Monday, December 23, 2024

হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরীদপুরী রহ.-এর সুপারিশ

হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরীদপুরী রহ. -এর সুপারিশ

হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরীদপুরী রহ. বলন- ব্রিটিশ আমলে আশা কম ছিল এবং চেষ্টার পথও প্রশস্ত ছিল না। কারণ- তখন পরাধীনতার যুগ ছিল, ইংরেজ গভর্নমেন্টের আমল ছিল। এখন আমাদের নিজেদেরই গভর্ণমেণ্ট হয়েছে, আমরা আমাদের গভর্ণমেণ্টকে জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মুসলমান ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে করতে হবে, যাতে তারা ধর্মহীন হয়ে না যেতে পারে এবং ধর্মশিক্ষা হতে অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের পূর্ণজ্ঞান হতে বঞ্চিত না থাকে। এতটুকু চেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ। খাঁটি (ধার্মিক) ধর্মপ্রাণ জ্ঞানী আলেমদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে যে, আমাদের মুসলমানদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে ধর্মহীনতা, নাস্তিকতা ও কম্যুনিজম, বে-আদবী, উচ্ছৃঙ্খলভাবে প্রভৃতির বিষ ঢুকতেছে, এ বিষ যাতে না ঢুকতে পারে, তার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কিরূপ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এ সম্বন্ধে আমি আমার ব্যক্তিগত মত এখানে প্রকাশ করছি-

  • প্রাইমারী ষ্ট্যান্ডার্ডে মুসলমান ছেলেমেয়েদেরকে বাধ্যতামূলক ভাবে পূর্ণ কুরআন শরীফ আদ্যোপান্ত শুদ্ধ করে চরিত্রবান ধার্মিক উস্তাদের দ্বারা পূর্ণ আদব রক্ষা করে পড়াতে হবে। মাধ্যমিক ষ্ট্যান্ডার্ডে মূল আরবী ভাষায় জ্ঞান জম্মিয়ে কুরআন শরীফের অর্থ পড়াতে হবে। উচ্চ পর্যায়ে মূল আরবী ভাষার জ্ঞানের সঙ্গে রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনকীর্তি অর্থাৎ একখানা হাদীসের কিতাব আদ্যোপান্ত উপযুক্ত চরিত্রবান ধার্মিক উস্তাদের দ্বারা পড়াতে হবে। প্রত্যেক পর্যায়ে পড়া এবং পড়ার পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমল-আখলাকের ও নৈতিক চরিত্র গঠনের অনুশীলন ও পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  • বাংলা-ইংরেজী সাহিত্যের মধ্যেও নৈতিক শিক্ষা এবং ধর্ম শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার বর্ণনা থাকতে হবে। বৈষয়িক শিক্ষার কোন পুস্তকে কোন কথা নীতিবিরোধী বা ধর্মবিরোধী হতে পারবে না। কঠোরভাবে এর বন্দোবস্ত করতে হবে।
  • ধর্মহীন, চরিত্রহীন বা ধর্মবিরোধী কোন শিক্ষককেই শিক্ষা কাজের যোগ্য বলে গণ্য করা যাবে না।
  • শিক্ষকের মর্যাদা বাড়াতে হবে।
  • সহশিক্ষা বন্ধ করতে হবে। মেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে হবে। কেননা, যুবক-যুবতীদের অবাধ মেলামেশার ফলে যুবকদের চরিত্র নষ্ট হবে, যুবতীদের সতীত্ব নষ্ট হবে, পাপের স্রোত প্রবাহিত হয়ে দেশ ও জাতি ধ্বংস হবে, ভবিষ্যত বংশধর নষ্ট হয়ে যাবে। চরিত্রহীন পিতার ঔরসে, অসতী মাতার গর্ভে কখনো সৎ সাহসী সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে না।
  • বিজ্ঞানের নাস্তিকতা ভিত্তিমূলক পুস্তকগুলো আস্তিকতা ভিত্তিমূলক করে পুনরায় লেখাতে হবে।
  • দর্শনের পুস্তকগুলো তুলনামূলকভাবে এমন শিক্ষকের দ্বারা পড়াতে হবে, যাদের মধ্যে ইসলামের জ্ঞান পূর্ণমাত্রায় আছে।
  • যারা বৈষয়িক শিক্ষার সঙ্গে অথবা বৈষয়িক শিক্ষা বাদ দিয়ে ধর্ম‘শিক্ষায় পূর্ণ পারদর্শিতা লাভ করে ধর্ম শিক্ষা এবং ধর্ম প্রচার কার্যে আত্মনিয়োগ করতে চাবে, তাদের বিশেষ সাহায্য-সহায়তা সমাজ ও হুকুমতের করতে হবে, যেমন অন্যান্য বিষয়ে করা হয়।
  • বিদেশে (Foreign) পাঠাতে হলে, এমন ছেলে পাঠাতে হবে, যারা নিজের জাতীয় আদর্শে এত দৃঢ় যে, সে অন্যের ভিতরে সেই আদর্শ ঢুকাতে চেষ্টা করবে, অন্যদের আদর্শের দ্বারা যেন নিজে প্রভাবান্বিত না হয়। inferiority complex যেন তার ভিতরে না আসে।
  • Class 1 (one) হইতে B.A. Class পর্যন্ত দুটি পেপার এবং ২০০ মার্ক প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর জন্য নৈতিক শিক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং আরবী শিক্ষার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে রাখতে হবে।

বৈষয়িক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে যদি এভাবে কঠোর হাতে ধর্মশিক্ষার এক সঙ্গে বন্দোবস্ত করা হয়, তবে আশা করা যায়, আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে নাস্তিকতা, উচ্ছৃঙ্খলা ও কমিউনিজম ঢুকতেছে তার সংশোধন হবে।

এ সূত্রে আমি এত দূর বলতে পারি না যে, সংশোধনের আশা আছে কি না? বা কি পরিমাণ আছে? কিন্তু গোলামীর যুগ অতিবাহিত হয়ে স্বাধীনতা পাওয়ার ফলে চেষ্টার পথ প্রশস্ত হয়েছে, একথা বলতে পারি। সুতরাং চেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ। অন্যথায় নিজের ছেলে-মেয়েদের বিনা সংশোধনে কুসংসর্গে এবং কুশিক্ষার পরিবেশে পাঠিয়ে দেয়া যেন নিজের কলিজার টুকরাকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা। তাছাড়া ছেলে-মেয়ে আল্লাহর তরফ হতে মা-বাপের হাতে আমানত। এই আমানতের খিয়ানত করলে, দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করলে, মহাপাপী হতে হবে। বাপের জন্য শুধু ছেলে ভবিষ্যত জীবনে কি খেয়ে বাঁচবে বা মেয়ের কিভাবে বিবাহ হবে, সেই চিন্তা করলেই দায়িত্ব পালন করা শেষ হল না। তাদের খাদ্যের এবং বিবাহের চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চরিত্রের এবং ধর্মের ও ঈমানের চিন্তা করা ততোধিক জরুরী।”- শামসুল হক ফরীদপুরী রহ.

উল্লেখ্য, অনেকে ২/১ বার নসীহত করেই ক্ষান্ত হয়ে যায় এবং বলে যে, আমিতো পিতা হিসাবে নসীহতের দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু কিভাবে? আমরা বলে থাকি, পরিবেশের কারণে আমার ছেলে কথা শুনছে না, তবে ছেলেটি সবদিক দিয়ে ভালো। কিন্তু একটু অসুবিধা, নামাযটা ঠিকমত পড়ে না। লোকদের এসব কথা একেবারেই অচল। আল্লাহ্‌ তা’আলা কুরআনে কারীমে নিজেকে এবং পরিবার-পরিজন ও সন্তানকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে আগুন বলার মধ্যে একটা মস্ত বড় হিকমত হলো নিজের ছেলে বা শিশু যদি আগুনের দিকে ধাবিত হয়- তাহলে কোন পিতা শুধু নসীহত করে ক্ষান্ত থাকে না এবং একথাও বলবে না যে, আমিতো নিষেধ করেছি, তারপরেও আগুনে পড়লে আমার আর কি করার আছে? বরং পিতা যে কোন মূল্যে-ছেলেকে আগুন থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করবে। তারপর দ্বিতীয় কথা হল, দীনী ক্ষতিকে সামান্য ক্ষতি বলা হচ্ছে। অথচ দীনী ক্ষতি সবচেয়ে বড় ক্ষতি। এর উপর কোন ক্ষতি হতে পারে না। কিন্তু পিতা-মাতার দিলে দীনের যথার্থ মূল্যায়ন-ও গুরুত্ব না থাকায় এটাকে সামান্য ক্ষতি মনে করে তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না। হাজারো পিতা-মাতা পাওয়া যাবে, যারা সন্তানকে চাকুরী-বাকুরী বা ব্যবসা-বাণিজ্য না করার কারণে রাগ করেন, কথা বন্ধ করেন। কিন্তু এমন কয়জন পিতা পাওয়া যাবে, যারা নামায না পড়ার কারণে, নামাযের জামা’আত তরক করার কারণে সন্তানের উপর কখনও নারাজ হয়েছেন? সুতরাং সময় থাকতে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। আজ পিতা সন্তানের চক্ষু খোলার সাথে সাথে তাকে নার্সারীতে পাঠিয়ে আল্লাহ্‌র নামের স্থলে কুকুর-বিড়ালের নাম শিখাচ্ছে। কুরআন শরীফের স্থলে ইংরেজী বই পড়াচ্ছে। সন্তানের প্রতি এ জুলুমের ফল পিতাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। পিতার সারা জীবনের মেহনতের ফল সেই সন্তান বাসস্থান বিল্ডিং থেকে অসুস্থতার অজুহাতে বের করে পিতাকে নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দেবে। তারপর তার ব্যস্ততার দরুন সেখানে যেয়ে পিতার খোজ খবর নেয়ার ফুরসতও তার হবে না। এ অবস্থায় বহু পিতা নার্সিং হোমে ইন্তিকাল করছেন। এ সবের কারণ এটাই যে পিতা সন্তানকে এ তা’লীম দেন নাই যে- পিতা সন্তানের কত বড় দৌলত। দু’আ করি, সময় থাকতে সকলকে আল্লাহ্‌ তা’আলা সহীহ বুঝ দান করুন। (আমীন)

ইলমে দীন শিক্ষার ব্যাপারে হযরত থানবী রহ. এর দিক নির্দেশনা

মনে রাখবে যে, মুসলিম জাতির বর্তমান বিবর্তন হচ্ছে একটি আত্মিক রোগ। দৈহিক রোগ ব্যাধি দেখা দেয়ার যেমন বিশেষ বিশেষ কারণ ও উপসর্গ থাকে এবং সে কারণ ও উপসর্গগুলো দূরীকরণ দ্বারাই রোগের চিকিৎসা করা হয়। তদ্রূপ এ আত্মিক রোগেরও (পরিবর্তনের) কার্যকারণ ও উপসর্গ রয়েছে। এ গুলো দুর করাই হচ্ছে এ রোগের একমাত্র চিকিৎসা। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে- এ রোগের কারণ ও উপসর্গগুলো চিহ্নিত করে তা দুর করার পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রচেষ্টা চালান। এখন আমরা এ দুটি বিষয়ের উপর আলোচনা করবোঃ

(এক) মুসলিম জাতির চারিত্রিক বিবর্তনের কারণ সমূহ চিহ্নিত করা প্রসঙ্গে চিন্তা, গবেষণা ও অনুসন্ধান করে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ই পাওয়া যায়ঃ

(১) মানুষের মধ্যে দীনী ইলম ও ইসলামী জ্ঞানের অভাব ও স্বল্পতা।

(২) মানুষের সাহস হীনতা অর্থাৎ দৃঢ় ইচ্ছার অভাব।

(দুই) এসব কারণ সমূহ দূর করার পন্থা। আর এটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এজন্য ঐকান্তিক আগ্রহ এবং শক্তি ও ক্ষমতাকে যৌথভাবে প্রয়োগের প্রয়োজন খুবই প্রকট।

সুতরাং উভয় কারণের প্রত্যেকটি কারণ দূর করার পন্থাও বিভিন্ন। অতএব, দীনী ইলমের অভাব দুর করার ব্যাপারে শিক্ষক, মুদাররিস, ছাত্র অর্থাৎ ইসলামী বিধানের জ্ঞানে পরিপক্ক উলামা এবং ছাত্র ও শাগরিদবৃন্দ সকলেরই ভূমিকা পালন করতে হবে। আর এ ব্যাপারে প্রত্যেকের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক কর্মসূচী।

সূত্র

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,606FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles