প্রশ্ন: খন্দক যুদ্ধ কী? খন্দক যুদ্ধের বিবরণ দিন | বিষয়: (IST-503) Al-Sirat Al-Nababiah | কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
৬২৭ সালের ৩১ মার্চ কুরাইশ, ইহুদি ও বেদুইনদের দশ হাজারের এক সম্মিলিত সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ান মদিনা আক্রমণ করে। মহানবী (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিন হাজার মুজাহিদের এক বাহিনী নিয়ে পরিখা কনন করে এর প্রহরায় নিযুক্ত ছিলেন। পরিখা খননের মাধ্যমে মদিনার রক্ষাব্যবস্থায় খোদাদ্রোহীরা বিস্মিত হয়। পরিখা অতিক্রম করে হামলা চালাতে ব্যর্থ হয়ে সম্মিলিত বাহিনী ২৭ দিন মদিনা অবরোধ করে রাখে। এ দীর্ঘ অবরোধকালে শত্রুদের মধ্যে খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং ঝড় ও প্রবল হিমেল হাওয়ায় তাদের তাঁবুগুলো উড়ে যায়। এমতাবস্থায় কুরাইশরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে অবরোধ প্রত্যাহার করে মক্কায় পলায়ন করে। এটাই ইসলামের ইতিহাসে খন্দকের যুদ্ধ।
খন্দকের যুদ্ধের কারণ
খন্দকের যুদ্ধ যে সকল কারণে সংঘটিত হয়েছিল তা হচ্ছে-
- মুসলিম উত্থানকে সমূলে ধ্বংস করার ইচ্ছা: উহুদ যুদ্ধে কাফিররা বিজয় লাভ করলেও মুসলিম উত্তানকে নিশ্চিত করতে পারেনি। এবার তারা সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়।
- ইসলামের প্রসার ও মদিনা রাষ্ট্রের শক্তিবৃদ্ধি: উহুদের বিপর্যয়ের পর মুসলিম শক্তি আরও সুসংহত হয়। একনিষ্টভাবে প্রচারের ফলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ সময় মদিনা রাষ্ট্রের শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তদুপরি মুদিনায় মুসলিম অধিপত্য বিস্তারের ফলে কুরাইশদের মক্কা-ইরাক বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়ে। এতে ইসলামদ্রোহী কুরাইশ ইহুদীরা আতংকিতবোধ করে এবং মুসলমানদের বিনাশ সাধনের জন্য যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। মুদিনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে আরবের সকল গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে।
- বেদুঈন গোত্রসমূহের হঠকারিতা: ইসলামের অগ্রযাত্রার কারণে আরব বেদুঈন গোত্রসমূহ চিরাচরিত লুটতরাজ অবাধে করতে না পেরে মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করে এবং কুরাইশদের সম্মিলিত বাহিনীতে যোগ দেয়। বেদুইন গোত্রগুলো প্রায় ৬,০০০ সৈন্য নিয়ে এ যুদ্ধে শরীক হয়।
- ইহুদিদের ষড়যন্ত্র: ইতঃপূর্বে বিশ্বাস-ঘাতকতার কারণে দু’টি ইহুদি গোত্র মদিনা হতে বহিষ্কৃত হয়েছিল। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ষড়যন্ত্র করে এবং ইসলামদ্রোহী উস্কে দেয়।
- মুনাফিকদের গোপন আঁতাত: মদিনায় অবস্থান করেও এক শ্রেণীর কপট মুসলমান কুরাইশদের সাথে সবসময় গোপনে আঁতাত করতো এবং এখানকার খবরাদি তাদের কাছে পৌছে দিতো। মুনাফিকরা প্রায়ই মদিনা আক্রমণ করতে কুরাইশদের আহ্বান জানাতো।
- আবু সুফিয়ানের প্রতিজ্ঞা রক্ষা: উহুদ যুদ্ধ শেষে আবু সুফিয়ান প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, পরের বছর তারা আবার মুসলমানদের সাথে শক্তি পরীক্ষা করবে। কিন্তু ঐ আস্ফালন কার্যে পরিণত হয়নি। কাজেই এখন যুদ্ধ করতে হলে অপেক্ষাকৃত ব্যাপক ও শক্তিশালী আয়োজন প্রয়োজন। এ কথা ভেবে আবু সুফিয়ান সারা আরবে একটি বিরাট বিদ্রোহ সৃষ্টির চেষ্টা করে। আবু সুফিয়ান উহুদে আস্ফালন করেছিল। কেননা, তা না করলে তার মুখ থাকে না। তাছাড়া আরব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল যা বলবে তা করেই ছাড়বে। না করলে কাপুরুষতা প্রকাশ পাবে। এজন্য তারা ব্যাপক আয়োজনে আরবের সকল গোত্রের লোক নিয়ে সম্মিলিত বাহিনী প্রস্তুত করে। এসব কারণে পঞ্চম হিজরি জিলকদ মাসে এ ভয়াবহ যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
আরো পড়তে পারেন: আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে কী বুঝ? অথবা, জাহেলিয়াতের যুগ কাকে বলে?
খন্দক যুদ্ধের ঘটনার বিবরণ
কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশ, বেদুঈন ও ইহুদীদের ১০ হাজার সৈন্যের এক সম্মিলিত বাহিনী মদিনার দিকে অগ্রসর হলে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের মোকাবেলায় যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেন। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসির পরামর্শক্রমে শত্রু মোকাবিলার উদ্দেশ্যে মদিনার চারপাশে ‘পরিখা’ বা খন্দক নির্মাণ করা হল। পরিখা বা খন্দক থেকে তেকেই এ যুদ্ধের নামকরণ করা হয়ে ‘খন্দক যুদ্ধ’। এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সম্মিলিত বাহিনী গঠন করা হয়েছিল বলে এক আজহাব-এর যুদ্ধও বলা হয়। এ যুদ্ধে কুরাইশদের বিপুল সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও তারা মুসলমাদের পরাজিত করতে পারেনি। খন্দক বা পরিকার সাহায্যে মুসলমানরা কুরাইশদের আক্রমণ প্রতিহত করে। মল্ল যু্দ্ধে কুরাইশ বীর আবদুদ, যাবার ও যুবাইরের পরাজয়ের পর সম্মিলিত আক্রমণ শুরু হয়। তবে মুসলমানদের দৃঢ় মনোবল ও ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধের কারণে কুরাইশ বাহিনী সাফল্য লাভে ব্যার্থ হয়। তদুপরি ত্রি-শক্তির মধ্যকার ঐক্যের অভাব, বিশার সম্মিলিত বহিনীর খাদ্য সংকট এবং সর্বোপরি প্রচন্ড শীত ও ঝড়ো হাওয়া প্রভৃতি কারণে সম্মিলিত বাহিনী মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। অবশেষে হতোদ্যম হয়ে সেনাপতি আবু সুফিয়ান অবরোধ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। ২৭ দিন অবরোধের পরও মদিনা আক্রমণ ব্যর্থ হয়ে কুরাইশরা মক্কায় প্রত্যাবর্তন করে।
খন্দকের যুদ্ধের ফলাফল
খন্দকের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল। এতদিন ধরে কুরাইশগণ যে আক্রমণকারীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, এবার তা শেষ হল। এ যুদ্ধে কুরাইশদের সামরিক শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পেল। তাদের সম্পদ নিঃশেষ হয়ে গেল। সম্মান বিনষ্ট হয়ে গেল এবং মিত্রশক্তিগণ ঘৃণায় তাদের দল ত্যাগ করে চলে গেল। খন্দকের যুদ্ধ হযরত (স) তথা মুসলমাদের পদমর্যাদা বাড়িয়ে দিল। হযরত মুহাম্মদ (স) শত্রুদের হাত হতে মদিনাকে রক্ষা করায় মদিনাবাসী তাঁকে একচ্ছত্র নেতা বলে সম্মান করতে লাগল। এস এম ইমামুদ্দীনের মতে, “সম্মিলিত বাহিনী ভাঙনের ফলে মক্কাবাসীদের সম্পূর্ণ পরাজয় প্রতিভাত হয়ে উঠে এবং তা মদিনায় মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় কলে। ইসলাম অল্প সময়ের মধ্যে আরবের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করে।
উপসংহার
কুরাইশরা ইসলামের অগ্রযাত্রা সহ্য করতে পারছিল না। এরা প্রথম থেকেই ইসলামকে এক ফুঁৎকারে নিবিয়ে দেয়ার জন্য বদর, উহুদ এ দু’টো রণাঙ্গণে মুখোমুখি হয়। কিন্তু তাতে ইসলামের শক্তি বা মর্যাদা এতটুকু ক্ষুন্ন না হয়ে বরং আরো বেশি প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। তারা সম্মিলিতভাবে সমস্ত আরব বেদুঈন গোত্রকে সাথে নিয়ে শেষবারের মত সাড়াঁশি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত নেয়। ৫ম হিজরির মাওয়াল মাসে কাফিরদের সম্মিলিত বাহিনী মদিনা আক্রমণ করে। মহনবী (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সীমিত শক্তিতে, অভিনব রণ কৌশল তাদের কোমাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ফলাফল হিসেবে খন্দকের যুদ্ধের মুসলমানরা বিজয় নিয়ে আসে।
• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence •