হযরত মাওলানা থানভী (রঃ)-এর বংশ পরিচয়
আগ্রা-অযোধ্যা যুক্তপ্রদেশের মুজাফফর নগর জেলার অন্তর্গত প্রসিদ্ধ শহর থানাভবনে ফারূকী বংশের চারিটি গোত্রের লোক বসবাস করিতেন। তন্মধ্যে খতীব গোত্রই ছিল অন্যতম। থানাভবনে সুলতান শিহাবুদ্দীন ফর্রূখ-শাহ্ কাবুলী ছিলেন হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর উর্ধ্বতন পুরুষ। থানা ভবনে এই বংশে বিশিষ্ট বুযুর্গ ও ওলীয়ে কামেলগণ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। সুতরাং হযরত থানভীর পিতৃকুল হইল ফারুকী। হযরত মুজাদিদে আলফেসানী, শায়খ জালালুদ্দীন থানেশ্বরী, শায়খ ফরীদুদ্দীন গঞ্জেশকর প্রমুখ খ্যাতনামা বুযুর্গগণ এই বংশেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।
হযরত মাওলানা থানভী (রঃ)-এর পিতা জনাব মুন্সি আবদুল হক ছাহেব ছিলেন একজন প্রভাবশালী বিত্তবান লোক। তিনি খ্যাতনামা দানশীল ব্যক্তি এবং ফার্সী ভাষায় একজন উচ্চস্তরের পন্ডিতও ছিলেন। এতভিন্ন তিনি একজন বিচক্ষণ, দূরদর্শী এবং উচ্চ শ্রেণীর সাধক ছিলেন। তাহার মাতৃকুল ছিল ‘আলাভী” অর্থাৎ, হযরত আলীর বংশধর। হযরত মাওলানা থানভীর জননী ছিলেন একজন দ্বীনদার এবং আল্লাহ্র ওলী। উচ্চস্তরের বুযুর্গ ও ওলীয়ে কামেল গীরজী শ্রমদাদ আলী ছাহেব ছিলেন তাহার মাতুল। তাহার মাতামহ (নানা) মীর নজাবত আলী ছাহেব ছিলেন ফার্সী ভাষায় সুপন্ডিত ও প্রসিদ্ধ প্রবন্ধকার। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল তাহার একটি বিশেষ গুণ। তিনি মাওলানা শাহ্ নেয়ায আহমদ বেরলভীর জনৈক বিশিষ্ট খলীফার মুরীদ ছিলেন। খ্যাতনামা বুযুর্গ হাফেষ মোর্তজা ছাহেবের সহিতও তাহার আধ্যাত্মিক যোগ-সম্পর্ক ছিল বলিয়া তিনি বেলায়তের দরজায় গৌঁছেন। এমন উচ্চ মর্যাদাশীল পার্থিব ঐশ্বর্যে ধনবান, সাথে সাথে ধর্মপরায়ণতার সহিত নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল, এমন একটি সম্ভান্ত ও প্রখ্যাত বংশে হাকীমুল উন্মত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, জামেয়ে শরীয়াত, বেদআত ও রসুমাৎ এর মূল উৎপাটনকারী শাহ্ ছুফী হাজী হাফেয হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী চিশ্তী হানাফী জন্মগ্রহণ করেন। হযরত মাওলানা ছিলেন দূরদর্শী, দৃঢ়চেতা, স্বাবলম্বী, সত্যপ্রিয়, খোদাতীর, ন্যায়পরায়ণ প্রভৃতি মানবীয় গুণে গুণান্বিত। এই মহৎ গুণাবলী তিনি হযরত ওমর ফাঁরক রোঃ) হইতে পৈতৃকসূত্রে লাভ করিয়াছিলেন। আর মা’রেফাত বা আধ্যাত্মিকরূপ অমূল্য রত্ন লাভ করেন মাতৃকুল অর্থাৎ, হযরত আলী (রা.) হইতে।
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা থানভী জন্ম বৃত্তান্ত
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা থানভীর জন্ম বৃত্তান্ত অলৌকিক ঘটনার সহিত জড়িত। তাহার পিতার কোন পুত্র সন্তানই জীবিত থাকিত না। তদুপরি তিনি এক দূরারোগ্য চর্মরোগে আক্রান্ত হইয়া চিকিৎসকদের পরামর্শে এমন এক ঔষধ সেবন করেন যাহাতে তাহার প্রজনন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে রহিত হইয়া যায়। ইহাতে হাকীমুল উম্মতের মাতামহী নেহায়েত বিচলিত হইয়া পড়েন। একদা তিনি হাফেয গোলাম মোর্তজা ছাহেব পানিপতীর খেদমতে এ বিষয়টি আরয করেন। হাফেয ছাহেব ছিলেন মজযুব। তিনি বলিলেন, “ওমর ও আলীর টানাটানিতেই পুত্র-সন্তানগুলি মারা যায়। এবার পুত্র-সন্তান জন্মিলে হযরত আলীর সোপর্দ করিয়া দিও। ইনশাআল্লাহ জীবিত থাকিবে ।” তাহার এই হেয়ালী কেহই বুঝিতে পারিলেন না। পূর্ণ কথার সারমর্ম একমাত্র মাওলানার বুদ্ধিমতী জননীই বুঝিলেন আর তিনি বলিলেন, হাফেয ছাহেবের কথার অর্থ সম্ভবতঃ এই যে, ছেলেদের পিতৃকুল ফারুকী, আর আমি হযরত আলী (রাঃ)-এর বংশধর । এযাবৎ পুক্র-সন্তানদের নাম রাখা হইতেছিল পিতার নামানুকরণে, অর্থাৎ হক্ শব্দ যোগে রাখা হইয়াছিল। যেমন আবদুল হক, ফজলে হক ইত্যাদি। এবার পুত্র-সন্তান জন্মিলে মাতৃকুল অনুযায়ী নাম রাখিতে- অর্থাৎ আমার উধ্বতন আদিপুরুয হযরত আলী (রাঃ)-এর নামের সহিত মিল রাখিয়া, নামানুকরণ এর কথা বলিতেছেন। ইহা শুনিয়া হাফেয সাহেব সহাস্যে বলিয়া উঠিলেন, বাহবা! মেয়েটি বড়ই বুদ্ধিমতী বলিয় মনে হয়। আমার উদ্দেশ্য ইহাই ছিল। ইহার গর্ভে দুইটি ছেলে হুইবে। ইনশাআল্লাহ্ উভয়ই বাঁচিয়া থাকিবে এবং ভাগ্যবান হইবে। একজনের নাম রাখিবে আশরাফ আলী, অপরজনের নাম রাখিবে আকবর আলী। একজন হইবে আমার অনুসারী, সে হইবে আলেম ও হাফেয। অপরজন হইবে দুনিয়াদার। বস্তুতঃ তাহাই হইয়াছিল। আল্লাহ্ পাক এক বুযূর্গের দ্বারা হযরত থানভী মাতৃ-গর্ভে আসার পূর্বে অর্থাৎ আলমে আরওয়াহে থাকাকালীন তাহার নাম রাখাইয়া দিলেন। আল্লাহ্ পাকের কত বড় মেহেরবানী! কত বড় সৌভাগ্যের কথা!
মাওলানা থানভীর জন্ম
হিজরী ১২৮০ সনের ৫ই রবিউস সানী বুধবার ছোবহে ছাদেকের সময় হাকীমুল উম্মত জন্মগ্রহণ করেন। হাফেয গোলাম মোর্তজা সাহেবের নির্দেশক্রমে নবজাতের নাম রাখা হইল “আশরাফ আলী”। তাহার জন্মের ১৪ মাস পরে তাহার ছোট ভাই আকবর আলীর জন্ম হয়। থানা ভবনের অধিবাসী বলিয়া তাহাকে থানভী বলিয়া অবিহিত করা হয়।
মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর বাল্যকাল
মাওলানার পাঁচ বসর বয়সকালে তাহার পুণ্যশীলা প্লেহময়ী জননী পরলোক গমন করেন; সুতরাং শিশুকালেই দুই ভাই মাতৃন্সেহ হইতে বঞ্চিত হইলেন। কিন্তু পিতা জননীর ন্যায় স্নেহমমতায় উভয় শিশুর লালন-পালন ও তা’লীম তরবীয়তের ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন। তিনি উভয়কেই খুব স্নেহ করিতেন। স্বহস্তে গোসল করাইতেন, স্বহস্তে খাওয়াইতেন। পিতার অত্যধিক আদর যত্নের কারণে শিশুরা মায়ের বিচ্ছেদ-বেদনার কথা কখনও অনুভব করিতেই পারে নাই।
শৈশব হইতেই হযরত হাকীমুল উম্মতের চাল-চলন ও আচার-ব্যবহার ছিল পাক-পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন। তিনি কখনও বাহিরের ছেলেদের সহিত খেলাধুলা করিতেন না। ছোট ভাই আকবর আলীকে নিয়া নিজ বাড়ীর সীমার মধ্যে খেলাধুলা করিতেন। খেলাধুলার সময় ধুলাবালি গায়ে বা কাপড়ে লাগিতে দিতেন না। সময়ে বৃষ্টিতে ভিজিয়া উভয় ভ্রাতা আনন্দ উপভোগ করিতেন। হযরত মাওলানা বাল্যকালে নেহায়েত শান্ত ও সুশীল ছিলেন। তাহার সু-মধুর ব্যবহারে বিধর্মীরাও তাহাকে অত্যন্ত স্নেহের চক্ষে দেখিত।
সাধারণতঃ ছেলেরা মসজিদে বা উৎসব উপলক্ষে শিরনী-মিঠাই ইত্যাদি পাইবার সুযোগ গ্রহণ করে। হযরত মাওলানার বিচক্ষণ ও দূরদর্শী পিতা ইহা আদৌ পছন্দ করিতেন না। তিনি বরং বাজার হইতে মিঠাই আনিয়া দুই পুত্রের হাতে দিয়া বলিতেন, মিঠাইয়ের জন্য মসজিদে যাওয়া বড়ই লজ্জার কথা। হযরত হাকীমুল উম্মতের মেধাশক্তিও ছিল অসাধারণ। বিদ্যালয়ের দৈনন্দিনের পাঠ সহজেই কণ্ঠস্থ করিয়া ফেলিতেন। কাজেই পিতা বা ওস্তাদগণ কেহই তাহাকে তিরস্কার বা ভৎসনা করার সুযোগ পাইতেন না; বরং ওস্তাদগণ তাহাকে আন্তরিক স্নেহ করিতেন।
তিনি ধর্মকর্মে অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। এজন্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই তাহাকে স্নেহ করিত। কেহই তীহার কাজের প্রতিবাদ করিত না। এমনকি অসন্তষ্টিও প্রকাশ করিত না। দেওয়ালী পুজার সময় মীরাটের ছাউনী বাজারের রাস্তার দুই ধারে সারি বাধিয়া অসংখ্য প্রদীপ জ্বালান হইত। তাহারা দুই ভাই রূমালের সাহায্যে বাতাস দিয়া একাধারে সকল প্রদীপ নিভাইয়া দিতেন। এজন্য কেহই তাহাদের কিছু বলিত না; এমনকি হিন্দুরাও কিছু বলিত না।
তিনি খেলার মধ্যে নামাযের অভিনয় করিতেন। সমপাঠীদের জুতাগুলিকে কেবলা মুখে সারি করিয়া সাজাইতেন এবং একটি জুতা সারির সম্মুখে স্থাপন করিয়া সঙ্গীদেরকে বলিতেন, দেখ দেখ, জুতাও জামাতে নামায পড়ে। এই বলিয়া বেশ আনন্দ উপভোগ করিতেন। ইহাতে বুঝা যায়, জামাতে নামায পড়ার প্রতি তাহার অন্তরে কত আকর্ষণ ও ভালবাসা ছিল। তিনি খেলাধুলায় অযথা সময় নষ্ট করিতেন না, বরং দো’আ দুরূদ পড়িতে থাকিতেন।
তাহার বয়স যখন ১২/১৩ বৎসর, তখন তিনি শেষ রাত্রে উঠিয়া তাহাজ্জুদের নামায পড়িতেন। গভীর রাত্রে একাকী নামায পড়িতে দেখিয়া তাহার চাচীআম্মা বলিতেন, তাহাজ্জুদের নামায পড়ার সময় তোমার এখনও হয় নাই, বড় হইলে পড়িবে। ইহাতে কোন ফল হইল না; বরং তিনি রীতিমত তাহাজ্জুদের নামায পড়িতে রহিলেন। চাচীআম্মা নিরুপায় হইয়া তাহাজ্জুদ নামাযে মশগুল থাকাকালীন তাহাকে পাহারা দিতেন। কারণ, ছেলে মানুষ গভীর রাত্রে একাকি ভয় পাইতে পারে।
ছোটবেলা হইতেই তিনি ওয়ায বা বক্তৃতা করিতে অভ্যস্ত ছিলেন। সময় সময় সওদা আনিবার জন্য তাহাকে বাজারে যাইতে হইত। পথিমধ্যে কোন মসজিদ দেখিতে পাইলে উহাতে ঢুকিয়া পড়িতেন এবং মিশ্বরে দাড়াইয়া খোত্বার ন্যায় কিছু পড়িতেন, অথবা কিছু ওয়ায নছীহত করিতেন। এরূপে তিনি ছোট বেলায়ই ওয়াযের ক্ষমতা অর্জন করিতে সক্ষম হন। ফলে তিনি উত্তরকালে বিখ্যাত ওয়ায়েয বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
হযরত হাকীমুল উন্মত যখন সবেমাত্র মক্তবের ছাত্র তখন কুত্বুল আকতাব হযরত মিয়াজী নূর মুহাম্মদ ছাহেবের খাছ খলীফা হযরত শায়খ মুহাম্মদ মুহাদেস (ইনি হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মনকীর পীর-ভাই) বলিতেন, এই বালক উত্তরকালে আমার স্থলাভিষিক্ত হইবে। হযরত হাকীমুল উন্মত বাল্যকালে যখন গৃহের বাহিরে যাইতেন, তখন আকাশের মেঘমালা তাহাকে ছায়া দিত। আল্লাহ্র ওলী এবং যথার্থ অর্থে “নায়েবে রসূল” হওয়ার ইহাই একটি উজ্জল নিদর্শন।
মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর একটি স্বপ্ন
হযরত হাকীমুল উন্মত বাল্যকালে একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্বপ্ন দেখেন। তিনি বলেন, স্বপ্নে আমি দেখিলাম, আমি মীরাটের যে বাড়ীতে থাকিতাম উহাতে উঠিবার দুইটি সিড়ি ছিল, একটি বড় ও একটি ছোট । “আমি দেখিলাম, বড় সিড়িটির একটি পিঞ্জিরায় দুইটি সুন্দর কবুতর । অতঃপর যেন চারিদিক সন্ধ্যার অন্ধকারে ছাইয়া গেল। তখন কবুতর দুইটি আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিল আমাদের পিঞ্জিরাটিকে আলোকিত করিয়া দিন। উত্তরে আমি বলিলাম, তোমরা নিজেরাই আলোকিত করিয়া লও ৷ তখন কবুতরদ্বয়, নিজেদের ঠোট পিঞ্জিরার সহিত ঘর্ষণ করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে খাচাটি এক উজ্জল আলোকে আলোকিত হইয়া গেল।
কিছুদিন পর এই স্বপ্নের কথা তিনি তাহার মামা ওয়াজেদ আলী সাহেবের নিকট ব্যক্ত করিলে তিনি ইহার তা’বীর এই করিলেন যে, কবুতর দুইটির একটি হইল “রূহ, অপরটি ‘নফস’। মোজাহাদা বা সাধ্য-সাধনার মাধ্যমে তাহাদিগকে নূরানী করিতে আবেদন করিয়াছিল। কিন্তু তোমার কথায় তাহারা নিজেরাই নিজেদেরকে নূরানী করিয়া লইল। ইহাতে বুঝা যায়, রিয়াফত ও মোজাহাদা ব্যতিরেকেই আল্লাহ্ পাক তোমার রূহ ও নফ্সকে উজ্জ্বল করিয়া দিবেন। কালে এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হইয়াছিল।
শৈশব হইতেই তিনি ছিলেন নাযুক তবিয়তের। তিনি কাহারো নগ্ন পেট দেখিতে পারিতেন না। অনাবৃত পেট দেখামাত্র তাহার বমি হইয়া যাইত। যে গৃহে কোন প্রকার তীব্র সুগন্ধ থাকিত তথায় তিনি ঘুমাইতে পারিতেন না আর দুর্গন্ধের তো কোন কথাই নাই। কোন জিনিস এলোমেলো দেখিলেই তৎক্ষণাৎ তাহার মাথা ব্যাথা আরম্ত হইয়া যাইত।
মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর শিক্ষা ব্যবস্থা
হযরত মাওলানা থানভী (রঃ) কোরআন মজীদ ও প্রাথমিক উর্দু, ফার্সী কিতাব মীরাটে শিক্ষা লাভ করেন। পরে থানা ভবন আসিয়া তদীয় মাতুল ওয়াজেদ আলী সাহেবের নিকট শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর আরবীতে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য ১২৯৫ হিজরীতে বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান “দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসায়” গমন করেন। মাত্র পাঁচ বৎসরেই দেওবন্দের শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া দেশে প্রত্যাগমন করেন। তখন তাহার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বসর। এই সময়ের মধ্যে এলমে হাদীস, এলমে তফসীর, আরবী সাহিত্য, অলংকার শাস্ত্র, সুক্ষ তজ্ঞান শাস্ত্র, সৌরবিজ্ঞান, দর্শন শাস্ত্র, ইসলামী আইন শাস্ত্র, নৈতিক চরিত্র বিজ্ঞান, মনসতত্ব বিজ্ঞান, মূলনীতি শাস্ত্র, প্রকৃতিবিজ্ঞান, উদ্ভিদ ও প্রাণীবিজ্ঞান, ইতিহাস ও যুক্তিবিজ্ঞান, আধ্যাত্মিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদি বাইশটি বিষয়ের জটিল কিতাবসমূহ অতি কৃতিত্বের সহিত অধ্যয়ন করেন। এ সময় তিনি “জের ও বম” নামে একটি মূল্যবান ফার্সী কাব্য রচনা করেন।
দেওবন্দে দুইটি স্বপ্ন
১। একবার তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, একটি কূপ হইতে রৌপ্য স্রোত প্রবাহিত হইয়া তাহার পিছনে পিছনে ধাবিত হইতেছে।
২। আর একবার তিনি দেখেন, জনৈক বুযুর্গ ও কোন এক দেশের গভর্ণর, এই দুই ব্যক্তি তাহাকে দুইখানা পত্র লেখেন। উভয় পত্রেই লেখা ছিল যে, আমরা আপনাকে মর্যাদা প্রদান করিলাম।” এ পত্রের একটিতে হযরত নবী করীম (দঃ)-এর নামের মোহর অঙ্কিত ছিল। উহার লেখাগুলি বেশ স্পষ্ট ও সুন্দর ছিল। অপর পত্রের মোহরের ছাপ অস্পষ্ট থাকায় পড়া যাইতেছিল না। হযরত মাওলানা এই উভয় স্বপ্ন দেওবন্দের প্রধান অধ্যক্ষ ও পরম শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ হযরত মাওলানা ইয়াকুব ছাহেবের নিকট ব্যক্ত করেন। প্রথম স্বপ্নের তা’বীরে মাওলানা বলিলেন, দুনিয়ার ধন-দৌলত তোমার পায়ে লুটইয়া পড়িবে, অথচ তুমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করিবে না। দ্বিতীয় স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বলিলেন, ইনশাআল্লাহ্ দ্বীন ও দুনিয়ায় তোমার যথেষ্ট মান-সম্মান হইবে। এ সময় উক্ত ওস্তাদ ছাহেব তাহার দ্বারা ফত্ওয়া লিখাইতেন। ওস্তাদের প্রতি তাহার প্রগাঢ় ভক্তি ছিল। তিনি ওস্তাদের যথেষ্ট খেদমত করিতেন। ফলে তিনি ছাত্র জীবনে “আশ্রাফুত্তালাবা” এবং কর্মজীবনে “আশ্রাফুল ওলামা” নামে খ্যাতি লাভ করেন। যেমনটি নাম তেমনি কাম।
দারুল উলুমের অধ্যয়ন শেষে কৃতী ছাত্রদের যথারীতি পাগড়ী পুরস্কার দেওয়া হয়। এ বৎসর কুতবে আ’লম হযরত মাওলানা রশীদ আহম্মদ গাঙ্গোহী ছাহেব (রঃ) স্বীয় পবিত্র হস্তে হযরত মাওলানা থানভীর মাথায় পাগড়ী বাধিয়া দিলেন। এ সময় মাদ্রাসার ওস্তাদদের নিকট তাহার প্রতিভার প্রশংসা শুনিয়া হযরত গাঙ্গোহী ছাহেব তাহাকে কতিপয় কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেন। হযরত মাওলানা এ সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করিলেন। এই প্রকার দুর্বোধ্য প্রশ্নের সঠিক উত্তর শুনিয়া হযরত গাঙ্গোহী ছাহেব মুগ্ধ হন এবং তাহার জন্য দো’আ করেন। ফলে তিনি শিক্ষা সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন জগতবরেণ্য আলেম হিসাবে প্রসিদ্ধ হইয়া পড়েন।
অধ্যাপনা
পাঠ্য জীবন শেষে ১৩০১ হিজরীতে কানপুর ফয়েযে “আম মাদ্রাসায় মাসিক পচিশ টাকা বেতনে অধ্যাপনার কাজ আরম্ভ করেন। হাদীস, তফসীর ও উচ্চস্তরের কিতাবসমূহ কৃতিত্বের সহিত পড়াইতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ায নসীহতের মাধ্যমেও জনগণকে মুগ্ধ করিয়া ফেলেন। এদিকে মধুর কণ্ঠস্বর গুরুগম্ভীর সম্বোধন, মার্জিত ভাষা ও অপূর্ব বর্ণনাভঙ্গী, অপর দিকে কোরআন হাদীসের সরল ব্যাখ্যা, মা’রেফাত ও তাছাউফের সৃক্ষ্ম বিষয়ের সহজ সমাধান; মোটকথা, ওয়াযের মাহফিলে অফুরন্ত ভান্ডার হইতে অভাবনীয় মূল্যবান তত্ব ও তথ্য বিকশিত হইতে থাকিত। ফলে শ্রোতৃবৃন্দের অন্তরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হইত। তাহার ভাষণ সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখা হইত।
জনসমাজে হযরত মাওলানার জনপ্রিয়তা দেখিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের মধ্যে আর্থিক স্বার্থ লাভের বাসনা জাগরিত হয়। তাহারা তাহার ওয়ায মাহফিলে মাদ্রাসার জন্য টাকা আদায় করার কথা হযরত মাওলানার নিকট ব্যক্ত করিলেন। হযরত মাওলানা এই উপায়ে চাঁদা সংগ্রহ করা এলমী মর্যাদার খেলাফ ও না-জায়েয মনে করিতেন। তাই তিনি মাত্রাসা কর্তৃপক্ষের আবেদন রক্ষায় অসম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। ইহাতে কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরস্পর নানাপ্রকার কানাঘুষা আরম্ত হইল। এ কথা তাহার কর্ণগোচর হইলে তিনি মাদ্রাসার কার্যে ইস্তিফা দেন এবং সরাসরি বাড়ী চলিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত করেন। এল্মে দ্বীন ও দর্শন শাস্ত্রে এমন বিজ্ঞ ব্যক্তি দুর্লভ ভাবিয়া জনাব আবদুর রহমান খান ও জনাব কেফায়াত উল্লাহ্ সাহেবদ্বয় মাসিক ২৫টাকা বেতনে উপকাপুরে অপর একটি মাদ্রাসায় অধ্যাপনার কাজের জন্য তাহাকে অনুরোধ করেন। এল্মে দ্বীনের খাতিরে হযরত মাওলানা তাহাদের অনুরোধ রক্ষায় সম্মত হন। উপকাপুর জামে মসজিদের নামানুসারে মাদ্রাসার নাম রাখিলেন জামেউল উলুম। আজও কানপুরে এই মাদ্রাসা বিদ্যমান আছে এবং তাহার স্মৃতি ঘোষণা করিতেছে।
তিনি একাধারে চৌদ্দ বৎসর জামেউল উলুমে এল্মে দ্বীন শিক্ষাদানে মশগুল থাকেন। অতঃপর ১৩১৫ হিজরীর ছফর মাসে স্থীয় মুর্শিদ শায়খুল আরব ও আজম কুতবে আ’লম হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মোহাজেরে মক্কী ছাহেবের অনুমতিক্রমে কানপুরের সংস্রব ত্যাগ করিয়া থানা ভবনে আসিয়া উম্মতে মুহাম্মদীয়ার সংস্কার সাধনে আত্মনিয়োগ করেন।
বুযূর্গগণের খেদমতে মাওলানা থানভী
আল্লাহ্র ওলীগণের প্রতি হযরত হাকীমুল উম্মতের ভক্তি ও মহব্বত ছিল অত্যন্ত গভীর তিনি বলিতেন, আল্লাহ্র ওলীদের নামের বরকতে রূহ সজীব এবং অন্তরে নূর পয়দা হয়। তিনি প্রায়ই বলিতেন, তরীকতের পথে আমি রিয়াহত ও মোজাহাদা করি নাই। আল্লাহ্ পাক যাহাকিছু দান করিয়াছেন সমস্তই শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ ও বুযুর্গানে দ্বীনের আন্তরিক দো’আ ও তাওয়াজ্জুর বরকতে পাইয়াছি।
যে মজযুব হাফেয গোলাম মোর্তাজার দো’আয় হযরত মাওলানার ইহজগতে আবির্ভাব হয় এবং ভাহার নামকরণ, “আশরাফ আলী” করেন, তিনি হযরত মাওলানাকে অত্যধিক স্নেহ করিতেন। বাল্যকাল হইতে তাহার অন্তরে খোদাপ্রেম বদ্ধমূল হওয়ার ইহাও অন্যতম কারণ বটে। যখন দেওবন্দে হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গোহী কুদ্দিসা সির্রুহু ছাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হয়, তখন তাহার পবিত্র নূরানী চেহারা দর্শনমাত্র তাহার হাতে বায়’আত হওয়ার প্রবল আকাক্ষা হযরত মাওলানা থানভীর অন্তরে জাগরিত হয়; কিন্তু ছাত্র জীবনে মুরীদ হওয়া সমীচীন নহে বলিয়া তাহার বাসনা পূর্ণ হয় নাই। ১২৯৯ হিজরীতে হজরত মাওলানা গঙ্গোহী ছাহেব (রঃ) হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ গমনকালে মাওলানা থানভী কুতবুল আক্তাব হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মোহাজেরে মক্কী ছাহেবের খেদমতে পত্রযোগে আবেদন করিলেন, তাহাকে বায়’আত করিবার জন্য যেন গঙ্গোহী ছাহেবকে বলিয়া দেন। যথাসময় পত্রের উত্তর আসিল। পত্রে লিখা ছিল, হযরত হাজী ছাহেব (রঃ) স্বয়ং তাহাকে মুরীদ করিয়াছেন। তখন তাহার বয়স মাত্র ১৯ বৎসর।
হযরত হাজী ছাহেব যখন, মক্কায় হিজরত করেন, তখন হযরত থানভী (রঃ) ভূমিষ্ঠই হন নাই। অন্তচক্ষু খুলিয়া গেলে স্থানকালের যাবতীয় পর্দা অপসারিত হইয়া যায়। আ’রেফ বিল্লাহ হযরত হাজী ছাহেব পবিত্র মক্কায় থাকিয়াই থানাভবনের এই মহামণিকে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। তিনি তখন তোমার বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়া আসিও।
১৩০১ হিজরী শাওয়াল মাস। হাকীমুল উম্মত কানপুর জামেউল উলুম মাদ্রাসায় অধ্যাপনা করিতেছেন। তাহার পিতা পবিত্র হজ্জ ক্রিয়া পালনের উদ্দেশ্যে মকী শরীফ গমনের জন্য প্রস্তুত হইলেন। স্নেহের পুত্র হাকীমুল উন্মতও তাহার সঙ্গী হইলেন। যথাসময়ে পিতা-পুত্র পবিত্র মক্কাভূমিতে হযরত হাজী ছাহেবের খেদমতে উপনীত হইলেন; ইহাই হইল তাহার সহিত হযরত মাওলানার প্রথম সাক্ষাৎকার। হাজী সাহেব হযরত মাওলানার দর্শন লাভ করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন এবং হাতে হাতে তাহার বায়আত করিলেন। তখন তাহার পিতাকেও বায়আত করিলেন। পিতা-পুত্র উভয়ে এক মুর্শিদের হাতে বায়’আত হইলেন। হজ্জের পর হযরত হাজী ছাহেব, হাকীমুল উম্মতকে ছয় মাস তাহার খেদমতে অবস্থান করিতে বলিলেন; কিন্তু পিতার মন স্নেহের পুত্রকে একা দূরদেশে রাখিয়া যাইতে চাহিল না। অগত্যা হযরত হাজী ছাহেব বলিলেন, পিতার তাবেদারী অগ্রগণ্য, এখন যাও, আগামীতে দেখা যাইবে।
হজ্জ হইতে প্রত্যাগমন করিয়া কানপুরে অধ্যাপনা, গ্রন্থ রচনা, তবলীগ, ফতওয়া প্রদান ইত্যাদি কার্যে পুনরায় আত্মনিয়োগ করিলেন। এদিকে মুর্শিদের সহিত পত্র বিনিময় হইতে লাগিল। তিনি প্রায় সহস্রাধিক গ্রন্থ রচনা করেন।
১৩০৭ হিজরী হইতে হযরত মাওলানার নূতন জীবন আরম্ত হইল। পার্থিব সংস্রব অপেক্ষা আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে তাহার মন ধাবিত হইল। হযরত হাজী ছাহেবের খেদমতে মাদ্রাসার সম্পর্ক ছিন্ন করার অনুমতি প্রর্থনা করিয়া পত্র লিখিলেন। উত্তর আসিল, আল্লাহ্র বন্দাদেরকে দ্বীনের ফায়েয পৌঁছান আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উপায়। শ্রদ্ধেয় মুর্শিদের পরামর্শ শিরোধার্য। তাই এল্মে দ্বীন শিক্ষা প্রদানের কাজ চালু রাখিলেন। এইভাবে তিনটি বৎসর অতীত হওয়ার পর হিজরী ১৩১০ সালে হযরত মাওলানার ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গিয়া। অনেক চেষ্টা করিয়াও মনকে আর প্রবোধ দিতে পারিলেন না। আর মুর্শিদ বলিয়াছিলেন, “মিয়া আশরাফ আলী, ছয় মাস আমার নিকট থাক”। মুর্শিদের সেই আহ্বান তৎক্ষণাৎ হযরত মাওলানার অন্তরে দাগ কাটিয়া গিয়াছিল। এ একই কথা বার বার তাহার অন্তরে তোলপাড় করিতে লাগিল। কি অদৈম্য আকর্ষণ! অবশেষে দীর্ঘকাল প্রতীক্ষার পর মকা শরীফে গমনের অনুমতিপত্র আসিল। স্নেহের মুরীদ প্রাণপ্রিয় মুর্শিদের খেদমতে পৌঁছিয়া স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলিলেন এবং মুর্শিদের পদতলে নিজের সত্তা বিলীন করিয়া দিলেন। মুর্শিদও আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেন। অতি অল্প দিনের মধ্যেই পীর ও মুরীদ একই রং ধারণ করিলেন। হযরত হাজী ছাহেব নিঃসংকোচে ফরমাইতেন,
মিয়া আশরাফ! তুমি তো সম্পূর্ণ আমার তরীকার উপর। হযরত মাওলানার কোন লিখা তাহার দৃষ্টিগোচর হইলে বলিতেন, আরে তুমি তো আমারই মনের কথা ব্যক্ত করিয়াছ।
হযরত হাজী ছাহেবের খেদমতে মা’রেফত সম্বন্ধে কেহ কোন কথা জানিতে চহিলে তিনি হযরত মাওলানার দিকে ইঙ্গিত করিয়া বলিতেন, একে জিজ্ঞাসা কর, সে ইহা ভালরূপে বুঝিয়াছে। ইহার কারণ, মুর্শিদ বুঝিতে পারিয়াছিলেন, মুরীদের আধ্যাত্মিক উন্নতি পূর্ণতার স্তরে গৌঁছিয়াছে। ছয় মাসের মাত্র এক সপ্তাহ বাকী থাকিতে হযরত মাওলানা হাজী সাহেবের খেদমত হইতে বিদায়ের অনুমতি চাহিলেন তখন হাজী সাহেব তাকে খাছ করিয়া দুইটি অছিয়ত করিলেন। ১। মিয়া আশরাফ আলী! হিন্দুস্তান গিয়া তুমি একটি বিশেষ অবস্থার সম্মুখীন হইবে, তখন ত্বরা করিও না। ২। কানপুর হইতে মন উঠিয়া গেলে অন্য কোথাও সম্পর্ক স্থাপন করিও না; আল্লাহ্র উপর ভরসা করিয়া থানাভবনেই অবস্থান করিও। হিজরী ১৩১১ সনে প্রিয় জন্মভূমি থানাভবনের আহ্বান হযরত মাওলানাকে বিচলিত করিয়া তুলিল। অবশেষে শ্রদ্ধেয় মুর্শিদের ওছিয়ত ও আধ্যাত্মিক সম্পদসহ থানাভবনে আসিয়া হাজির হইলেন।
হযরত হাজী ছাহেব কেব্লা হযরত মাওলানাকে এত অধিক স্নেহ করিতেন যে, কেহ মাওলানার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে তিনি তাহাকে নাতি বলিয়া পরিচয় দিতেন। অত্যধিক স্নেহ বশতঃ তিনি তাহাকে “মিয়া আশরাফ’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। একবার মুর্শিদে আ’লা প্রিয়তম শিষ্যকে স্বীয় খাছ কুতুবখানা দিতে চাহিয়াছিলেন। হযরত মাওলানা আরয করিলেন, এই সব কিতাব তো আধ্যাত্মিকতার খোলস মাত্র, অনুগ্রহ করিয়া ইহার পরিবর্তে আমার সীনায় কিছু দান করুন। প্রিয়তম শিষ্যের এমন গভীর তত্তপূর্ণ আব্দার শুনিয়া মুর্শিদ বলিলেন, হা, সত্য বটে, কিতাবে আর কী আছে? সবই তো সীনায় রহিয়াছে। মুর্শিদের আন্তরিক দো’আয় মাওলানার অন্তঃকরণ এল্মে মা’রেফাতে ভরপুর হইয়া গেল। বিদায় গ্রহণকালে হযরত হাজী ছাহেব মুরাকাবা করিয়া বলিলেন, আশ্চর্য! ইহার সম্মান কাসেম ও রশীদকে অতিক্রম করিয়া গেল। বস্তুতঃ এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হইয়াছিল ।
মুর্শিদের খেদমত হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া হযরত মাওলানা দেশে ফিরিয়া আসিলেন। অতঃপর চিঠিপত্রের আদান-প্রদান চলিতে লাগিল। হযরত হাজী ছাহেব হাজীদের মারফৎ বলিতেন, “আমার মিহিন মৌলভীকে সালাম বলিও।” এই মিহিন শব্দে হযরত মাওলানার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার গুণাবলীর প্রতি ইঙ্গিত করিয়াছেন। পীর ও মুরীদের কী অপূর্ব সম্পর্ক, কী মায়া, কী ভক্তি!
হযরত মাওলানা দেশে ফিরিবার সময় কানপুরে বখশী নযীর হাসান ছাহেব স্বপ্নে দেখিলেন, নূরানী হইয়া উঠিয়াছে। কালে এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হইয়াছিল। দেশে আসিয়া পুনরায় তিনি জামেউল উলুমে অধ্যাপনার কাজে আত্মনিয়োগ করিলেন। শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে মা’রেফাতের আলো বিচ্ছুরিত হইল। এক কথায় মাদ্রাসা যিকির-আয্কারের খানকায় পরিণত হইল। বহু অমুসলিমও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া ধন্য হইল। চৌদ্দ বৎসর অধ্যাপনার পর হিজরী ১৩১৫ সালে কানপুর হইতে থানাভবনে আসিয়া খানকায়ে এমদাদিয়ার আবাদে মশগুল হইলেন। হযরত মাওলানার থানাভবনে আগমনের সংবাদে হযরত হাজী ছাহেব নেহায়েত খুশী হইয়া লিখিলেন, “আপনার থানাভবন যাওয়া অতি উত্তম হইয়াছে। আশা করি, আপনার দ্বারা বহু লোকের যাহেরী-বাতেনী উপকার হইবে এবং আপনি আমাদের মাদ্রাসা ও মসজিদ পুনঃ আবাদ করিবেন। আপনার জন্য দোআ করিতেছি।”
তিনি পার্থিব ধন-সম্পদের প্রতি জুক্ষেপ না করিয়া আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছায় থানাভবনে আসিলেন। আল্লাহ্ পাক তাহার দ্বারা উম্মতে মোহাম্মদিয়ার বিরাট কর্ম সম্পাদন করাইলেন। পাক-ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে দলে দলে বহু আলেম-ওলামা, অর্ধ শিক্ষিত; সকল শ্রেণীর লোকই তাহার দরবার হইতে ফয়েয হাসেল করিবার জন্য সমবেত হইত এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী তাহা লাভ করিত। হাকীমুল উন্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর ফয়েয ও বরকত ছিল বিভিন্নমুখী ও সুদুরপ্রসারী। সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় তাহা প্রকাশ করা সুদুরপরাহত। তাহার মধ্যে যে সব গুণাবলী বিদ্যমান ছিল, তাহা কয়েককজনে মিলিতভাবে অর্জন করাও সম্ভব নহে! তিনি একাধারে ছিলেন কোরআন পাকের অনুবাদক ও কোরআনের ব্যাখ্যাকার, মুহাদ্দিস, ফকীহ্, এবং একজন লেখক। তিনি প্রায় এক সহস্র কিতাব রচনা করিয়াছেন, তন্মধ্যে অনেক কিতাব বহু ভলিউমবিশিষ্ট তাহার রচিত প্রায় কিতাবই তাছাওউফে ভরপুর। তফসীরকার হিসাবে তিনি জগৎবিখ্যাত। তাহার কৃত তফসীর “তফসীরে বয়ানুল কোরআন” অদ্বিতীয়। ওয়ায়েয হিসাবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাহার তথ্যপূর্ণ বিভিন্নমুখী ওয়াযসমূহ ওয়াযের সময় সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ করা হইত এবং পত্র-পত্রিকায়ও মুদ্রিত হইত। পরে এইগুলি পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়। তাহার রচিত পুস্তকাবলী ও ওয়াযসমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হইয়াছে। তাহার রচিত কোন কিতাবের স্বত্ব সংরক্ষিত নহে। যে কেহ ছাপিতে পারে। কী অপূর্ব স্বার্থ ত্যাগ! বাংলা ভাষায় তাহার রচিত অসংখ্য কিতাব মুদ্রিত হইয়াছে ও হইতেছে। এল্মে দ্বীনের ওস্তাদ হিসাবে তিনি ছিলেন অদ্ধিতীয়। অসংখ্য আলেমে হক্কানী তাহার হাতে গড়া। এতদভিন্ন তিনি ছিলেন হক্কানী পীর ও মুর্শিদে কামেল।
তাসাওউফের দিক দিয়া তিনি ছিলেন মুজাদ্দিদে মিল্লাত বা যুগপ্রবর্তক। এক কথায়, তিনি ছিলেন মুজতাহিদ ও যুগসংস্কারক। অনেক ছুফী, পীর এল্মে তাছাওউফকে বিকৃত করিয়া তুলিয়াছিল। তিনি এই বিকৃত তাছাওউফকে ক্রুটিযুক্ত বশতঃ জগতবাসীর সামনে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন। তাহারই সৃষ্ট ব্যবস্থা ও চিকিৎসা দ্বারা তাছাওউফের ভ্রান্ত পদ্ধতির সংস্কার সাধিত হইয়াছে। বহু যোগ্য মুরীদকে খেরকায়ে খেলাফত দান করিয়াছেন। তাহার খলীফাগণের লক্ষ লক্ষ মুরীদ শুধু পাক-ভারতেই নহে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়াইয়া রহিয়াছে। (হায়াতে আশরাফ, সীরাতে আশরাফ দ্রঃ)
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর চির বিদায়
১৯শে জুলাই ১৯৪৩ ইং সোমবার দিবাগত রাত্রে এশার নামাযের পর তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাহার বয়স হইয়াছিল বিরাশী বৎসর তিন মাস এগার দিন। এন্তেকালের দুই দিন পূর্বে পাঞ্জাবের এক মসজিদের ঈমাম (সৈয়দ আনোয়ার শাহ্ কাশমীরীর শাগরিদ) স্বপ্নে দেখেন, আকাশপ্রান্তে ধীরে ধীরে লিখা হইতেছে (ইসলামের বাহু ভাঙ্গিয়া গিয়াছে)।
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর কারামত
- এক ব্যক্তি হাকীমুল উম্মতের জন্য আখের গুড় হাদিয়া স্বরূপ আনিল, কিন্তু তিনি উহা গ্রহণ করিলেন না। পরে জানা গেল যে, এ গুড় ছিল যাকাতের।
- কেহ হযরত হাকীমুল উম্মতের খেদমতে এছলাহের জন্য আসিলে তিনি তাহার গোপন রোগ ধরিতে পারিতেন এবং এ হিসাবে তাহার এছলাহ করিতেন। তাহার নিকট কোন রোগ গোপন রাখার উপায় ছিল না।
- তাহার কোন ভক্ত রোগারোগ্যের জন্য দোআ চাহিয়া পত্র লিখিলে লেখার সঙ্গে সঙ্গে নিরাময় হইয়া যাইত।
- তাহার জনৈক খলীফা বলেন, একদা আলীগড়ের শিল্প-প্রদর্শনীতে দোকান খুলিয়াছিলাম। মাগরিবের পর প্রদর্শনীর কোন এক স্টলে আগুন লাগে। আমি একাকী আমার মালপত্র সরাইতে সক্ষম হইতেছিলাম না। আকষ্মাৎ দেখিলাম, হযরত হাকীমুল উম্মত আমার কাজে সাহায্য করিতেছেন। ‘তাই আমার বিশেষ কোন ক্ষতি হয় নাই। পরে জানিলাম, হযরত তখন থানাভবনেই অবস্থান করিতেছিলেন।
- একবার তিনি লায়ালপুর স্টেশনে গাড়ীর অপেক্ষায় ছিলেন। ষ্টেশন মাষ্টার চাকরকে দরবারে পরের হক নষ্ট করা হইতে বাঁচিবার দো’আ করিলেন। মাষ্টারের মন মুহূর্তে পরিবর্তিত হইয়া গেল। তিনি চাকরকে তাহার নিজস্ব বাতি জ্বালাইয়া দিতে আদেশ করিলেন।
- কানপুরে কলিমুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির হামেশা অসুখ লাগিয়া থাকিত। আরবী “কিল্ম’ (অর্থ জখম) হইতে এই কলিমুল্লাহ্ নামের উৎপত্তি বলিয়া হযরত তাহার নাম রাখিয়া দিলেন ছলিমুল্লাহ। অতঃপর ব্যক্তির কোন অসুখ হইত না।
- একবার হযরত থানভী (রঃ) কানপুরে বাশমন্তীতে ওয়ায করিতেছিলেন। হঠাৎ ঝড় আসিল। হযরত তাহার শাহাদাত অঙ্গুলীতে ফুক দিয়া ঘুরাইলেন। তৎক্ষণাৎ ঝড়ের মোড় ঘুরিয়া অন্য দিকে চলিয়া গেল। ওয়াযের কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইল।
- মাওলানা হাকীম আবদুল হক বলেন, যে ব্যক্তি হযরতের দরবারে খাঁটি নিয়তে বসিত তাহার দিল আপনা হইতে পরিষ্কার হইয়া যাইত এবং ভ্রুত আখেরাতের দিকে মন আকৃষ্ট হইয়া পড়িত।
- একবার হযরত মাওলানা যাফর আহম্মদ ওসমানী সাহেব স্বপ্নে দেখিলেন, মদীনা শরীফের এক বুযুর্গ তফ্সীরে বয়ানুল কোরআনের তারীফ করিতে করিতে বলিলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার বার বলিতেছেন, অমুক আয়াতের তফসীর বয়ানুল কোরআনে এইভাবে লিখা আছে। হযরত ওসমানী সাহেব বলেন, আমার স্পষ্ট মনে পড়ে আমি হযরত (দঃ)-এর এই উক্তি নিজ কানে শুনিয়াছি। স্বপ্নে আমার ইহাও অনুভূত হইল যে, নবী করীমের দরবারে “বয়ানুল কোরআন” এরূপ মকবুল হওয়ার কারণ, হযরত মাওলানার পরিপূর্ণ এখলাছ।