Monday, July 1, 2024
Homeইসলামশরী‘আতের দৃষ্টিতে ওলীমা, আকীকা ও খতনা যেভাবে করতে হয়

শরী‘আতের দৃষ্টিতে ওলীমা, আকীকা ও খতনা যেভাবে করতে হয়

ওলীমা, আকীকা ও খতনা। ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিতে তিনটি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে আমরা এই বিষয়গুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে আমাদের ভালোভাবে জানা এবং সে অনুযায়ী এই কাজগুলো সম্পাদন করা জরুরী। বর্তমান সময়ে এইগুলো অনেক ধরণের ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। যা অনেক ক্ষেত্রেই শরীয়াত বিরোধী। সুতরাং জেনে নিন ওলীমা, আকীকা ও খতনা সম্বন্ধে বিস্তারিত।


ওলীমা প্রসঙ্গ

ওলীমার শাব্দিক অর্থ খানা খাওয়ানো। শরী‘আতের পরিভাষায় বিবাহের পর ছেলে বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে যে খানার দাওয়াত দেওয়া হয় তাকে ওলীমা বলে।

বিবাহের ওলীমা করা নবীজীর সুন্নাত

ওলীমার হুকুম

ওলীমা করা সুন্নাত। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাযি. এর শরীর বা কাপড়ে হলুদ রঙের চিহ্ন দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? জবাবে তিনি বললেন, আমি একটি খেজুর দানার পরিমাণ সোনা দিয়ে একটি মেয়েকে বিবাহ করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, আল্লাহ তোমার বিবাহে বরকত দিন। আর তুমি ওলীমা করো যদিও একটি বকরি দ্বারা হোক না কেনো। 1

ওলীমা করার সময়সীমা

বিবাহের তিন দিনের মধ্যে যেকোনো সময় ওলীমার আয়োজন করা যেতে পারে। তবে কনের রুখসতির পর তথা বর-কনের বাসর হওয়ার পর ওলীমা করা উত্তম। এতে বিবাহের পরিপূর্ণ এ‘লান ও প্রচার প্রসার হয়ে যায়।2

ওলীমার দাওয়াত গ্রহণ করার হুকুম

ওলীমার দাওয়াত গ্রহণ করা সুন্নাত। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কাউকে ওলীমার দাওয়াত দেওয়া হয় তখন সে যেন তাতে উপস্থিত হয়।3

যদি ওলীমার সভায় শরীয়ত বিরোধী কোনো কিছু হওয়ার আশংকা থাকে আর দাওয়াতি মেহমানের উক্ত কাজ বন্ধ করার ক্ষমতা থাকে, তাহলে মজলিসে অংশগ্রহণ করে তা বন্ধ করে দিবে। কিন্তু বন্ধ করার ক্ষমতা না থাকলে সেখানে অংশগ্রহণ করবে না। আর যদি উপস্থিত হওয়ার পর শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ দেখা যায়, তাহলে সমাজের দ্বীনদার ও ইমাম, মুয়ায্যিন এবং মুবাল্লিগ ভায়েরা তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করবেন, আর বন্ধ না করতে পারলে আহার না করেই চলে আসবেন।4

ওলীমার সময় কয়েকটি বর্জনীয় কাজ

  • ছেলে নিজের সামর্থ্যের বাহিরে ওলীমার ব্যবস্থা করবে না এবং এর জন্য ধার-কর্জ করারও প্রয়োজন নেই। যদি কোনো কিছুর সামর্থ্য না থাকে তবে শুধু মিষ্টিমুখ করিয়ে দিবে। ওলীমাতে পেট ভরে খাওয়ানো জরুরী নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক স্ত্রীর (উম্মে সালামা রাযি.) ওলীমা করেছিলেন মাত্র দুই মুদ যব দ্বারা।5
  • ওলীমার দাওয়াতে শুধু ধনী ও সমাজের মান্য গণ্য ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত করবে না। বরং গরীব শ্রেণীকেও দাওয়াত করবে। হাদীসে এসেছে, হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সর্বাপেক্ষা মন্দ খানা হচ্ছে সেই খানা, যাতে কেবল ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয়, আর গরীবদের বাদ দেওয়া হয়। 6
  • আমাদের সমাজে বরযাত্রার নামে যে ধূমধাম করা হয় এটা এবং বর পক্ষের এই শর্ত করা যে, আমাদের এই পরিমাণ লোককে খাওয়াতে হবে এসব শরীয়তে অনুমোদিত নয়। এ ধরণের দাওয়াতে শরীক হবেন না। মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক রহ. বলতেন, এটা হচ্ছে ডাকাতির খানা। হাদীসে এধরণের দাওয়াতে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে এসেছে যে, তারা চোর হয়ে প্রবেশ করলো আর ডাকাত হয়ে বের হলো। সুতরাং এধরণের খানা থেকে দূরে থাকা চাই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
  • শরী‘আতের দৃষ্টিতে বিয়েতে মাত্র দুই ধরনের খরচ থাকে মহর ও ওলীমা। আর এই উভয় খরচ স্বামীর যিম্মায়। সুতরাং মেয়ের বাপের উপর দাওয়াত, যৌতুক ইত্যাদি কোনো কিছুর বোঝা চাপানো জায়িয নেই।

আকীকা প্রসঙ্গ


আকীকা করা মুস্তাহাব এবং এর দাওয়াত কবুল করা জায়িয।7

ছেলে বা মেয়ের জন্মের পর সপ্তম দিবসে আকীকা করা উত্তম। সপ্তম দিনে না করতে পারলে পরে যেকোনো দিন করতে পারবে। তবে সপ্তম দিন যে বার ছিল সেই বারে করা ভালো। হযরত ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে তার আকীকা করো এবং তার জন্য সুন্দর নাম রাখো।8

ছোট বয়সে যদি আকীকা করা না হয়, তাহলে যেকোনো বয়সে নিজের আকীকা নিজে করতে পারবে। হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী হওয়ার পর নিজের জন্য আকীকা করেছেন।9

আকীকা সংক্রান্ত কয়েকটি জরুরী মাসআলা

  • আকীকার মধ্যে ছেলে সন্তানের জন্য দুইটি বকরি আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি বকরি জবাই করা উত্তম। ছেলের জন্য দুইটি বকরি সম্ভব না হলে একটিই যথেষ্ট।10
  • কেউ যদি কুরবানীর গরুর মধ্যে আকীকা করতে চায়, তাহলে সে ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ বরাদ্দ করবে। ছেলের জন্য দুই অংশ সম্ভব না হলে এক অংশ বরাদ্দ করতে পারে।11
  • গরু ও উট দ্বারা একাধিক বাচ্চার আকীকা করা জায়িয আছে।12
  • আকীকা করা মুস্তাহাব। কেউ যদি আকীকা না করে তাহলে সে গুনাহগার হবে না। ফাতাওয়া রহীমিয়া ২/৯১
  • যে পশু দ্বারা কুরবানী করা বৈধ সেই পশু দ্বারা আকীকা করতে হয়। যেমনঃ ছাগল, ভেড়া এক বছরের হতে হবে। আর গরু ও মহিষ দুই বছরের হতে হবে। রদ্দুল মুহতার ৫/২১৩
  • আকীকার গোস্ত কাঁচা বণ্টন করা বা রান্না করে বণ্টন করা অথবা দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো কিংবা কাউকে না খাওয়ানো সবই জায়িয আছে। আর আকীকার গোস্ত ধনী-গরীব সবাই খেতে পারবে। রদ্দুল মুহতার ৫/২১৩
  • আকীকার চামড়ার মূল্য কুরবানীর চামড়ার ন্যায় সদকা করে দিতে হবে।

আকীকার ফযীলত

আকীকার দ্বারা বিভিন্ন বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বুখারী ২/৮২২

শিশুর জন্মের সপ্তম দিবসে করণীয় কয়েকটি কাজ

  • আকীকা করা। তাবারানী আউসাত হা.১৯৮১
  • শিশুর সুন্দর নাম রাখা।
  • পশু জবাইয়ের আগে বা পরে বাচ্চার মাথার চুল মুন্ডানো। তুহফাতুল মাওদূদ বি আহকামিল মাওলূদ পৃ.৮৮
  • সম্ভব হলে চুলের ওজন সমপরিমাণ সোনা বা রুপা দান করা।
  • আকীকার গোস্ত দাওয়াত করে খাওয়ানো। প্রাগুক্ত পৃ. ৭৩

খতনা প্রসঙ্গ


খতনা করা সুন্নাত। এটা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিয়ার বা নিদর্শন। জন্মের পর থেকে বালেগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় খতনা করা যায়। তবে সাত বছরের আগে করানো উত্তম ও মুস্তাহাব। ফাতাওয়া আলেম গীরী ৫/৪৩৬

যদি বালেগ হওয়ার পূর্বে কারো খতনা না হয়ে থাকে বা কোনো অমুসলিম বালেগ হওয়ার পর মুসলমান হয়, তাহলে বালেগ হওয়ার পর খতনা করার হুকুম বাকী থাকবে এবং তাকে খতনা করানো হবে যদি তার মধ্যে খতনার কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতা থাকে। ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২৩৮

খতনার পরিমাণ

পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগে যে চামড়া রয়েছে তার অর্ধেকের চেয়ে বেশি কাটা হলে তাকে খতনা বলা হবে। আর অর্ধেক বা তার চেয়ে কম কাটা হলে তাকে খতনা বলা হবে না। সুতরাং যদি কাউকে খতনা করানোর পর তার অগ্রভাগের চামড়া লম্বা হয়ে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগকে প্রায় ঢেকে নেয়, তাহলে তাকে পুনরায় খতনা করাতে হবে। রদ্দুল মুহতার ১০/৫১৫

খতনার সময় প্রচলিত একটি ভুল

অনেক জায়গায় খতনা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য বিরাট আকারে খানা পিনার আয়োজন করা হয় এবং সেখানে ছেলেদের জন্য কাপড়-চোপড় ও হাদিয়া-তোহফা নিয়ে আসা হয়, এসব সুন্নাত পরিপন্থী ও পরিত্যাজ্য । বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, হযরত উসমান ইবনে আবিল আস রাযি. কে কোনো এক খতনার অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হলো, তখন তিনি তা গ্রহণ করলেন না। পরে যখন তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলো তখন তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে আমরা খাতনার দাওয়াতে যেতাম না এবং আমাদেরকে এর জন্য দাওয়াতও দেওয়া হত না। মুসনাদে আহমাদ হা.১৭৯০৮, তাবারানী কাবীর হা.৮৩৮১, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ হা. ৬২০৮

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে করণীয় কাজগুলি করার এবং বর্জনীয় কাজগুলি বর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।


তথ্য সূত্র:

  1. বুখারী ১/৭৭৭, মুসলিম ১/৪৬১
  2. ফাতহুল মুলহিম ৬/৪০৮
  3. বুখারী ১/৭৭৭, মুসলিম ১/৪৬১
  4. ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি খণ্ড-৫ কারাহিয়া অধ্যায়
  5. বুখারী ১/৭৭৭
  6. বুখারী ১/৭৭৭, মুসলিম ১/৪৬১
  7. ফাতাওয়া রহীমিয়্যাহ ২/৯১
  8. তাবারানী আউসাত হা.১৯৮১
  9. তাবারানী আউসাত হা. ৯৯৪
  10. রদ্দুল মুহতার- ৫/২১৩
  11. রদ্দুল মুহতার- ৫/২১৩
  12. ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ২/৯১
x

tiltony.com
tiltony.comhttp://www.tiltony.com
তিলটনি.কম একটি বাংলা ব্লগ সাইট। সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও পূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ কনটেন্ট প্রকাশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ওয়েবসাইটটি।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ‣ শিক্ষা ‣ স্বাস্থ্য ‣ জীবনযাপন ‣ পাঁচমিশালি ‣ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংবাদ পেতে ভিজিট করুন।
RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments