▶ প্রশ্ন: সংখ্যালঘু কারা? ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার সমূহ কি কি বিস্তারিত ভাবে লিখুন? ▶ বিষয়: (IST-504) Human Rights in Islam ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
ইসলাম সার্বজনীন ধর্ম। পৃথিবীর সকল শ্রেনী-পেশার, ধর্মের-বর্ণের মানুষের জন্য কল্যাণকর একটি ধর্ম। পবিত্র কোরআনে ইসলামের মূল বিষয়সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই কোরআন শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নাযিল করা হয়নি। কোরআন নাযিল করা হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জন্য। এ থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইহুদিসহ সকল ধর্মের মানুষ উপকৃত হতে পারে। সুতরাং ইসলামের পৃথিবীর সকল মানুষের অধিকার সঠিকভাবে বণ্টন নিশ্চিত করেছে।
সংখ্যালঘু কারা
সংখ্যালঘু বলতে সংখ্যা ও সামর্থ্যের বিচারে এমন কোন দুর্বল সম্প্রদায়কে বোঝায় যারা বেশি সংখ্যক ও বেশি শক্তিশালী সম্প্রদায়ের মোকাবিলায় নিজেদের রক্ষা করতে যারা অপারগ। প্রকৃত অর্থে কোন রাষ্ট্রে বসবাসকারী সংখ্যায় ছোট কোন গোষ্ঠী, গোত্র, সম্প্রদায় বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকারসমূহ
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- ১. অনুগত অমুসলিম নাগরিক, ২. চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক ও ৩. যুদ্ধে বিজিত অমুসলিম নাগরিক। সেই বিভাজনের উপর ভিত্তি করে মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগকের অধিকারসমূহের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
আরো পড়তে পারেন: বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র বর্ণনা করুন? বিদায় হজের আলোকে এর প্রতিকার বর্ণনা করুন
অনুগত অমুসলিম নাগরিক
ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত অমুসলিম নাগরিক বলতে সেসব নাগরিককে বুঝায় যারা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমারেখার মধ্যে বসবাস করে তার আনুগত্য ও আইন পালন করে চলার অংগীকার করে। হতে পারে তারা দারুল ইসলামে জন্মগ্রহণ করেছে অথবা বাইরের কোন অনৈসলামিক রাষ্ট্রে থেকে এসে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজা হওয়ার আবেদন করে নাগরিক হয়েছে। এ দিক দিয়ে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় না।
ইসলাম এ শ্রেণীর নাগরিকদের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং জান-মাল ও সম্মানের পূর্ণ নিরাপত্তা দান করে। তাদের উপর রাষ্ট্র কেবল গণআইন জারী করতে পারে। এই গণআইনের দৃষ্টিতে তাদের ও মুসলমান নাগরিকদের সমান অধিকার ও মর্যাদা দেয়া হয়। দায়িত্বপূর্ণ পদ ব্যতীত সকল প্রকার চাকুরীতেও তাদের নিয়োগ করা যাবে। নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তারাও মুসলমানদের সমান অধিকার ভোগ করবে। অর্থনৈতিক ব্যাপারেও তাদের সাথে মুসলমানদের অপেক্ষা কোনরূপ স্বতন্ত্র আচরণ করা হবে না। রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে তা সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম নাগরিকের জন্যেও পূর্ণমাতরায ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষিত থাকে। এ পর্যায়ে ইসলামী আইনবিদরা যে নীতিমালা ঠিক করেছেন তা হলো- “আমাদের জন্যে যেসব অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা তাদের জন্যেও তাই এবং আমাদের উপর যেসব দায়িত্ব তাদের উপরও তাই রয়েছে।”
আরো পড়তে পারেন: ইসলামে মানবাধিকার বলতে কি বুঝায়? মানবাধিকারের প্রকৃতি ইসলামের আলোকে ব্যাখ্যা করুন?
এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (রা.) বলেছেন, “অমুসলিম নাগরিকরা জিযিয়া কর আদায় করে এ উদ্দেশ্যে যে, তাদের ধন-সম্পদ ও জান-প্রাণ মুসলিম নাগরিকদের মতই সংরক্ষিত হবে।” বস্তুত ইসলামী শরীআহ ভিত্তিক রাষ্ট্রে অমুসলিমরা যে বিরাট অধিকার ও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করে, পৃথিবীর অপর কোন নির্দিষ্ট আদর্শিক রাষ্ট্রে এর তুলনা নেই। ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম নাগরিক শুধু বেঁচেই থাকে না, বেঁচে থেকে সর্ববিধ অধিকারও লাভ করে। অমুসলিম নাগরিকদের জন্যে স্বয়ং আল্লাহ এবং তার রসূলই নিরাপত্তার যিম্মাদার। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘোষণা করেছেন, “যে লোক ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিককে কোনোরূপ কষ্ট দেবে, আমি নিজেই তার বিপক্ষে দাঁড়াবো এবং আমি যার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে আমি মামলা দায়ের করবো।”
অমুসলিম নাগরিকদের সম্পর্কে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যেসব কথা বলেছেন, তার ভিত্তিতেই ইসলামী আইনবিদগণ স্পষ্ট করে বলেছেন যে, অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান ওয়াজিব এবং তাদের কোনোরূপ কষ্ট দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। জনৈক ফিকহবিদ বলেছেন, অসুসলিম নাগরিককে যদি কেউ কষ্ট দেয়, তাদেরকে কটু কথা বলে, তাদের পেছনে তাদের সম্মানের উপর বিন্দুমাত্র আক্রমণ করে কিংবা তাদের সাধে শক্রতার ইন্ধন যোগায় তাহলে সে আল্লাহ এবং তার রাসূলের তথা দ্বীন ইসলামের বিধানকে লংঘন করলো।
আল্লামা ইবনে হাজম বলেন, এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদদের ইজমা (ঐকমত্য) এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রের অনুসলিম নাগরিককে হত্যা করার জন্যে যদি কোনো বিদেশী শত্রু এগিয়ে আসে, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য হবে তার বিরুদ্ধ লড়াই করা এবং অমুসলিম নাগরিককে রক্ষা করা।
চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক
যারা যুদ্ধ ছাড়া অথবা যুদ্ধ চলাকালে ইসলামী রাষ্ট্রে আনুগত্য করতে সম্মত হয় এবং ইসলামী সরকারের সাথে সুনির্দিষ্ট শর্তাবলীর ভিত্তিতে আবদ্ধ হয়, তাদের জন্য ইসলামের বিধান এই যে, তাদের সাথে সকল আচরণ তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুযারী করা হবে।
কোনো জাতির সাথে যখন কিছু শর্ত স্থির করা হয়ে যায় (চাই তা মনোপুত হোক বা না হোক) তখন তাতে চুল পরিমাণও ব্যতিক্রম করা যাবে না। চাই উভয় পক্ষের অবস্থান, শক্তি ও ক্ষমতায় যতোই পরিবর্তন আসুক না কেন।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যদি তোমরা কোনো জাতির সাথে সন্ধির ভিত্তিতে বিজয়ী হও এবং সেই জাতি নিজেদের ও সন্তানদের প্রাণ রক্ষার্থে তোমাদেরকে নিদিষ্ট পরিমাণ কর প্রদানের বিনিময় তোমাদের সঙ্গ চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে এ নির্ধারিত করের চেয়ে বিন্দু পরিমাণও বেশী নিও না। কেননা সেটা তোমাদের জন্য বৈধ হবে না।”
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “সাবধান! যে ব্যক্তি কোনো চু্ক্তিবদ্ধ নাগরিকের উপর যুলুম করবে কিংবা তার প্রাপ্য অধিকার থেকে তাকে কম দেবে, তার ক্ষমতার চেয়ে বেশী বোঝা তার ওপর চাপাবে, অথবা তার কাছ থেকে কোনো কিছু তার সম্মতি ছাড়া আদায় করবে, এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকে কিয়ামতের দিন আমি নিজেই ফরিয়াদী হবো।”
যুদ্ধে বিজিত অমুসলিম নাগরিক
তৃতীয় প্রকারের অমুসলিম নাগরিক হচ্ছে যারা শেষ সময় পর্যন্ত মুসলমানদের সাথে লড়াই করেছে এবং ইসলামী বাহিনী যখন তাদের সকল প্রতিরোধ ভেংগে তাদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করেছে, কেবল তখনই আত্ম সমর্পণ করেছে। এ ধরনের বিজিত লোকদের কাছ থেকে জিষিয়া কর তখনই গ্রহণ করা হয়, যখন তাদেরকেই ইসলামী রাষ্ট্র রক্ষিত নাগরিকে পরিণত করা হয়। এই শ্রেণীর অমুসলিম নাগরিকদের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অবস্থা সম্পর্কে বিধানগুলো হল-
- মুসলমানদের সরকার তাদের কাছ থেকে যিজিয়া গ্রহণ করা মাত্রই তাদের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবে এবং তাদের জান ও মালের হিফাযত করা মুসলমানদের জন্য ফরয হযে পড়বে। কেননা জিযিয়া গ্রহণ করা মাত্রই প্রাণিত হল যে, তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। এরপর ইসলামী সরকার বা সাধারণ মুসলমানদের এ অধিকার থাকে না যে তাদের সম্পত্তি দখল করবে বা তাদেরকে দাসদাসী বানাবে। হযরত উমর (রা) হযরত আবু উবায়দাকে দর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেন, “যখন তুমি তাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করবে, তখন তোমার আর তাদের উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না।”
- রক্ষিত নাগরিকে পরিণত হওয়ার পর তাদের জমির মালিক তারাই হবে। সেই জমির মালিকানা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরিত হবে এবং তারা নিজেদের সম্পত্তি বেচা-কেনা, দান করা ও বন্ধক রাখা ইত্যাদির নিরংকুশ অধিকারী হবে। ইসলামী সরকার তাদেরকে বেদখল করতে পারবে না।
- জিযিয়ার পরিমাণ তাদের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। যারা ধনী, তাদের কাছ থেকে বেশী, যারা মধ্যবিত্ত তাদের কাছ থেকে কিছু কম এবং যারা দরিদ্র তাদের কাছ থেকে অনেক কম নেয়া হবে। আর যার কোনো উপার্জনের ব্যবসা নেই, অথবা যে অন্যের দান দক্ষিণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে, তার জিযিয়া মওকুফ করে দেয়া হবে। জিযিয়ার জন্য যদিও কোনো বিশেষ পরিমাণ নির্ধারিত নেই তবু তা অবশ্যই এভাবে নির্ধারিত হওয়া চাই যাতে তা আদায় করা তাদের পক্ষে সহজ হয়।
- জিযিয়া শুধু যুদ্ধ করতে সক্ষম লোকদের ওপর আরোপ করা হবে। যারা যুদ্ধ করতে সমর্থ নয় যথা শিশু, নারী, পাগল, অন্ধ, পংগু, উপাসনালয়ের সেবক, সন্যাসী, ভিক্ষুক, বৃদ্ধ, বছরের উল্লেখযোগ্য সময় রোগে কেটে যায় এমন রোগী এবং দাস-দাসী ইত্যাদিকে জিযিয়া দিতে হবে না।
- যুদ্ধের মাধ্যমে দখলীকৃত জনপদের উপাসনালয় দখল করার অধিকার মুসলমানদের রয়েছে। তবে সৌজন্য বশত এই অধিকার ভোগ করা থেকে বিরত থাকা এবং উপাসনালয়গুলোকে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় বহাল রাখা উত্তম। হযরত উমর (রা)-এর আমলে যত দেশ বিজিত হয়েছে সে সব দেশের কোথাও কোনো উপাসনালয় ভাঙ্গা হয় নি বা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়নি।
উপসংহার
ইসলাম ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের অধিকারের বিষয়ে সর্বোচ্চ নিশ্চতা প্রদান করেছে। ইসলাম তাদেরকে রাষ্ট্র পরিচালার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার সাথে সাথে তাদের যাবতীয় সাংস্কৃতিক ও মানবীয় অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা দান করে।
• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence •