Sunday, December 22, 2024

কোরআনের পরিচয় দিন। এর নামকরণ, বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য আলোচনা করুন।

প্রশ্ন: কোরআনের পরিচয় দিন। এর নামকরণ, বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য আলোচনা করুন। ▶ বিষয়: (IST-505) Principles and History of Tafsir Literatureকোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)



ভূমিকা

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মহান আল্লাহর কালাম বা বাণী সমষ্টি। এ গ্রন্থের ভাষা, ভাব, অর্থ, মর্ম, বিষয়বস্তু সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে। পবিত্র কুরআনে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার মূলনীতি আলোচিত হয়েছে। কুরআনের বিষয়বস্তু মানব জাতি। মানব জাতির ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি ও মুক্তির সন্ধান দেওয়া হয়েছে এ মহাগ্রন্থে।

আল-কুরআনের পরিচয়

আল-কুরআনের মানব রচিত কোন গ্রন্থ নয়। এটা মহান আল্লাহর ভাব, ভাষা, মর্ম-বিষয়বস্তু। সবকিছুই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। পূর্ববর্তী সকল নবী রাসূলের দাওয়াত ও তাদের প্রতি অবতীর্ণ আসমানী কিতাবের শিক্ষার সার সংক্ষেপ এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর অন্য সব আসমানী কিতাবের কার্যকারিতা রহিত হয়ে যায়। পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাব রহিত হয়ে গেছে। সুতরাং এখন আল-কুরআনই মানব জাতির কল্যাণ ও মুক্তির একমাত্র পথ প্রদর্শক।

আল-কুরআনের আভিধানিক পরিচয়

আল-কুরআন শব্দটি “কারউন” ধাতু হতে এসেছে। এর অর্থ একত্র করা, সন্নিবেশ করা, জমা করা। আল্লামা যারকানী বলেন, কুরআন শব্দটি কারা’আতুন ধাতু এসেছে যার অর্থ অধ্যয়ন করা ও পাঠ করা।



আল-কুরআনের পারিভাষিক পরিচয়

হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র.) বলেন, “আল-কুরআন মহান আল্লাহর সেই অতীব পবিত্র ও সম্মানিত কালাম যা তাঁর পক্ষ হতে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং মাসহাফে লিখিত হয়েছে। আর তা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে আমাদের নিকট পর্যন্ত ধারাবাহিক বর্ণনায় কোনরূপ সন্দেহ-সংশয় ব্যতীত পৌছেছে। আর তা হল কুরআনের আয়াত ও এর অর্থ উভয়ের সমষ্টি নাম।”

আল-কুরআনের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে আল্লামা নাসাফী (র) বলেন,

“মহাগ্রন্থ আল-কুরআন যা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপর অবতীর্ণ এবং যা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে, আর তা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে ধারাবাহিকভাবে সন্দেহাতীত পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে।”

আল-কুরআন নামকরণের তাৎপর্য

আল-কুরআনের আরও নাম রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নাম দুইটি। তা হল-  আল-কুরআন ও আল-ফুরকান। কুরআনের নামের অর্থ ও তাৎপর্য নিম্নে আলোচনা হলো-

১. আল-কুরআন সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ: আল্লামা তাকী উসমানী লিখেছেন, কুরআন অবতরণকালে আরবের অবিশ্বাসীরা এ কুরআনের পবিত্র বাণী শুনতে চাইত না। কুরআন তিলাওয়াতের সময় তারা নানারূপ হট্টগোল করত, যাতে কুরআনের বাণী তাদের কানে না পৌছে এবং বুঝতে না পারে। এ হীন আচরণের জবাবে আল-কুরআনের (পঠিত গ্রন্থ) নাম রেখে বুঝানো হয়েছে- তোমরা যতই কুৎসিত আচরণ দ্বারা কুরআনের বাণীকে ঠেকাতে চাও, কিন্ত কিছুতেই তা পারবে না। পবিত্র এ কিতাব  ‘পঠিত’ হওয়ার জন্যিই অবতীর্ণ হয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত তা পঠিত হতেই থাকবে। বস্তুত আজ পর্যন্ত সর্বজনবিদিত ও স্বীকৃত সত্য হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র কুরআনই সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ।


আরো পড়তে পারেন: ১০ জন প্রসিদ্ধ মুফাসসির তাবেয়ীর পরিচয় দিন। তাবেয়ীদের যুগে তাফসীরের বৈশিষ্ট্য লিখুন।


ইমাম রাগিব ইসপাহানী ‘কুরআন’ শব্দের এ নামকরণের তাৎপর্য বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেন, “আসমানী গ্রন্থের মধ্যে বিশেষ করে এ কিতাবকেই কুরআন বলা হয়েছে এ জন্য যে, আসলে এ কিতাবেই অন্যান্য সকল আসমানী কিতাবে বর্ণিত তথ্য ও বিষয়সমীহ একত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে। সে সব গ্রন্থের শিক্ষা ও সারসংক্ষেপ এ পবিত্র গ্রন্থে আছে। মূলত বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইলম-বিদ্যারও সমাবেশ ঘটেছে এ কিতাবে।”

২. আল-ফুরকান (পার্থক্যকারী): ফুরকান শব্দের অর্থ হচ্ছে- ‘পার্থক্য ও প্রভেদকারী’। আল-ফুরকান হক ও বাতিলের মধ্যে, কুফর-শিরক এবং তাওহীদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্যকার। এই কারণে কুরআনকে ফুরকান নামে অভিহিত করা হয়।

৩. আল-কিতাব (মহাগ্রন্থ): আল কুরআনের আরেক নাম আল কিতাব। যার অর্থ সন্নিবেশিত। কুরআনে সকল বিষয় সু সন্নিবেশিত হয়েছে এবং এক আল-কিতাব বা মহাগ্রন্থ বলা হয়।

৪. আল-যিকর (স্মারক): যিকর অর্থ স্মারক। এ গ্রন্থে বিভিন্ন উপদেশ এবং পূর্ববর্তী জাতিসমূহ অবস্থা উল্লেখ আছে বলে একে আল-যিকর বলা হয়।

৫. আত-তানযীল (অবতরণকৃত): এই কুরআন মহান আল্লাহর পক্ষ হতে মানবজাতির দিশারীরুপে অবতীর্ণ হয়েছে। এজন্য একে ‘তানযীল’ বলা হয়।

৬. আল-কালাম (বাণী): কালাম শব্দের অর্থ আকর্ষণ করার বাণী। কুরআন শ্রবণকারীর হৃদয়-মনকে আকৃষ্ট করে বলে, একে ‘আল-কালাম’ বলা হয়।

৭. আল-হুদা (দিশা): এ নামকরণের কারণ হচ্ছে এটা সত্য পথের দিশারী।

৮. আল-নূর (আলোকবর্তিকা): কুরআনের মাধ্যমে সত্য মিথ্যা উদ্ভাসিত হয়, তাই একে ‘নূর’ বলা হয়।

৯. আশ-শিফা (প্রতিষেধক): মানবাত্মার বিভিন্ন রোগ যেমন-কুফর-শিরক, নিফাক, মূর্খতা এমনকি দৈহিক রোগও এর মাধ্যমে উপশম হয়। তাই কুরআনকে ‘শিফা’ বলা হয়।

১০. আল-হিকমত (বিজ্ঞানময়তা): আল-কুরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল নির্ভরযোগ্য তথ্য ও তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। এজন্য একে ‘হিকমত’ বলা হয়।

১১. আল-হাকীম (বিজ্ঞানময় গ্রন্থ): কুরআনের আয়াতসমূহ খুবই সৌন্দর্যমন্ডিত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিপূর্ণ, তাই একে হাকীম বলা হয়।

১২. আল-হাবলু (রশি): যে লোক কুরআনকে মজবুত করে আঁকড়ে ধরবে সে অবশ্যই জান্নাত বা সুপথের সন্ধান পাবে। তাই একে আল-হাবলু বলা হয়েছে।

১৩. সিরাতুল মুস্তাকীম (সরল পথ): কুরআনের অনুসরণ করলে সরল ও মুক্তির রাজপথে চলে জান্নাতে পৌঁছা যায়। এ কারণে এই নাম।



১৪. আল-মাসানী (পুনরাবৃত্তি): প্রাচীন মানবজাতির কাহিনী পুনরায় এতে বর্ণিত হয়েছে। এজন্য এ নাম রাখা হয়।

১৫. আল-রুহ (আত্মা): এ নামকরণের কারণ হচ্ছে কুরআনের মাধ্যমে হৃদয়-মন সঞ্জিবীত থাকে।

১৬. আল-মুতাশাবাহ (সাদৃশ্যপূর্ণ): কুরআনের এক অংশ অন্য অংশের সাথে সত্যতা ও সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ তাই এর এ নাম।

১৭. আল-মাজীদ (মর্যাদাপূর্ণ): কুরআন অতীব মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত গ্রন্থ তাই একে ‘মাজীদ’ বলা হয়।

১৮. আল-বালাগ (পরিপূর্ণ ও অলংকাময়): কুরআনের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে পরিপূর্ণভাবে সত্যের আহ্বান জানানো হয় এবং এটা সাহিত্য সৌন্দর্যের দিক দিয়ে পরিপূর্ণ অলংকারময় গ্রন্থ। তাই একে ‘বালাগ’ বলা হয়।

১৯. আল-বায়ন (বাণী): কুরআনে সুস্পষ্টভাবে মানবজাতির মুক্তির বাণী বর্ণিত হয়েছে। তাই এর নাম আল-বায়ান।

২০. মাসহাফ (ফলক): হযরত আবূ বকর (রা) সর্বপ্রথম কুরআনকে গ্রন্থাবদ্ধ করে এর নাম ‘মাসহাফ’ রাখেন। পবিত্র কুরআনের আলোচ্য বিষয় ও বিষয়বস্তুর ব্যাপকতার জন্য এবং বিভিন্ন গুণ বৈশিষ্ট্যের কারণে এর বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে। আসলে কুরআনের মূল নাম আল-কুরআন এবং অপর নাম আল-ফুরকান। অন্যান্য নাম হচ্ছে গুণবাচক।

আল-কুরআনের আলোচ্য বিষয়

আল-কুরআনের মূল আলোচ্য বিষয় হলো মানব জাতি। কারণ মানব জাতির প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণের সঠিক সন্ধান ও পরিচয় কুরআনেই বলা হয়েছে। কুরআনের মূল উদ্দেশ্য হলো মানব জাতিকে আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধানের প্রতি পথ প্রদর্শন করা। যাতে মানুষ পৃথিবীর জীবনকে কল্যাণময় করতে পারে এবং পরকালে শান্তি ও সুখিময় জীবনের অধিকারী হতে পারে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারা-এর ২ নম্বর আয়াতে বলেন-

ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚۖۛ فِیۡهِ ۚۛ هُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ۙ﴿۲﴾

অর্থ: এটা ঐ (মহান) কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য পথ নির্দেশ।



১. মানব জাতি উন্নতি ও কল্যাণ সাধন করাই হলো পবিত্র কুরআনের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। তাই মানব জীবনের সকল দিক নিয়েই পবিত্র কুরআনের আলোচনা করা হয়েছে।

২. মানুষের ব্যক্তি জীবন এবং আধ্যত্মিক জীবনের জন্যে যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুই কুরআনে আছে।

৩. মানুষের সমাজ জীবনে যা কিছু প্রয়োজন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সমরনীতি, যুদ্ধ-শান্তি, সন্ধি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি সকল বিষয়ের উল্লেখ কুরআনে আছে।

উপসংহার

মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন সমগ্র মানব জাতির হিদায়াতের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা এই কিতাবে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের সকল বিষয়বস্তু উল্লেখ করেছেন। দুনিয়াতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এই কোরআনে। আর আখিরাতের সুখ-শান্তি ও কঠিন আযাব-শাস্তির কথাও উল্লেখ রয়েছে এই কিতাবে।


• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,606FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles