▶ প্রশ্ন: হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলি লিখুন এবং এর ফলাফল বর্ণনা করুন ▶ বিষয়: (IST-501) Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
হুদাইবিয়ার সন্ধি ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করে। এ সন্ধি আরবের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামকে বিস্তারের সুযোগ এনে দেয়। সাময়িকভাবে এই সন্ধি তথা এ সন্ধির শর্তাবলীকে কে ইসলামের স্বার্থ পরিপন্থী মনে হলেও মহান আল্লাহ একে ‘ফাতহুম মুবীন’ বা ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ তথা মহা বিজয় বলে অভিহিত করেন। তাই ইসলামের প্রচার ও প্রসারে হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব অপরিসীম।
হুদায়বিয়ার সন্ধি
ষষ্ঠ হিজরিতে নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ১৪০০ সাহাবী নিয়ে কা’বা ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কাভিমুখে রওয়ানা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে কুরাইশদের রণ প্রস্তুতির খবর শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হুদাইবিয়ার নামক স্থানে আল্লাহর নির্দেশে যাত্রা বিরতি দেন। এখানে উভয় পক্ষে আলোচনা করে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন। একে ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যদিও এর শর্তাবলীর অধিকাংশই মুসলমানদের বিপক্ষে ছিল, তবুও পবিত্র কুরআনের মহান আল্লাহ তায়ালা একে ‘ফাতহুম মুবীন’ বা ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। মূলত এ সন্ধিই মক্কা বিজয়ের পথকে সুগম করেছিল। এ বছর নবীজী বিভিন্ন দেশের প্রধানদের কাছে ইসলামের দাওয়াত প্রেরণ করেন। এই বছরই খালিদ ও আমর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তাবলী
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ শর্তাবলী নিম্নরূপ:
- মুসলিমগণ এই বছর (৬২৮ খ্রি.) হজ্জ না করেই মদিনায় প্রত্যাবর্তন করবে।
- পরের বছর হজ্জ করতে পারবে। তবে হজ্জ করতে এসে তিন দিনের বেশি সময় মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না। কুরাইশগণ ঐ তিনদিন মক্কা নগর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেবে।
- হজ্জ করতে এসে মক্কায় অবস্থানের সময় কেবলমাত্র আত্মক্ষার্থে কোষবদ্ধ তলোয়ার ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র মুসলমানগণ বহন করতে পারবে না।
- কুরাইশ ও মুসলিমদের মধ্যে সব ধরণের যুদ্ধ-বিগ্রহ আগামী দশ বছরের জন্য বন্ধ থাকবে।
- যে কোন আরব গোত্র কুরাইশ অথবা মুসলমানদের সঙ্গে যে কোন বিষয়ে পারস্পরিক চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে।
- কোন মক্কাবাসী পালিয়ে মদীনায় চলে আসলে মুসলমানরা তাকে অবশ্যই ফেরৎ পাঠাতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু মদিনাবাসী কেউ মক্কায় আসলে কুরাইশগণ তাকে মদিনায় ফেরৎ দিতে বাধ্য থাকবে না।
- হজ্জের সময় কুরাইশগণ মুসলমানদের জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা দেবে। বিনিময়ে মক্কার বণিকগণ নির্বিঘ্নে মদিনার পথ দিয়ে সিরিয়া-মিশর প্রভৃতি দেশে বাণিজ্য করতে পারবে।
- সন্ধির মেয়াদকালে জনসাধারণ পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে এবং একে অপরের কোন প্রকার ক্ষতি, লুন্ঠন ও আক্রমণ করবে না।
- হুদাইবিয়ার সন্ধি দশ বছরের জন্য স্থায়ী হবে।
- এই সন্ধির শর্তাবলী উভয় পক্ষ নিজ নিজ দায়িত্বে যথাযথভাবে প্রতিপালন করবে।
হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলাফল
ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ঘটনা। নিম্নের তার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ উল্লেখ করা হলো-
১. হুদায়বিয়ার সন্ধি- মহা বিজয়
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলী আপাত দৃষ্টিতে মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী মনে হলেও এরই মধ্যে নিহিত ছিল মুসলমানদের নিকট ভবিষ্যতের মক্কা বিজয়সহ বিশ্ব-বিজয়ের মন্ত্রবাণী। এজন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে একে “ফাতহুম মুবীন” বা মহাবিজয় হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
২. রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় মর্যাদা বৃদ্ধি
এ সন্ধি মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং প্রথমবারের মত তাদেরকে একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় রাজনৈতিক সংস্থা রূপে লিখিতভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ইমামুদ্দীন বলেন, “চুক্তিটি মুসলমানদেরকে একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় রাজনৈতিক সংস্থারূপে স্বীকৃতি দেয়।”
৩. যুদ্ধাবসান
সন্ধির ফলে ক্রমাগত যুদ্ধংদেহী মনোভাবের অবসান ঘটে। ঐতিহাসিক হিট্টির মতে- “এ সন্ধি নিজ গোত্র কুরাইশদের সঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর যুদ্ধ বিরতির সূচনা করে। ফলে মহানবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নেতৃত্বে মুসলিমগণ নিজেদেরকে সুসংহত ও প্রশিক্ষিত শক্তিরূপে গড়ে তুলতে পারেন।”
৪. মদিনা রাষ্ট্রের সংহতি
হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে মদিনায় শান্তি ও স্বস্তির ভাব ফিরে পায়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুসলমানদেরকে স্বাধীনভাবে ধর্মীয় শিক্ষাদানের সুযোগ লাভ করেন। এতে মদীনায় মুসলমানদের কর্তৃত্ব অর্জিত হয়। মদীনায় অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও সংহতি গড়ে উঠে। ইসলামী রাষ্ট্রের কাঠামো তৈরি হয়।
আরো পড়তে পারেন: গীবত কাকে বলে? কুরআন ও হাদিসের আলোকে গীবতের ক্ষতিকর প্রভাব আলোচনা করুন
৫. ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতি
এ সন্ধির ফলেই মক্কা ও মদিনার জনগনের মধ্যে পুনঃ যোগসূত্র স্থাপিত হয়। মুসলমানরা সমগ্র আরবে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ লাভ করে। সারা আরবের লোকদের সাথে মেলামেশার সুযোগ, ইসলামের অনিন্দ্য সুন্দর আদর্শের প্রতি সকল শ্রেণীর মানুষকে আকৃষ্ট করে। ইসলামের সুশীতল পতাকা তলে আশ্রয় গ্রহণের হার দ্রুত বেড়ে যায়। দলে দলে বিভিন্ন গোত্রের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এবং আমর ইবনুল আস-এর মত আরবের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এ সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে ইবনে হিশাম বলেন- “The result of this is that where as Muhammad (sm) went forth to Hudibiyah with only 1400 men, he was followed two years later in the attack on Makkah by ten thousand” অর্থাৎ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যেখানে ১৪০০ লোক নিয়ে হুদাইবিয়ায় গিয়েছিলেন, সেখানে মাত্র দু’বছর পরে ১০,০০০ লোক নিয়ে মক্কা বিজয় করলেন।
৭. আর্থ-সামাজিক পরিমন্ডলে এর প্রভাব
হুদাইবিয়ার এই সন্ধি মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো মজবুত করতে এক বিশাল সুযোগ তৈরি করে দেয়। যুদ্ধ বিরতির কারণে মুসলমানগণ অবাধে বর্হিবাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য দিকে মনোনিবেশের সুযোগ পায়। এ সময় তারা বিধ্বস্ত আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে চাঙ্গা করে তোলে।
৮. মক্কা বিজয়ের সূচনা
হুদায়বিয়ার সন্ধি মক্কা বিজয়ের বীজ বপন করে সমগ্র আরব বিশ্বে ইসলামকে বিজয়ী শক্তিরূপে সুপ্রষ্ঠিত করে। হুদাইবিয়ার এই সন্ধিতে কুরাইশগণ প্রকৃত অর্থে মোটেই লাভবান হয়নি। ৬২৮ খ্রি. হতে ৬৩০ খ্রি. পর্যন্ত মাত্র দু’বছরের মধ্যেই সন্ধির সুফল মুসলমানদের অনুকূলে এত ব্যাপক শক্তি ও সাফল্য বয়ে এনেছিল যে, কুরাইশগণ বিচলিত না হয়ে থাকতে পারেনি এবং সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না। এই সুযোগে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর অশেষ রহমতে ১০ হাজার মুসলমান নিয়ে মক্কা জয় করেন। আর এ থেকেই যাত্রা শুরু হয় মুসলমানদের বিশ্ব বিজয়ের।
আরো পড়তে পারেন: সূরা আল হুজরাত এর আয়াত ০১-০৫ এর অনুবাদ
৯. কুরাইশদের মানসিক দুর্বলতা
হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে মুসলমানদের সাহসিকতা, দৃঢ় চিত্ততার ও একাগ্রতার পরিচয় পেয়ে কুরাইশরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। তারা দেখতে পায় মুসলমান এক আল্লাহর ও তার রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি অকৃত্রিম ও অবিচল আস্থা রাখে। এরকম আস্থা মক্কাবাসীদের কোন নেতার প্রতি নেই। তাদের এ দুর্বলতাই মুসলমানদের জন্য পরবর্তী সময়ে মক্কা বিজয়ের ভিত্তি রচনা করে দেয়।
১০. রাসূলের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ
হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে সমগ্র আরববাসীর কাছে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শ্রেষ্ঠত্ব ও দূরদর্শিতা প্রমাণিত হয়েছিল। বিশ্বকোষের পরিভাষায়, “আপাত দৃষ্টিতে মনে হলো মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অপমানজনকভাবে পশ্চাদপসারণ করেছেন। কিন্তু পরোক্ষভাবে এটা শীঘ্রই প্রকাশ পেলো, সুবিধাগুলো তার দিকেই ছিলো। সত্যই তা ছিল কৌশলপূর্ণ পশ্চাদপসারণ কিন্তু রণচাতুর্যপূর্ণ বিজয়।” ঐতিহাসিক ওয়াটস বলেন, “হুদাইবিয়ার সন্ধি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার একটি শ্রেষ্ঠ দলিল।”
উপসংহার
উপরিউক্ত বিশ্লেষণ থেকে সহজেই বোঝা যায় হুদায়বিয়ার সন্ধি ইসলামের জন্য ছিল সুমহান বিজয়। এ সন্ধি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অনুপম রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। এ সন্ধি সম্পর্কে হযরত আবু বকর (রা) বলেছেন, “হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে ইসলাম সারা আরবসহ গোটা বিশ্বে সার্বজনীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসলাম এক আন্তর্জাতিক জীবনাদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।”
• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence •