▶ প্রশ্ন: উসুলে ফিকহের পরিচয় দিন। উসুলে ফিকহের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বিস্তারিত আলোচনা করুন ▶ বিষয়: (IST-506) Principles of Islamic Jurisprudence ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কুরআন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শক। আল কুরআনের নির্দেশিত পথ বা কার্যকারিতা কিয়াস পর্যন্ত বজায় থাকবে। আর কোরআন এই নির্দেশিত পথকে ইসলাম নামে আখ্যায়িত করেছে এবং এর আইন-কানুন ও সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যার ব্যাখ্যা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাজকর্ম, কথাবার্তা ও অনুমোদন দ্বারা প্রদান করেছেন তার বাস্তব ও চূড়ান্ত রুপ-ই ফিকহ শাস্ত্র।
ফিকহ শাস্ত্রের উৎপত্তি
হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় কোন সমস্যা দেখা দিলে তিনি নিজেই তার সমাধান করতেন। কিন্তু তাঁর ওফাতের পর সমসাময়িক সমস্যা সমাধানের জন্য কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে। আর এ সকল সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে উসুলে ফিকহ এর উৎপত্তি ঘটে। তখন থেকেই এর ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে।
উসুলে ফিকহ এর ক্রমবিকাশ
উসুলে ফিকহের ক্রমবিকাশ কয়েকটি পর্যায়ে ঘটে। যেমন- ১. সাহাবীদের যুগ, ২. তাবীদের যুগ ও ৩. মুস্তাহিদ ইমামগণের যুগ।
আরো পড়তে পারেন: ইজতিহাদ কী? এর প্রয়োজনীয়তা, শর্তাবলি এবং মুজতাহিদের যোগ্যতা ও গুণাবলি আলোচনা করুন?
সাহাবীদের যুগে উসুল ফিকহের ক্রমবিকাশ
সাহাবীদের সময় ইসলামের চারজন খলিফার সময়ে উসুলে ফিকহের ক্রমবিকাশ ঘটান। তারা হলেন-
- হযরত আবু বক্কর (রা.): হযরত আবু বক্কর এর শাসন আমলে কোন সমস্যার উদ্ভব হলে তিনি প্রথমে কোরআন খুলে দেখতেন এবং কোরআনের ভিত্তিতে সমাধান করতেন। যদি পবিত্র কুরআনে এ সমস্যার সমাধান না পেতেন তবে হাদিস মোতাবেক সমাধান করতেন। যদি সুন্নতে উল্লেখিত বিষয়ের কিছু না পেতেন তাহলে তিনি সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শ করে সমাধান করতেন। এ সময় আবু বক্কর যাকাত অস্বীকারকারী ও মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদারদের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে, প্রাথমিক পর্যায়ে যারা হিজরত করেছে তাদের ভাতা অন্যদের থেকে বেশি দেয়া হবে কিনা, তার পরে কে দ্বিতীয় খলিফা হবেন, তার মনোনয়ন পদ্ধতি কি হবে ইত্যাদি বিষয়ে ব্যক্তিগত জ্ঞানের সাহায্যে কুরআন ও সুন্নাহের ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে অথবা সাহাবাগণের সাথে পরামর্শ করে এর সমাধান করেছেন।
আরো পড়তে পারেন: কিতাবুল্লাহ কী? এর প্রকারভেদ ও বিস্তারিত আলোচনা করুন?
- হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.): ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সহচর্যে থেকে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শরীয়তের হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর স্পিরিট মগজে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। খিলাফতকালে তিনি ফয়সালা গ্রহণের জন্য পরামর্শ সভা করতেন। প্রয়োজনে বিতর্ক সভা করতেন। হযরত ওমর এর ইজতিহাদ অনুশীলনের প্রতি নজর দিলে দেখা যায় যে, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনি সুস্পষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। ভুল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অথবা দুর্নীতি দূর করার জন্য অথবা সবচেয়ে সহজ ও বেশি উপযোগী পন্থা হিসেবে জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।
- হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.): হযরত আবু বক্কর ও হযরত ওমর এর শাহাদাতের পর হযরত উসমানকে এই শর্ত খলিফা নির্বাচিত করা হয়েছিল যে তিনি কুরআন-হাদিসের পর পূর্ববর্তী দুজন খলিফার অনুষ্ঠিত নীতি অনুসরণ করবেন হযরত ওসমান নিজেও ইজতিহাদ করেছিলেন। মিনায় সালাত সংক্ষিপ্ত করার সুস্পষ্ট অনুমতি থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করেননি। তাছাড়া তিনি সর্বোত্তম পদ্ধতি মনে করে যায়িদ বিন সাবিত এর পদ্ধতিতে কুরআনের তেলাওয়াতের ফরমান জারি করেছিলেন।
- হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.): হযরত ওমর এর মতই হযরত আলী কুরানের বাণী উপলব্ধি করেন এবং সমাজে তা প্রয়োগ করেন। তিনি গভীর চিন্তা ভাবনা করে সাধারণ নীতিমালার আলোকে কোন ঘটনাকে বিশ্লেষণ করতেন। তিনি খলিফার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে একজন শ্রেষ্ঠ বিচারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং খিলাফতকালেও তিনি সফল বিচারকের প্রমাণ দিয়েছেন বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার মাধ্যমে।
তাবেঈগণের যুগ
সাহাবায়ে কেরামের যুগ হিজরি প্রথম শতাব্দী ১১০ সালে শেষ হওয়ার পর তাবেঈদের ফিকহ চর্চা শুরু হয়। সাহাবাগণের নিকট হতে প্রাপ্ত শিক্ষা তাবেঈগণের ইজতিহাদও একই পদ্ধতি ও ধারায় পরিচালিত হতো। তারা এই বিষয়ে এত বেশি কঠোর সাধনা ও পরিশ্রম করেছেন যে কিছু কিছু বিষয় পূর্ব অপেক্ষা আরো স্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে। এ সময় তাবেঈদের মধ্যে বিভিন্ন মতবিরোধ শুরু হয়। তার কারণ হলো-
- তখন ইসলামিক সাম্রাজ্য এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে সাহাবীগণ বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করা শুরু করেন এবং এলাকাভিত্তিক নিজস্ব মতামত প্রদান করেন।
- এ সময় কিছু চরমপন্থা মূলক ভ্রান্ত সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। এদের দ্বারা জাল হাদিস, নিজস্ব মতামত দ্বারা তাফসীর, নিজস্ব চিন্তাধারায় ইসলামকে সাজাতে শুরু করলে মতবিরোধ শুরু হয়।
- এ সময় কিছু কুচক্রী মহল নিজেদের স্বার্থে জাল হাদিস চালু করা শুরু করে। ফলের জনগণের জন্য সঠিক মাসালা বের করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য তাবেঈরা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নিজস্ব কেন্দ্রের মাধ্যমে ফিকহ চর্চা শুরু করেন।
মুজতাহিদ ইমামগণের যুগ
মুজতাহিদ ইমামগণের যুগ সম্পর্কে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী বলেছেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাদিস, ইসলামের প্রথম যুগের রায়, সাহাবী-তাবেঈ ও তৃতীয় প্রজন্মের আইন বিষয়ক পাণ্ডিত্য ইত্যাদি সবকিছু তাদের বিবেচনায় আনেন। তারপর তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ইজতিহাদ করেন। এভাবেই তৎকালীন আইনবিদগণ গবেষণা করেছেন। তারা সাহাবী ও তাবেঈনগণের মতামত কে প্রমাণ হিসেবে উদ্বৃত্ত করার ব্যাপারে অভ্যস্ত ছিলেন। এ সময় দুই বা ততোধিক হাদিসের বক্তব্য পরস্পর বিরোধী হলে মুস্তাহিদগণ দুটো হাদিসের মধ্যে কোনটি সঠিক সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাহাবীগণের মতামত অনুধাবন করতেন। পরবর্তী যুগের আইন বিশেষজ্ঞগণ তাদের পূর্ববর্তী ফকীহদের লেখা থেকে সমাধান না পেলে তারা নিজস্ব আইন বিষয়ক মতামত প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ফিরে যেতেন পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর সংশ্লিষ্ট মূল উৎসে।
এ যুগের গবেষকগণ তাদের গবেষণার বিষয়াবলী লিখে রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত হন। যেমন ইমাম মালিক, ইবনু আবুইয়া প্রমুখগণ তাদের গবেষণার বিষয়াবলী লিপিবদ্ধ করে রাখেন। এ ব্যাপারে সকলেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর সূচনালগ্নে ইসলামী সম্রাজ্য ভারতের সিন্ধু হতে ইউরোপের স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রসার লাভ করে। অনেক দেশ ও জাতির বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে ইসলামের সংমিশ্রণের ফলে নতুন নতুন সমস্যা উদ্ভব হয়। ইবাদত ও বাস্তব জীবনে এমন সমস্যা উপস্থিত হচ্ছিল যে, তা মৌখিক বর্ণনা, ইজতিহাদ, গবেষণার দ্বারা সমাধান সম্ভব ছিল না। তাছাড়া একই বিষয়ে বিভিন্নমুখী বহু হাদিস থাকার কারণে হাদিস সমূহের প্রাধান্য দেয়ার নীতিতে কিয়াসের ইখতিলাফ ও ইসতিসান এর দ্বারা মাসয়ালা রচনায় মতভেদ ইত্যাদি কারণে আলেম সমাজের মধ্যে মতানৈক্য বিরাজমান ছিল। এ মতাবাদের সুযোগে আমীর ও বিচারকগণ নিজের খেয়াল খুশিমতো বিচার করে জনগণের উপর জুলুম করতে থাকে। এ অবস্থায় ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শ্রেণীবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত ও উসুলের সংকলন ও সম্পাদন অতি জরুরি হয়ে পড়ে। যাতে এর দ্বারা বর্তমানে উদ্ভূত সমস্যা সমাধান ও ভবিষ্যতে উদ্ভূত সমস্যা ও সমাধান করা যায়। ইমাম হযরত আবু হানিফা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং ফিকহ শাস্ত্র সম্পাদনে আত্মনিয়োগ করেন।
উপসংহার
উসূলে ফিকহের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভিন্ন সময় ও সংস্কৃতি ভেদে ইবাদাত ও আমলের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার জন্য উসুলে ফিকহের গুরুত্ব অপরিসীম।
• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence •