Saturday, June 29, 2024
Homeশিক্ষামদিনা সনদের শর্তসমূহ উল্লেখ করুন৷ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক মদীনা রাষ্ট্র...

মদিনা সনদের শর্তসমূহ উল্লেখ করুন৷ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক মদীনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে এই সনদের গুরুত্ব বর্ণনা করুন

প্রশ্ন: মদিনা সনদের শর্তসমূহ উল্লেখ করুন৷ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক মদীনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে এই সনদের গুরুত্ব বর্ণনা করুনবিষয়: (IST-503) Al-Sirat Al-Nababiahকোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)



ভূমিকা

মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। তিনি মদিনা সনদ রচনা করে বিশ্বের বুকে সবার জন্য সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান প্রণেতা হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদায় স্মরণীয় হয়ে আছেন। এ সংবিধান পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় সংবিধান।

মদিনা সনদের পরিচয়

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি তাঁর রাজেনৈতিক দূরদর্শিতার দ্বারা অবলোকন করলেন যে, মদিনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী ইহুদী, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলিমদের মধ্যে সহাবস্থান এবং সম্প্রীতি স্থাপিত না হলে একটি সুসংহত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই তিনি এ চার জাতির লোক নিয়ে একটি ‘আন্তর্জাতিক সনদ’ রচনা করেন। এ সনদে ৪৭টি ধারা ছিল। এ সনদকেই “মদিনা সনদ” বা “The charter of madina” বলা হয়।

মদিনা সনদের শর্তসমূহ

মদিনার সনদে ৫২টি ধারা শর্ত ছিল। মদিনা সনদ সম্পর্কে আবু ওবাইদ “কিতার আল আমওয়াল”-এ বলেন- সামাজিক নিরাপত্তা, বিচার ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা, কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয় এবং বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ ক্ষমতা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর ন্যস্ত করা হয়। এ সনদ বলে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনার সর্বাধিনায়ক ছিলেন। মদিনা সনদের প্রধান প্রধান ধারাগুলো নিম্নরুপ-



  • মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদী, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলিমগণ মদিনা রাষ্ট্রে সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং একটি জাতি (উম্মাহ) গঠন করবে।
  • সনদ অনুযায়ী মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান এবং মদিনার সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হবেন।
  • মদিনা রাষ্ট্রের পূর্ণ স্বাধীনতা বজায় থাকবে। সকল শ্রেণীর লোক নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারবে।
  • মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী কোন পক্ষ মদিনার জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কোন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও বহিঃশত্রুর সঙ্গে আঁতাত করতে পারবে না।
  • সনদে স্বাক্ষরকারী কোন সম্প্রদায়কে বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে সকল সম্প্রদায়ের সমবেত শক্তির সাহায্যে সে বহিঃশত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।
  • সনদে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ বহিঃশত্রুর হামলার সময় স্ব স্ব সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করবে।
  • সনদে স্বাক্ষরকারীর সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। এজন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দোষী করা চলবে না।
  • মদিনাকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হল এবং রক্তপাত, হত্যা, বলাৎকারসহ অপরাপর অপরাধমূলক কার্যকলাপ চিরতরে নিষিদ্ধ করা হল।
  • অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সর্বপ্রকার পাপী ও অপরাধীকে ঘৃণার চোখে দেখতে হবে।
  • স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের কারো মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বিধানানুযায়ী তার মীমাংসা করবেন।
  • দুর্বল ও অসহায়কে সর্বোতাভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
  • মহনবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পূর্বসম্মতি ব্যতিরেকে মদিনাবাসীগণ কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
  • সনদে মক্কার কুরাইশগণকে সাধারণভাবে মদিনা রাষ্ট্রের শত্রু বলে ঘোষণা করা হয়। তাদেরকে বা তাদের সাহায্যকারীদেরকে সহায়তা নিষিদ্ধ করা হয়।
  • সনদে বলা হয় যে, প্রত্যেক গোত্র সম্মিলিতভাবে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ক্ষমতা কর্তৃত্ব মেনে চলবে। কিন্ত স্ব স্ব গোত্রীয় দলপতিদের গোত্রীয় প্রাধান্যও অক্ষুণ্ন থাকবে। প্রত্যেকটি গোত্র তাদের পূর্ববর্তী চুক্তিসমূহ এবং দেয় মৃত্যুপণ ও মুক্তিপণসমূহ এককভাবে প্রধান করবে। সেখানে মদিনা রাষ্ট্রের কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না।
  • সনদের শর্ত ভঙ্গকারীর উপর আল্লাহর অভিসম্পাতের কথা বলা হয়।

আরো পড়তে পারেন: বদর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা করুন


মদিনা সনদের গুরুত্ব

ইসলামের ইতিহাসে মদিনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক। যে সকল অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য মদিনা সনদকে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র বা সংবিধান বলা হয়, তা নিম্নরুপ-

  • সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান: ইতোপূর্বে সমগ্র বিশ্বের কোথাও বিধিবদ্ধ আইনের শাসন ছিল না। শাসকদের মুখোচ্চারিত বাণীই ছিল আইন। বিশ্বের ইতিহাসে মদিনার সনদই সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। এ প্রসঙ্গে ড. হামিদুল্লাহ বলেন, “মোট ৫২টি ধারাবিশিষ্ট এ সনদটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র।”
  • ইসলামি সাধারণতন্ত্রের ভিত্তি: এ সনদের দ্বারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়। রাষ্ট্র ও ধর্মের সহাবস্থানের ফলে ঐশীতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত মদিনা সনদই ইসলামি সাধারণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে।
  • উদারতার ভিত্তিতে জাতি গঠন: মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল ধর্ম ও জাতির ব্যাপারে যে উদার নীতি গ্রহণ করেন, তা বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। পরকত ও পরধর্ম অক্ষুণ্ন রেখে এ সনদ বৃহত্তম জাতি গঠনের পথ উন্মুক্ত করে।
  • ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি: এ সনদের ফলে মদিনা রাষ্ট্রে ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মূলত এ সনদই অদূর ভবিষ্যতের বিশ্বব্যাপী ইসলামি সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “মদিনা রাষ্ট্রেই পরবর্তী বৃহত্তম ইসলামি রাষ্ট্রে ভিত্তিমূল স্থাপন করে।”

আরো পড়তে পারেন: বিদায় হজের ভাষণের প্রধান দিকগুলো উল্লেখ করুন এবং এ ভাষণের গুরুত্ব তাৎপর্য আলোচনা করুন


  • মহানবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃতি: মদিনা সনদের বদৌলতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনা রাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তাঁর হাতেই ছিল মদিনার চূড়ান্ত চাবিকাঠি।
  • মদিনা রাষ্ট্রের সংহতি: এ সনদ সংঘর্ষ বিক্ষুদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন ইয়াসরিববাসীকে সুসংহত করে এবং মদিনা রাষ্ট্রের পুনর্গঠন, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধশালীকরণে বিরাট অবদান রাখে। মূলত এ সনদ ছিল রণ-উম্মাদ আরব জাহানের শান্তি ও সহাবস্থান এবং সম্প্রতি স্থাপনের এক মহাপরিকল্পনা। তাই ঐতিহাসিক ওয়েল হাইছেন বলেন, “এ সংবিধানই অরাজকতাপূর্ণ একটি নগরকে রাষ্ট্রের মর্যাদা উন্নীত করে।”
  • যুগান্তকারী মহানায়ক: মহানবী (স) যে নিছক একজন ধর্ম প্রচারকই নন; বরং বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক, কুটনীতিক ও বিপ্লবী মহাপুরুষ ছিলেন তা এ সনদে প্রমানিত হয়। ঐতিহাসিক উইলিয়াম ম্যুর এ প্রসঙ্গে বলেন যে, (the prophet) his real greatness-a master mind not only of his own age but of all ages” “হযরত (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরাট ব্যক্তিত্ব ও অপূর্ব মননশীরতা শুধু তৎকালীন যুগেরই নয়; সর্বযুগের ও সর্বকালের মহামানবের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।”
  • স্থিতিস্থাপক সংবিধান: মদিনার সনদটি ছিল খুবই স্থিতিস্থাপক। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দাশাতেই সমগ্র আরবের লোকেরা ইসলাম ধর্ম কবুল করে। সে দিনের নগর রাষ্ট্র পরিণত হয় একটি বিশাল বিস্তৃত সাম্রাজ্যের যা পরিবর্তিত প্রয়োজন মেটাতে সমর্থ হয়।
  • ইসলামের আন্তর্জাতিকতাবাদ: মদিনা সনদের মাধ্যমে ইসলামের আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রতি কামনা করে। প্রতিবেশীর ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মতবাদকে উদার মনোভাব নিয়ে সহ্য করতে মানুষ মাত্রকেই শিক্ষা দেয়। আন্তর্জাতিক মিলনক্ষেত্রে মুসলমান-অমুলমান সকলেরই সমান অধিকার, সমান কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে এ সনদ সচেতন করেছিল।


  • স্বদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকবচ: সনদে জন্মভূমি স্বদেশ রক্ষার জন্য মুসলমান-অমুসলমান সকলেরই সমান দায়িত্ব আরোপ করেছে। সকলকেই একযোগে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে হবে। নিজেদের মধ্যে কেউ বিদ্রোহী বলে বা শত্রুর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে সে যদি আপন সন্তানও হয়, তার ক্ষমা নেই। এর ফলে নতুন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আর কোন চিন্তা রইলো না।
  • শাসক-শাসিতের দায়িত্বানুভূতি: মদিনা সনদের এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলো যে শাসক ও শাসিত প্রত্যেকেই সমান দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে। এই সনদ শাসক ও শাসিতের দায়িত্বানাভূতি জাগ্রত করে আরবজাতিকে সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেছিল।
  • আইনের চোখে সবাই সমান: সকলের জন্য বিধি ও আইন সমানভাবে প্রযোজ্য। আইনের চোখে শাসক ও প্রজা উভয়েই সমান। তিনি নিজেই রাষ্ট্রীয় আইন এবং আল্লাহর হুকুম অকুণ্ঠভাবে মেনে চলেছেন। আর সকলকে সে আইনের অনুসরণ করতে বলেছেন।

উপসংহার

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সম্ভাব প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং শিশু রাষ্ট্রটির ভীতকে মজবুত করতে একটি সার্বজনীন সনদ প্রণয়ণ করেন। একে ‘মদিনার সনদ’ বলা হয়। এ সনদ সামাজিক নিরাপত্তা, বিচার ব্যাবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা, কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়, সর্বোপরি বিবাদ মিটমাটের সর্বোচ্চ ক্ষমতা নবীজীর উপর ন্যস্ত করাসহ সমুদয় বিষয় ছিল এর অন্তভূক্ত। এ সনদই বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র।



• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence

x

tiltony.com
tiltony.comhttp://www.tiltony.com
তিলটনি.কম একটি বাংলা ব্লগ সাইট। সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও পূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ কনটেন্ট প্রকাশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ওয়েবসাইটটি।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ‣ শিক্ষা ‣ স্বাস্থ্য ‣ জীবনযাপন ‣ পাঁচমিশালি ‣ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংবাদ পেতে ভিজিট করুন।
RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments