটি যদি আমাকে দিতে পারো-’ 
‘ঘড়া নিয়ে কি হবে জল তুলবে’
‘না আমি তার গায়ে চিত্র করব।’
মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমার সময় নেই, আমি চললুম।’
কিন্ত, বেকার লোকের সঙ্গে কাজের লোক পারবে কেন?
রোজ ওদের উৎস তলায় দেখা হয়, আর রোজ সেই একই কথা, ‘তোমার কাঁখের একটি ঘড়া দাও, তাতে চিত্র করব।’
হার মানতে হল, ঘড়া দিলে। 
সেইটিকে ঘিরে ঘিরে বেকার আঁকতে লাগল কত রঙের পাক, কত রেখার ঘেড়। 
আঁকা শেষ হলে মেয়েটি ঘড়া তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলে। ভুরু বাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘এর মানে?’
বেকার লোকটি বললে, ‘এর কোনো মানে নেই।’
ঘড়া নিয়ে মেয়েটি বাড়ি গেল। 
সবার চোখের আড়ালে বসে সেটিকে সে নানা আলোতে নানা রকমে হেলিয়ে ঘুলিয়ে দেখলে। 
রাত্রে থেকে-থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে দীপ জেলে চুপকরে বসে সেই চিত্রটা দেখতে লাগল। 
তার বয়সে এই সে প্রথম এমন-কিছু দেখছে যার কোনো মানে নেই।
তার পরদিন যখন সে উৎস তলায় এল তখন তার দুটি পায়ের ব্যস্ততায় একটু যেন বাধা পড়েছে। পা দুটি যেন চলতে চলতে আনমনা হয়ে ভাবছে - যা ভাবছে তার কোনো মানে নেই। 
সেদিনও বেকার মানুষ এক পাশে দাড়িয়ে। 
মেয়েটি বললে, ‘কী চাও?’
সে বললে, ‘তোমার হাত থেকে আরো কাজ চাই।’
‘কী কাজ দেব?’
‘যদি রাজি হও, রঙিন সুতো বুনে বুনে তোমার বেণী বাধবার দড়ি তৈরি করে দেব।’
‘কী হবে?’
‘কিছুই হবে না।’
নানা রঙের নানা- কাজ করা দড়ি তৈরি হল। এখন থেকে আয়না হাতে নিয়ে বেণী বাঁধতে মেয়ের অনেক সময় লাগে। কাজ পড়ে থাকে, বেলা বয়ে যায়। 
এদিকে দেখতে দেখতে কেজো স্বর্গে কাজের মধ্যে বড়ো বড়ো ফাঁক পড়তে লাগল। কান্নায় আর গানে সেই ফাঁক ভরে উঠল। 
স্বর্গীয় প্রবীনেরা বড়ো চিন্তিত হল। সভা ডাকলে। তারা বললে, ‘এখানকার ইতিহাসে কখনো এমন ঘটে নি।’ 
স্বর্গের দূত এসে অপরাধ স্বীকার করলে। সে বললে, ‘আমি ভুল লোককে ভুল স্বর্গে এনেছি।’ 
ভুল লোকটিকে সভায় আনা হল। তার রঙিন পাগড়ি আর কোমরবন্ধের বাহার দেখেই সবাই বুঝলে, বিষম ভূল হয়েছে। 
সভাপতি তাকে বললে, ‘তোমাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে।’ 
সে তার রঙের ঝুলি আর তুলি কোমরে বেঁধে হাফ ছেড়ে বললে, ‘তবে চললুম।’
মেয়েটি এসে বললে, ‘আমিও যাব।’
প্রবীণ সভাপতি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এই সে প্রথম দেখলে এমন একটা কাণ্ড যার কোনো মানে নেই।


ভূলস্বর্গ • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- Download

  • ভূলস্বর্গ • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ➜ PDF Download
  • ভূলস্বর্গ • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ➜ Image Download

ভূলস্বর্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূলস্বর্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূলস্বর্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অন্যান্য কবিতাসমূহ

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,606FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles