▶ প্রশ্ন: নাসখ কী? এর প্রকারভেদ। হাদিস দ্বারা কোরআন রহিত করা যাবে কিনা তা আলোচনা করুন? ▶ বিষয়: (IST-506) Principles of Islamic Jurisprudence ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাই তিনিই মানুষের কল্যাণ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন। তিনি কখনো একটি বিধান প্রবর্তন করেন, আবার মানুষের মঙ্গলের দিক চিন্তা করে তিনিই আবার সেই বিধান পরিবর্তন করে দেন। উসুলে তাফসীরের ভাষায় এটাকে নসখ বলে।
নসখ এর সংজ্ঞা
আরবী শব্দ নসখের আভিধানিক অর্থ রহিতকরণ, বাতিলকরণ, বন্ধ করন, দূরীকরণ, রদকরণ, স্থগিতকরণ। অর্থাৎ কারো ক্ষমতা বলে চলমান কোন আইনকানুন বা বিবি-বিধান প্রত্যাহার, পরিবর্তনকরণ, সংশোধন করাকে নসখ বলে।
পারিভাষিক অর্থে শরিয়তের কোন বিধানকে অন্য কোন শরিয়তের বিদানের মাধ্যমে রদ করে দেয়াকে নসখ বলে বা কোরআনের কোন আয়াতকে অন্য কোন আয়াত দ্বারা বাতিল করা বা কোন হুকুম কে অন্য কোন হুকুম দ্বারা বাতিল করে দেয়াকে নসখ বলে।
আরো পড়তে পারেন: ইজতিহাদ কী? এর প্রয়োজনীয়তা, শর্তাবলি এবং মুজতাহিদের যোগ্যতা ও গুণাবলি আলোচনা করুন?
এক্ষেত্রে যে ববিধানটিকে বাতিল করা হয় তাকে মানসুখ ও নতুন বিধানটিকে নসখ বলে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারা-এর ১০৬ নম্বর আয়াতে বলেন-
مَا نَنۡسَخۡ مِنۡ اٰیَۃٍ اَوۡ نُنۡسِہَا نَاۡتِ بِخَیۡرٍ مِّنۡہَاۤ اَوۡ مِثۡلِہَا ؕ اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
অর্থ: আমি কোন আয়াত রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান?
আল্লামা সাঈদ আহমেদ বলেন- “নসখ হল কোন শরয়ী হুকুমকে অন্য শরয়ী হুকুম দ্বারা বিলুপ্ত করা।
নসখের কারণ
আমাদের পূর্বের অন্য জাতীর উপড় আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছিল। যেমন ইহুদী জাতির জন্য মুসা নবীর উপড় এবং খ্রিস্টান জাতির জন্য ইসা নবীর উপর কিতাব নাযিল হয়েছিল। ইহুদীরা মনে করে আল্লাহর নির্দেশের নসখ হতে পারে না। যদি কোন নির্দেশ বাতিল হয় তাহলে ধরে নেয়া হয় আল্লাহর ভুল। নসখের উদ্দেশে ছিল আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা নয় প্রত্যেক যুগের চাহিদা অনুযায়ী সময় অনুযায়ী একটি আহকাম দেয়া। এটি অনেক ক্ষেত্রে এমন হয় যে পূর্ববর্তীকালের কষ্টকর কোন বিধান বাতির হয়ে জনসাধারনের জন্য কল্যাণকর ও সহজে পালনীয় নতুন বিধান চালু হয়। বর্তমান বিশ্ব মানুষে যদি শত বছরের পূর্বে আহকাম দেয় তাহলে বর্তমানের সাথে তাল মিলানো যাবে না। নাসখ হল নতুন বিধান যা পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের বা আমলের সময় নির্ধারণ করা হয় অর্থাৎ কতদিন এই আমল করতে হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিধান দিয়েছেন। তিনি জানেন যে এই বিধানের উপড় এতদিন পর্যন্ত আমল চলবে এরপর দ্বিতীয় বিধান দিবেন। কিন্তু বান্দাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা ভাবে দ্বিতীয় বিধান দ্বারা প্রথম বিধানকে পরিবর্তন করা হয়েছে।
আরো পড়তে পারেন: কিতাবুল্লাহ কী? এর প্রকারভেদ ও বিস্তারিত আলোচনা করুন?
নসখের প্রকারভেদ
নসখ প্রধানত চার প্রকারের হয়ে থাকে।
- কোরআন দ্বারা কোরআনের নসখ
- কোরআন দ্বারা হাদিসের নসখ
- হাদীস দ্বারা হাদীসের নসখ
- হাদীস দ্বারা কোরআন নসখ
কোরআন দ্বারা কোরআনের নসখ
এ ক্ষেত্রে কোরআনের পূর্ববর্তী একটি আইন পরবর্তী আইন দ্বারা রহিত হয় যেমন ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কে কোরআনে নাযিল হয়। সূরা নিসা এর ১৫নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَالّٰتِیۡ یَاۡتِیۡنَ الۡفَاحِشَۃَ مِنۡ نِّسَآئِکُمۡ فَاسۡتَشۡہِدُوۡا عَلَیۡہِنَّ اَرۡبَعَۃً مِّنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ شَہِدُوۡا فَاَمۡسِکُوۡہُنَّ فِی الۡبُیُوۡتِ حَتّٰی یَتَوَفّٰہُنَّ الۡمَوۡتُ اَوۡ یَجۡعَلَ اللّٰہُ لَہُنَّ سَبِیۡلًا
অর্থ: আর তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচারিণী তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চার জন পুরুষকে সাক্ষী হিসেবে তলব কর। অতঃপর যদি তারা সাক্ষ্য প্রদান করে তবে সংশ্লিষ্টদেরকে গৃহে আবদ্ধ রাখ, যে পর্যন্ত মৃত্যু তাদেরকে তুলে না নেয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোন পথ নির্দেশ না করেন।
এই আইনটি পরিবর্তীতে বাতিল করা হয়। যারা এ ধরণের মন্দ কাজ করবে তাদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা নূর এর ২নং আয়াত নাযিল হয়-
اَلزَّانِیَۃُ وَالزَّانِیۡ فَاجۡلِدُوۡا کُلَّ وَاحِدٍ مِّنۡہُمَا مِائَۃَ جَلۡدَۃٍ ۪ وَّلَا تَاۡخُذۡکُمۡ بِہِمَا رَاۡفَۃٌ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ۚ وَلۡیَشۡہَدۡ عَذَابَہُمَا طَآئِفَۃٌ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
অর্থ: ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।
কোরআন দ্বারা হাদীন নসখ
এক্ষেত্রে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -এর একটি নির্দেশ কিংবা কোন সুন্নাহ পবিত্র কোরআনের কোন আয়াত দ্বারা রহিত হয়। যেমন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদীনায় আসার পর তার নির্দেশে সবাই বাধ্যতামূলকভাবে আশুরার দিন রোজা রাখতো। তখন রমযানে রোজা রাখার বিধান নাযিল হয়নি। পরবর্তীতে এ নিয়ম বাতিল হয়ে যায় সূরা বাকারার ১৮৫নং আয়াত নাযিল হওয়ার মাধ্যমে। সেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
اِنَّ الصَّفَا وَالۡمَرۡوَۃَ مِنۡ شَعَآئِرِ اللّٰہِ ۚ فَمَنۡ حَجَّ الۡبَیۡتَ اَوِ اعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡہِ اَنۡ یَّطَّوَّفَ بِہِمَا ؕ وَمَنۡ تَطَوَّعَ خَیۡرًا ۙ فَاِنَّ اللّٰہَ شَاکِرٌ عَلِیۡمٌ
অর্থ: নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন গুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা কা’বা ঘরে হজ্ব বা ওমরাহ পালন করে, তাদের পক্ষে এ দুটিতে প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই। বরং কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিছু নেকীর কাজ করে, তবে আল্লাহ তা’আলার অবশ্যই তা অবগত হবেন এবং তার সে আমলের সঠিক মুল্য দেবেন।
এরপর থেকে উম্মতে মুহাম্মদীর উপর রমযান রোজা রাখার বিধান ফরয হল এবং বাধ্যতামূলকভাবে আশুরার রোজা রাখার নিয়মটি রহিত হয়ে গেলো।
সুন্নাহ দ্বারা সুন্নাহ নসখ
যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কোন নির্দেশ তাঁর আরেকটি নির্দ্দেশ দ্বারা বাতিল হয়ে যায়। যেমন- ইসলামের প্রথম দিকে কেউ রান্না করা খাবার খেলে রাসুল তাকে সালাত আদায়ের পূর্বে আবার ওযু করার নির্দেশ দিতেন। কিন্তু পরে তা রহিত হয়ে যায়। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন- রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দুটি নির্দেশের শেষেরটিতে আগুনে পাকানো বস্তু খাওয়ার পর ওযু ভঙ্গ না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ রান্না করা খাবার খেলে পুনরায় ওযু করার প্রয়োজন নাই।
হাদীস দ্বারা কুরআন নসখ
ইসলামী শরীয়াতে এ ধরনের নসখ বৈধ। কুরআনের বহু আম বিধানকে হাদীস দ্বারা খাস করা হয়েছে। যেমন- সালাতের রাকাআত ও পদ্ধতি, যাকাতের নিসাব ও পরিমাণ, হজের নিয়মাবলী ইত্যাদি। হাদীস দ্বারা কুরআন রহিতকরণ দুটি ধরন হতে পারে।
- মুতাওয়াতীর হাদীস: যখন কোন স্তরে হাদীস বর্ণনাকারি অনেক থাকে যারা মিথ্যা ব্যাপারে একমত হতে পারে না।
- খবরে ওয়াহেদ: যখন হাদীস বর্ণনাকারি একত্র থাকে।
(১) মুতাওয়াতীর হাদীস দ্বারা কোরআনের বিধান রহিত করার উদাহরণ হল সূরা বাকারার ১৮০নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-
کُتِبَ عَلَیۡکُمۡ اِذَا حَضَرَ اَحَدَکُمُ الۡمَوۡتُ اِنۡ تَرَکَ خَیۡرَۨا ۚۖ الۡوَصِیَّۃُ لِلۡوَالِدَیۡنِ وَالۡاَقۡرَبِیۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ۚ حَقًّا عَلَی الۡمُتَّقِیۡنَ ؕ
অর্থ: তোমাদের কারো যখন মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়, সে যদি কিছু ধন-সম্পদ ত্যাগ করে যায়, তবে তার জন্য ওসীয়ত করা বিধিবদ্ধ করা হলো, পিতা-মাতা ও নিকটাত্নীয়দের জন্য ইনসাফের সাথে পরহেযগারদের জন্য এ নির্দেশ জরুরী। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা সবকিছু শোনেন ও জানেন।
এ বিধানটি মুতাওয়াতীর হাদীস দ্বারা রহিত হয়েছে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক পাওনাদারের পাওনা (হক) নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং অংশীদারদের জন্য অসীয়ত করার বিধান নেই।”
(২) খবরে ওয়াহেদ দ্বারা কোরআনের বিধান রহিত করার সম্পর্কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মতামত থাকলেও অধিকাংশ ফকীহদের মতে এটি জায়েয নয়।
উপসংহার
সামগ্র মানবজাতির জন্য রহমত স্বরূপ মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন নাযিল করেছেন। এই কোরআনের মানুষের কল্যাণের জন্যই মহান আল্লাহর নির্দেশে হাদীস দ্বারা নসখ করা হয়েছে। অর্থাৎ সময়ের প্রয়োজনের আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কল্যাণের জন্য এই নসখের বিধান রেখেছেন। তাই নসখ আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence •