প্রশ্ন: ইমাম বুখারী (রহ.) এর জীবনী লিখুন এবং তার কিতাব (সহীহ আল-বুখারী) এর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করুন। ▶ বিষয়: (IST-508) Principles and History of Hadith literature ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
ইমাম বুখারী (রহ.) সংকলিত সহীহ বুখারী শরীফ সর্বজন স্বীকৃত একটি অনন্য এবং অন্যতম হাদিসের কিতাব। ইমাম বুখারী (রহ.) অক্লান্ত পরিশ্রম করে আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে এই কিতাবটি সংকলন করেন। যা মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক বড় একটি প্রাপ্তি।
ইমাম বুখারী (রহ.) এর জীবনী
ইমাম বুখারী (রহ.)। জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, স্মৃতির প্রখরতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা আর পর্বতসম ইলমের এক মূর্ত প্রতীক, এক মহাপুরুষ। তিনি ইলমে হাদীসের সম্রাট। তার সংকলিত হাদীসের মহামূল্যবান সংকলন সহীহ বুখারী শরীফ বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব মহাগ্রন্থ আল কুরআনের পরেই যার অবস্থান। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তাঁর ইলম সাধনার কাছে ঋণী। নিচে ইমাম বুখারী (রহ.) এর জীবনী আলোচনা করা হলো-
- নাম ও জন্ম পরিচয়: ইমাম বুখারী (রহ.) এর পুরো নাম ইমাম আবূ আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইব্ন ইসমাঈল বুখারী (রহ.)। তাঁর মূল নাম মুহাম্মাদ, কুনিয়াত আবু আব্দুল্লাহ, উপাধি আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস ও হাফেযুল হাদিস। পিতার নাম ইসমাইল। তিনি উজবেকিস্তানের অন্তর্গত বুখারা নামক স্থানে ১৯৪ হিজরী সনের ১৩ শাওয়াল মোতাবেক শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেন।
- শিক্ষাজীবন: ইমাম বুখারী ঘরোয়া পরিবেশে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এর পর ১১ বছর বয়সে হাদিস অধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করেন। ১৬ বছর বয়সে ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক ও ইমাম ওয়াকি ইবনুল জাররাহ (রহ.) এর হাদিসের কিতাব গুলো মুখস্ত করে ফেলেন। এরপর তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য মক্কা, মিশর, কুফা ও সিরিয়ায় হিজরত করেন। বর্ণিত আছে তিনি ৬ লাখ হাদিস মুখস্ত করেছিলেন।
- শিক্ষাদান: শিক্ষা জীবন শেষে তিনি হাদিস শিক্ষাদান শুরু করেন। দেশ-বিদেশের অনেক ছাত্র তাঁর নিকট হাদিস শিক্ষার জন্য আসতো। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসায়ী।
- হাদীস সংকলন: ইমাম বুখারী (রহ.) তাঁর প্রিয় উস্তাদ হযরত ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (রহ.) এর প্রেরণায় হাদিস সংকরণ শুরু করেন। অনেক পরিশ্রম ও সময় ব্যয় করে ৬ লাখ মুখস্ত হাদিসের মধ্যে থেকে বাছাই করে সহীস বুখারী শরীফ সংকলন করেন। বুখারী শরীফে দ্বিরুক্তিসহ মোট ৭২৭৫টি হাদিস সংকলিত হয়েছে। এই কিতাবটি সংকলন করতে ইমাম বুখারী (রহ.) এর প্রায় ১৬ বছর সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এছাড়াও তিনি আরো অনেক কিতাব রচনা করেছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- জানেন কি, কী পরিমাণ নেকী হতে আপনি বঞ্চিত হচ্ছেন? (জুযউ রফইল ইয়াদাঈন), আল-আদাবুল মুফরাদ (অনন্য শিষ্টাচার), জুযউ রফ্ইল ইয়াদায়ন ফিস সালাত ইত্যাদি।
- মৃত্যু: ২৫৬ হিজরি সালের শাওয়াল মাসের ০১ তারিখ ইদুল ফিতরের রাতে বুখারায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৬২ বছর।
সহীহ আল-বুখারী শরীফের বৈশিষ্ট্য
ইমাম বুখারী (রহ.) এর অসামান্য অবদান সহীহ বুখারী শরীফ। তিনি তাঁর মুখস্ত করা ৬ লক্ষ হাদিস থেকে বাছাই করে মোট ৭২৭৫টি হাদিস (দ্বিরুক্তিসহ) সংকলন করেন বুখারী শরীফে। এই কিতাবটি মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী পবিত্র আল কোরআনের পর পৃথিবীর অন্যান্য সকল কিতাব থেকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ এবং সমাদৃত। নিম্নে বুখারী শরীফের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো-
- জামে কিতাব: হাদিসের কিতাব সহীহ বুখারী শরীফের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি একটি জামে কিতাব বা গ্রন্থ। এই কিতাবে সিয়ার, আদব, মানাকিব, আশরাত, আহকাম, ফিতান, আকাইদ, ও তাফসীর –এই সবগুলো বিষয়েই পরিপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে।
- সুলাসিয়াত: সিহাহ সিত্তার কিতাবগুলোর মধ্যে একমাত্র বুখারী শরীফেই সর্বাধিক ২২টি সুলাসিয়াত হাদিস রয়েছে। সুলাসিয়াত হলো রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে তিন রাবীর সনদের বর্ণিত হাদিস।
- কুরআনের আয়াত দ্বারা শুরু: ইমাম বুখারী (রহ.) বুখারী শরীফকে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। প্রতিটি অধ্যায় কুরআনের আয়াত অথবা সহীহ হাদিস দ্বারা শুরু করেছেন। এই বৈশিষ্ট্যটি বুখারী শরীফের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য।
- হাদিস সংকলণের পদ্ধতি: ইমাম বুখারী (রহ.) হাদিস লেখার পূর্বে নিজে পবিত্র হয়ে নিতেন। তিনি প্রথমে গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করতেন। তারপর দুই রাকাত নামায আদায় করতেন এবং সবশেষে ইস্তেখারা করে হাদিস লেখার কাজ শুরু করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, সহীত বুখারীতে আমি কোনো হাদিস এমনিতে লিখিনি, যতক্ষণ না গোসল করে দুই রাকাত নামায আদায় করেছি এবং ইস্তেখারার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে তার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি।
- রাবীদের সমালোচনা: অন্যান্য হাদিসের কিতাবগুলোর তুলনায় বুখারী শরীফে সমালোচিত রাবিরদের সংখ্যা অনেক কম। বুখারী শরীফে উদ্ধৃত মোট ৪৫৩জন রাবির মধ্যে সমালোচিত রাবির সংখ্যা মাত্র ৮০ জন।
- পবিত্রতম নগরীতে সংকলন: ইমাম বুখারী (রহ.) সহীহ বুখারী শরীফের হাদিস সংকলণের কাজ শুরু করেছিলেন মক্কায় মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে। পরে এই কিতাবের বিভিন্ন অধ্যায় ও তরজমার কাজ সম্পন্ন করা হয় মদিনায় মসজিদে নববীর বিম্বার ও রওয়ার মধ্যস্থানে।
- স্বকীয়তা: বুখারী শরীফের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি কোনো কিতাবকে অনুসরণ করে সংকলন করা হয়নি। পরবর্তীকালে বুখারী শরীফকে অনুসরণ করে অন্যান্য আরো অনেক কিতাব সংকলন করা হয়েছে।
- স্বপ্নে আদিষ্ট হওয়া: ইমাম বুখারী স্বপ্নের মাধ্যমে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে আদিষ্ট হয়ে বুখারী শরীফ সংকলণের কাজ শুরু করেন। সিহাহ সিত্তার কিতাবগুলোর মধ্যে অন্য কোন কিতাবে এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করা যায় না। যা বুখারী শরীফের একটি অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট্য।
- সার্বজনীনতা: হাদিসের কিতাবগুলোর মাধ্যমে বুখারী শরীফ যতটুকু সার্বজনীনতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে অন্য কোন কিতাব তা অর্জন করতে পারেনি। তাই তেলাওয়ামের মাধ্যমে বুখারী শরীফ খতম করতে দেখা যায়। যা অন্যকোন হাদিসের কিতাবের ক্ষেত্রে করা হয় না।
- ব্যাকরণগত বর্ণনা: সহীহ বুখারীতে ইমাম বুখারী (রহ.) কঠিন আরবি শব্দগুলোর ব্যাকরণগত বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিষয়টি অন্যান্য হাদিসের কিতাবে লক্ষ্য করা যায় না।
উপসংহার
ইমাম বুখারী (রহ.) এর নিয়তের বিশুদ্ধতা, অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা ও সতর্কতা ও অভূতপূর্ব মেধার কারণে সকলের হাদিসের দলিল হিসেবে বুখারী শরীফকে উদ্ধৃত করেন। হাদিসের কিতাবগুলোর মাধ্যমে সহীহ বুখারী সর্বোৎকৃষ্ট এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্বলিত কিতাব।