Monday, December 23, 2024

নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অবদান মুল্যায়ন করুন।

প্রশ্ন: নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অবদান মুল্যায়ন করুন।বিষয়: (IST-503) Al-Sirat Al-Nababiahকোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)



ভূমিকা

নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে আলোচনা সমালোচনার শেষ নেই। পৃথিবীতে ইসলামই সর্বপ্রথম নারীর যথাযোগ্য সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইসলাম পূর্বযুগে মানুষ নারীদের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করতো। কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাদেরকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। সমাজে নারী জন্ম নেয়া ছিল অভিশাপ স্বরূপ। সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শিক্ষা ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে, পারিবারিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এভাবে প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিশ্চিত করেছেন নারীর সম্মান, মর্যাদা ও পূর্ণ অধিকার।

নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অবদান

নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অবদান বিস্তৃত ও অনস্বীকার্য। নিচে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-


আরো পড়তে পারেন: খন্দক যুদ্ধ কী? খন্দক যুদ্ধের বিবরণ দিন।


কন্যা হিসাবে নারীর অধিকার

ইসলাম পূর্ব জাহেলিয়াতের যুগে কন্যা সন্তান কে অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তারা ছিল লাঞ্ছনা ও অবমাননার পাত্র। তখনকার সময়ে সমগ্র আরব ভূখন্ডে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে রাখতে সামান্য দ্বিধাবোধ করত না। কারো কন্যা সন্তান ভুমিষ্ট হলে কন্যার পিতা-মাতা লজ্জায় শির অবনত করে রাখতো। এই কন্যাকে বিয়ে দিয়ে তাদেরকে অন্য কোন গোত্রের কাছে সারাজীবন নত হয়ে থাকতে হবে। বর্বরতার এই চরম মুহূর্তে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এসে কন্যা সন্তান তথা নারীকে কে ধ্বংসের অতল গহবর থেকে টেনে তুলে তাদের সম্মান ও মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন করার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানান। নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম যার প্রথম সন্তান কন্যা।” তিনি আরো বললেন, যে ব্যক্তি দুটি কন্যা সন্তানকে লালন পালন করে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে, কিয়ামতের দিন আমি এবং সে হাতের দুটি আঙ্গুলির ন্যায় পাশাপাশি থাকব।

স্ত্রী হিসাবে নারীর অধিকার

ইসলাম পূর্বযুগে নারীদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। তখন স্ত্রীদের দাসী হিসেবে মনে করা হতো। ভোগবিলাসের বস্তু ছাড়া নারীকে আর কিছুই মনে করা হতো না। সেসময় একমাত্র ইসলাম নারী জাতিকে মর্যাদা ও মর্যাদার উচ্চ আসনে স্থান দিয়েছে। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্ত্রী ও নারীদের সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। তিনি বলেন, “পৃথিবীর বস্তুসমূহের মধ্যে নারী ও সুগন্ধি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং নামাজ আমার চোখের শীতলতা।” হযরত বিন ওমর বলেন, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে পর্যন্ত জীবিত ছিলেন সে পর্যন্ত আমরা আমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতাম। যাতে আমাদের উপর কোন শাস্তিমূলক বিধান অবতীর্ন না হয়। নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইন্তেকালের পর আমরা প্রাণ খুলে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগলাম। নারী জাতির মর্যাদা ও অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতিদ্বন্ধী আর কিছু নেই।


আরো পড়তে পারেন: মক্কা বিজয়ের বিবরণ দিন এবং এর ফলাফল আলোচনা করুন


মা হিসাবে নারীর অধিকার

মা হিসাবে ইসলাম নারীদের যে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম, দল বা গোষ্ঠী তা দিতে পারেনি। রাসূলে করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর আগমনের পূর্বে সমস্ত দুনিয়ার মানুষই পিতাকে মাতার চেয়ে বেশি সম্মানের পাত্র বলে মনে করত। এ বিষয়ে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “সন্তানের জান্নাত হল তার মায়ের পায়ের নিচে।” একদা জনৈক সাহাবী রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল আমার নিকট থেকে সবচেয়ে বেশি সদ্ব্যবহার পাওয়ার হকদার কে? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। তিনি আবার বললেন, তারপর কে? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তরে বললেন, তোমার মাতা। তিনি আবার বললেন, তারপর কে? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তরে বললেন, তোমার মাতা। চতুর্থবার সাহাবী একই প্রশ্ন করলে উত্তরে বললেন, তোমার পিতা। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম মা তথা নারী জাতিকে কত উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন।

নারীর শিক্ষার অধিকার

মানব শিশু জন্মের পর থেকে প্রথমেই সে মায়ের মুখের ভাষা শেখে। মায়ের কথা বলার ধরণ, আচার-আচরণ, নৈতিকতা এমনকি তার মতই শিষ্টতা সম্পন্ন হয়। এজন্য দ্বীন ও পার্থিব শিক্ষা লাভ করার জন্য তাকে শুধু অনুমতিই দেয়া হয় নি; বরং পুরুষের শিক্ষা-দীক্ষা যেমন প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছে, তাদের শিক্ষা-দীক্ষাও তদ্রুপ মনে করা হয়েছে। নবী করি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “প্রত্যেক মুসলমান নর নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।” মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর স্ত্রী হাফসা বিনতে উমরকে লিখন পদ্ধতি শিক্ষা দেয়ার জন্য শেফা বিনতে আবদুল্লাহকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি কৃতদাসীদেরকেও শিক্ষার সুযোগ দিতে আদেশ করেছেন।


ডাউনলোড করুন তাফসীরের কিতাবসমূহ


অর্থনৈতিক অধিকার

ইসলাম পূর্ব যুগে নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিক হওয়া থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু ইসলাম নারীকে দিয়েছে উত্তরাধিকারের পূর্ণ অধিকার। এর বাইরে ইসলামী শরীয়তে সীমার মধ্যে থেকে অর্থনৈতিক ব্যাপারে শ্রম সাধনা করার অনুমতি রয়েছে নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই। ইসলাম ব্যতীত সকল আইন কানুন নারীকে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে দূর্বল করে রেখেছে। এমনকি ইউরোপে উনবিংশ শতাব্দিতেও নারীর বৈধ অধিকার স্বীকৃত ছিল না। কোন বিবাহিত রমনী স্বামীর অনুমতি ব্যতীত সম্পত্তির মালিক হতে পারত না। সম্পত্তি সংক্রাত বিষয়ে চুক্তি বা ক্রয় বিক্রয় করতে পারত না। অথচ ইসলামই দিয়েছে তার একমাত্র অর্থনৈতিক মুক্তির চূড়ান্ত অধিকার। যা অন্য কোন ধর্ম দেয়নি।

নারীর বিবাহের অধিকার

বিবাহের ব্যাপারে ইসলাম মেয়েদের দিয়েছে পূর্ণ অধিকার। মেয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হলে পিতা মাতা তার সম্মতি সাপেক্ষে বিয়ের ব্যবস্থা করবে। ইসলামী বিধান এই যে, নারী বিধবা হোক বা কুমারী হোক তার সম্মাত ব্যতীত তাকে বিয়ে দিতে পারে না। খানসা বিনতে খাজাম আনসারিয়ার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তার পিতা তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিলে তিনি মহানবীর নিকট নালিশ করেন। মহানবী এ বিয়ে বাতিল করে দেন। একজন কুমারী মহানবীর দরবারে এসে নিবেদন করল, “আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন এতে আমি সন্তুষ্ট নই”। মহানবী তাকে বললেন, “তোমার ইচ্ছা হলে বিয়ে বহাল রাখতে পার অথবা বাতিল করেও দিতে পার।” এ থেকে বোঝা যায় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুধু নারী সম্পর্কে পুরুষের নয় বরং নারীরও মনোবৃত্তির পরিবর্তন করে দিয়েছেন এবং তাকে তার পূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যের অধিকার দিয়েছেন।



মত প্রকাশ ও পরামর্শের অধিকার

ইসলামের পূর্ব যুগে মহিলাদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু ইসলাম সমাজ জীবনের বিভিন্ন ব্যাপারে মেয়েদের অভিমত প্রকাশের অবাধ অধিকার দিয়েছে। হযরত হাসান বসরী বলেছেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মেয়েদের সাথেও পরামর্শ করতেন এবং কোন কোন সময় তাদের অভিমত গ্রহণ করতেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির একটা শর্ত ছিল এমন- এই বছর মুসলমানরা উমরা না করেই ফিরে যাবে। তাই রাসূল করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কে হুদায়বিয়াতেই ইহরাম খুলে ফেলা ও সঙ্গে করে নিয়ে আসা পশুগুলোকে জবাই করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা এই শর্তে মর্মাহত হয়েছিলেন বলে কেউ এই নির্দেশ পালনে তেমন তৎপরতা দেখালেন না। এরূপ অবস্থা দেখে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হযরত উম্মে সালমা (রা.) এর নিকট আবেগ প্রকাশ করলেন। উম্মে সালমা পরামর্শ দিলেন যে, আপনি এর পর আর কাউকে কিছু না বলে যা কিছু করার নিজেই অগ্রসর হয়ে করে ফেলুন। দেখবেন, সকলেই আপনার দেখাদেখি সব কাজই করবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং যখনই তিনি করণীয় সব কাজ করলেন সাহাবা কেরামরাও তার অনুসরণ শুরু করে দিলেন।



উপসংহার

প্রকৃত নারী স্বাধীনতা বলতে যা বুঝায় তা ইসলামের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-ই নারীজাতিকে প্রদান করেছেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “তাকওয়া ব্যতীত বংশগত ও প্রকৃতিগতভাবে এক শ্রেণীর উপর অপর শ্রেণীর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। পবিত্র কুরআন ন্যায় নিষ্ঠা, শান্তি সমৃদ্ধি এবং ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণে যে মানদন্ড পুরুষের জন্য নির্ধারিত করেছে, তা নারীর জন্যও নির্ধারিত করেছে। সুতরাং নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অবদান অপরিসীম।


• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence


বিগত বছরের প্রশ্নসমূহ (এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ)

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,606FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles