▶ প্রশ্ন: দাস বলতে কি বোঝায়? দাসদের অধিকার সম্পর্কে ইসলামের বিধান লিখুন। ▶ বিষয়: (IST-504) Human Rights in Islam ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীতে দাসপ্রথা চলে আসছে। প্রাচীন গ্রীক রোমান ইতিহাসের দিকে চোখ ফিরালে দেখা যায় সে সময়েও দাসপ্রথা চালু ছিলো। সেই সময় দাসদের উপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতন করা হতো। ইসলাম দাসদের কে অমানবিক নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য সবচেয়ে মানবিক বিধান দিয়েছে। বর্তমানে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এ বিষয়ের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দাসদের জন্য অনেক নমনীয় ও সহজ নীতিমালা রেখে গিয়েছেন।
দাস বলতে কি বোঝায়
একটা সময় ছিল যখন অন্যান্য সকল জিনিসপত্রের মতোই হাটে-বাজারে কেনাবেচা হতো মানুষ। দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হতো তাদের। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে দাস ব্যবসা বা দাস প্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে। এই বর্বর প্রথাকে উচ্ছেদ করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামও চলে এসেছে অনেকদিন ধরে। সেই আন্দোলন ও সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে, দুনিয়া থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটে দাসপ্রথার। এই অমানবিক প্রথার অবসানকে চিহ্নিত করতে এবং প্রথাটির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের নায়কদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৮ থেকে প্রতিবছর ২৩ আগস্ট পালিত হয় আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস।
আরো পড়তে পারেন: মহানবী (স.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণে মানবাধিকারের যে দিক ফুটে উঠেছে তা ব্যাখ্যা করুন
প্রাচীনকালের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় মূলত ৪টি উপায়ে মানুষদের দাস বানানো হতো। যেমন-
- জোরপূর্বক কাউকে ধরে এনে বাজারে দাস-দাসী হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া
- যুদ্ধবন্দিদের দাস-দাসী বানানো
- অভাবের তাড়নায় স্বাধীন ব্যক্তির স্বেচ্ছায় দাসত্ব বরণ করা এবং
- দাস বা দাসী উপহার হিসাবে অথবা ক্রয়সূত্রে হস্তগত করা।
ইসলামে দাসদের অধিকার
ইসলামের সমালোচনায় দাসপ্রথার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এই দাস প্রথার সমর্থন করে না। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম দাসপ্রথার মতো একটি বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, ক্রীতদাসকে ভাতৃত্বের যে মর্যাদা দিয়েছিল, নেতৃত্বের যে সুযোগ দিয়েছিল তার গুরুত্ব অপরিসীম।
দাস-দাসীদের মুক্ত করা
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে বলেন-
আরো পড়তে পারেন: ইসলামে মানবাধিকারের সঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্র পর্যালোচনা করুন।
لَیۡسَ الۡبِرَّ اَنۡ تُوَلُّوۡا وُجُوۡہَکُمۡ قِبَلَ الۡمَشۡرِقِ وَالۡمَغۡرِبِ وَلٰکِنَّ الۡبِرَّ مَنۡ اٰمَنَ بِاللّٰہِ وَالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَالۡمَلٰٓئِکَۃِ وَالۡکِتٰبِ وَالنَّبِیّٖنَ ۚ وَاٰتَی الۡمَالَ عَلٰی حُبِّہٖ ذَوِی الۡقُرۡبٰی وَالۡیَتٰمٰی وَالۡمَسٰکِیۡنَ وَابۡنَ السَّبِیۡلِ ۙ وَالسَّآئِلِیۡنَ وَفِی الرِّقَابِ ۚ وَاَقَامَ الصَّلٰوۃَ وَاٰتَی الزَّکٰوۃَ ۚ وَالۡمُوۡفُوۡنَ بِعَہۡدِہِمۡ اِذَا عٰہَدُوۡا ۚ وَالصّٰبِرِیۡنَ فِی الۡبَاۡسَآءِ وَالضَّرَّآءِ وَحِیۡنَ الۡبَاۡسِ ؕ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا ؕ وَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُتَّقُوۡنَ
অর্থ: সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াত অনুধাবনে বোঝা যায়, মহান আল্লাহ তায়ালা দাসদের জন্য কত মর্যাদার বিধান রেখেছেন। বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে।
দাস-দাসীদের বিবাহ
এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা আন নূর-এর ৩২ নম্বর আয়াতে বলেন-
وَاَنۡکِحُوا الۡاَیَامٰی مِنۡکُمۡ وَالصّٰلِحِیۡنَ مِنۡ عِبَادِکُمۡ وَاِمَآئِکُمۡ ؕ اِنۡ یَّکُوۡنُوۡا فُقَرَآءَ یُغۡنِہِمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖ ؕ وَاللّٰہُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
অর্থ: তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
এই আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা নিঃস্ব হলেও সৎকর্মপরায়ণ দাস-দাসীদের বিবাহ দিয়ে দেয়ার বিষয়ে যে নির্দেশনা জারি করেছেন তা তাদের জন্য অনেক উচ্চ মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে।
স্বাধীন ব্যক্তিকে বেচা-কেনা নিষেধ
ইসলামে দাস প্রথা বিলুপ্তির জন্য কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে বেচা-কেনা করা নিষিদ্ধ করেছে। এ প্রসঙ্গে (আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন-আমি কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরূদ্ধে হবো-
- যে আমার নামে শপথ করে অত:পর বিশ্বাসঘাতকতা করে,
- যে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে (ক্রীতদাস হিসেবে) বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে,
- যে কোন মজুরকে নিযুক্ত করে তার থেকে পরিপূর্ণ কাজ গ্রহণ করে অথচ তার পারশ্রমিক প্রদান করে না।
দাস-দাসিকে সম্মানজনকভাবে সম্বোধন
দাস-দাসিকে সম্মানজনকভাবে সম্বোধন করতে হবে। ইসলাম তাদের ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে সম্মানের অধিকারী করেছে। (আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত) নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “তোমাদের কেউ যেন [এভাবে সম্বোধন করে] না বলে, ‘তোমার প্রভুকে খাওয়াও’, ‘তোমার প্র্রভুকে অযু করাও’, ‘তোমার প্রভুকে পান করাও’; বরং বলবে, ‘আমার মুনিব (সাইয়্যিদ)’ বা ‘আমার অভিভাবক (মাওলা)’। আর তোমাদের কেউ যেন না বলে ‘আমার দাস/বান্দা (আবদ)’ বা ‘আমার দাসী/বান্দী (আমাত)’; বরং বলবে ‘আমার বালিকা’ এবং ‘আমর বালক’।
দাস-দাসির ন্যায়বিচার লাভের অধিকার
দাস-দাসীরা সমাজের বা রাষ্ট্রের অন্যান্য নাগরিকের মতো রাষ্ট্র প্রদত্ত সুবিধা ভোগের পাশাপাশি রাষ্ট্র কর্তৃক ন্যায় বিচার লাভের অধিকারী হবেন। ইসলাম তাদের ন্যায় বিচার লাভে অধিকার দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যদি কেউ তার ক্রীতদাসকে হত্যা করে আমরা তাঁকে হত্যা করবো, আর কেউ যদি তার ক্রীতদাসের নাক কেটে দেয়, আমরাও তার নাক কেটে দেবো।”
দাস-দাসিকে আঘাত করা যাবে না
মুআবিয়া বিন সুওয়াইদ হতে বর্ণিত, আমি আমাদের এক ক্রীতদাসকে চপেটাঘাত করি, অত:পর পলায়ন করি। আমি ঠিক মধ্যাহ্নের আগে ফিরে এলাম এবং আমার পিতার পেছনে সালাত আদায় করলাম। তিনি তাকে (ঐ ক্রীতদাসকে) এবং আমাকে ডাকলেন এবং বললেন, সে তোমার প্রতি যা করেছে, তুমিও তেমন করো। সে [ক্রীতদাস] আমাকে মাফ করে দিল। তখন তিনি (আমার পিতা) বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবদ্দশায় আমরা মুকাররিনের পরিবারভুক্ত ছিলাম এবং আমাদের একজন মাত্র ক্রীতদাসি ছিল। আমাদের একজন তাকে চড় মারলো। এই খবর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে পৌঁছল এবং তিনি বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও। তারা (পরিবারের লোকজন) বললেন, সে ছাড়া আমাদের আর কোন সাহায্যকারি নেই। কাজেই তিনি বললেন, তাহলে তাকে কাজে নিযুক্ত করো, আর যখনই তোমরা তাকে কাজ হতে অব্যাহতি দিতে সমর্থ হও, তাকে মুক্ত করে দাও।
উপসংহার
ইসলাম ক্রীতদাসের ন্যায়বিচার লাভের অধিকারকে নিশ্চিত করে। বিশ্বে যেখানে দাসদের ওপর চলছিল ইচ্ছামত অত্যাচার নির্যাতন ও নিপীড়ণ; দাসদের হত্যা করাও যখন ছিল আইনসিদ্ধ, সেই সময় ইসলাম ঘোষণা করে কঠোরতম সতর্কবাণী, কেউ কোন ক্রীতদাসকে হত্যা করলে তাকেও হত্যা করা হবে, কেউ কোন ক্রীতদাসের অঙ্গহানি ঘটালে তারও অঙ্গহানি ঘটানো হবে। একমাত্র ইসলাম-ই দিয়েছে দাসদের সর্বোচ্চ সম্মান ও অধিকার।
• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence •