মধু, মধু সেবনের উপকারিতা ও নিয়ম
কারো মুখের ভাষা তিক্ত বা কর্ষশ হলে অনেকেই বলে থাকেন- ‘জন্মের সময় ওর মুখে মধু দেয়নি’। তাই মুখের কথা মিষ্টি হয়নি। সত্যিকার অর্থে বিষয়টা এমন হয়। কিন্তু মধুর যে প্রকৃতই বিশেষ গুণ আছে, সে কথা স্বীকার করতেই হয়। শিশুর জন্মের পর মুখে মধু দেয়াটা প্রাচীনকাল থেকেই চলমান প্রথা।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে, মৌমাছি বিভিন্ন ফুলে বিচরণ করে ফুলের রেণু ও মিষ্টি রস সংগ্রহ করে তাদের পাকস্থলীতে রাখে। তারপর সেখানে মৌমাছির মুখ নিঃসৃত লালা মিশ্রিত হয়ে রাসায়নিক জটিল বিক্রিয়ায় মধু তৈরি হয়। এরপর মৌমাচি মুখ হতে মৌচাকের প্রকোষ্ঠে তা জমা রাখে। মধু একটি উচ্চ ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি ভেষজ তরল।
পবিত্র কোরআন ও রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদিসে মধু সম্পর্কে গুরুত্বের সাথে বয়ান করা রয়েছে। কোরআনে মধুর মধ্যে মানুষের বিভিন্ন রোগের প্রতিকার রয়েছে মর্মে সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে এবং একে ওষুধ ও খাদ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বৈজ্ঞানিকভাবেও মধুর পুষ্টিগুণ ও কার্যকারিতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। সর্দি, কাশি, আমাশয় এমনকি ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে মধুর ব্যবহার রয়েছে। নিয়মিত মধু সেবনে রূপচর্চা, যৌন দুর্বলতায় চিকিৎসা ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিসহ অন্যান্য ৩৩টি উপকারিতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে বিভিন্ন জার্নাল ও লেখায়।
এছাড়াও মধুর সাথে কালোজিরা, রসুন, আদা ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন খাবারের বেশ প্রচলন রয়েছে আমাদের দেশে। তবে অবশ্যই এগুলোর সাথে মধু মিশিয়ে সেবন করার আগে ভালোভাবে জেনে বুঝে সেবন করা উচিত। হুট করেই মধুর সাথে আদা-রসুন ইত্যাদির সেবন বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
সম্প্রতি সময়ে অনেকে ঘরো বিভিন্ন মিষ্টান্ন বা খাবার তৈরিতে চিনির বদলে মধুর ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষ করে শিশুদের জন্য বিভিন্ন খাবার তৈরিতে চিনির বদলে মধুর ব্যবহার করছেন সচেতন অভিভাবকগণ।
মধু-তে বিদ্যমান পুষ্টিগুণসমূহ
মধুর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ (Vitamin & mineral) উপাদান। যা মানবদেহের বহুমাত্রিক চাহিদা পূরণে সহায়ক। রয়েছে ৪৫টিরও বেশি খাদ্যগুণ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-
- গ্লুকোজ (Glucose) ➔ ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ
- ফ্রুক্টোজ (Fructose) ➔ ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ
- সুক্রোজ (Sucrose) ➔ ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ
- অ্যামাইনো অ্যাসিড (Amino Acid) ➔ ২২ শতাংশ
- মন্টোজ (Montose) ➔ ৫ থেকে ১২ শতাংশ
- খনিজ লবণ (Mineral salt) ➔ ২৮ শতাংশ
- এনকাইম ➔ ১১ শতাংশ
- ১০০ গ্রাম মধুতে শক্তি থাকে ২৮৮ ক্যালরি।
- ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি২, ভিটামিন বি৩, ভিটামিন বি৫, ভিটামিন বি৬
- এছাড়াও রয়েছে: জিংক, কপার, আয়োডিন, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান
বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে খাঁটি মধু এর ব্যবহার
সাধারণ বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য মধুর ব্যবহার সর্বজন বিদিত। মধু এককভাবে, আবার কখনো ভেষজ বা অন্যান্য দ্রব্যের সাথে মিশিয়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এতে যথেষ্ট সফলতা পাওয়া যায়। তাই সাধারণ কিছু রোগের চিকিৎসায় মধুর ব্যবহার এখান থেকে জেনে নিতে পারেন-
সর্দি, কাশি ও স্বরভঙ্গে মধু
- দুই চা চামচের সমপরিমাণ মধু এবং দুই চামচ পরিমাণ বাসক পাতার রস একসাথে মিশিয়ে খেলে সর্দি ও কাশি সেরে যায়।
- এক চা চামচ পরিমাণ মধু ও এক চা চামচ আদার রস চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে সর্দির উপশম হয়। বুকের মধ্যে জমে থাকা শ্লেষ্মা বের করে বুক ও গলা পরিস্কার করার জন্য এটি খুবই কার্যকর। অনেকের শীতের সময় গলায় শ্লেষ্মা জমে থাকায় খুবই অসস্তি ভোগ করেন। তাদের জন্য এটি ফলদায়ক।
- দুই চা চামচ মধু, এক গ্লাস গরম (হালকা গরম) দুধের সঙ্গে খেলে সর্দিকাশি দূর হয়। এভাবে সকালে একবার ও বিকালে একবার করে সেবন করতে হবে।
- এক চা চামচ তুলসী পাতার রস ও এক চা চামচ মধু একসাথে মিশিয়ে সেবন করলে কাশি উপশমে কাজ করে। এতে খুব অল্প সময়ে কাশি দূর হয়।
- হরিতকী ও বচচূর্ণ ভালভাবে একসাথে মিশিয়ে চেটে খেলে শ্বাসকষ্টের দ্রুত উপকার হয়।
- যাদের ক্ষিদামন্দা রয়েছে তারা এক চা চামচ আদার রস এবং এক চা চামচ মধু একসঙ্গে মিশিয়ে সেবন করতে পারেন। সকাল-সন্ধ্যা দুইবার এভাবে ব্যবহার করলে ক্ষুদা বৃদ্ধিপায়।
- হালকা গরম পানিতে মধু মিশিয়ে গড়গড়া করলে গলার স্বর বৃদ্ধি পায়। গলার স্বরভঙ্গেও এটি ভালো কাজ করে। বিশেষ করে আবৃত্তিকার, উপস্থাপক ও গায়কদের জন্য গলার স্বর বৃদ্ধি ও ঠিক রাখতে খুবই উপকারী।
আমাশয়ের চিকিৎসায় মধু
- বড়ই গাছের ছালের চূর্ণের সাথে মধু মিশিয়ে সেবন করলে আমাশয় ভালো হয়।
- কচি বেল ও আমগাছের বাকল (কচি চামড়া) একসাথে বেটে (পিশে) তৈরিকৃত পেস্টের সঙ্গে গুর ও মধু মিশিয়ে খেলে আমাশয় ভালো হয়।
- ৫০০ গ্রাম আতপ চাল হাড়িতে ভেজে গুঁড়া করে এর সঙ্গে ১২৫ গ্রাম ঘি, ২৫০ গ্রাম খাঁটি মধু, ১২৫ গ্রাম চিনি এবং ২০টি সবরি কলা ভালোভাবে মিশিয়ে নিন (চটকে নিন)। এরপর সেটাকে হাড়িতে জ্বালান দিয়ে খাবার উপযোগী করে ৩/৪ দিন নিয়মিত সেবন করলে ধরনের আমাশয় ভালো হয়ে যায়। এতে অনেকের পুরাতন আমাশয় থাকলে ভালো হয়ে যাবে।
অন্যান্য সাধারণ রোগে মধু
- শরীরের বাইরের কোন ক্ষত হলে আমরা মলম ব্যবহার করি। মলমের পরিবর্তে ক্ষতে মধুর প্রলেপ লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
- শিশুদের দৈহিক গড়ন, রুচি বৃদ্ধি, ওজন বৃদ্ধি ও পেট ভালো রাখার জন্য মধু ব্যবহার করতে পারেন। প্রতিদিন এক চা চামচ মধু গরম দুধ ও গরম পানির সঙ্গে খাওয়ালে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
- আধা তোলা পরিমাণ পেঁয়াজের রস, ২৫০ গ্রাম ঘি এবং ২৫০ গ্রাম মধু মিশিয়ে একটা পাত্রে রেখে দিন। উক্ত মিশ্রণ প্রতিদিন সকাল-বিকাল এবং রাতে চিনি দিয়ে অল্প পরিমাণ গরম দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে যক্ষ্মা ভালো হবে।
- পানিতে অল্প মধু মিশিয়ে খেলে পাকস্থলীর ক্ষত সারে।
- মৌরির ভিজিয়ে রাখা পানিতে মধু মিশিয়ে পান করলে দূষিত বায়ু পেট থেকে বেরিয়ে যায়।
- খয়ের ও দারুচিনির গুঁড়া সমপরিমাণ সামান্য মধুর সঙ্গে মিশিয়ে দিনে ৩/৪ বার খেলে ডায়রিয়ায় দ্রুত উপকার পাওয়া যায়।
- শরীরের চর্বি বা মেদ কমানোর জন্য পানির সাথে মধু মিশিয়ে খেলে সুফল পাওয়া যায়।
- দুর্বল শিশুকে দুধের সাথে অল্প (কয়েক ফোঁটা) মধু মিশিয়ে খাওয়ালে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
- এক গ্লাস দুধে এক চা চামচ পরিমাণ মধু মিশিয়ে রোজ সকালে খেলে শক্তি বৃদ্ধি পায়।
- মধুর সঙ্গে গুড়ের রস মিশিয়ে খেলে বমি বন্ধ হয়ে যায়।
- পিপুল ও গোল মরিচের শুকনো গুঁড়ার সঙ্গে মধু মিশিয়ে কিছু দিন নিয়মিত খেলে পুরাতন ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়।
- আমাশয় ও পাতলা পায়খানায় হালকা গরম পানিতে আড়াই চা-চামচ মধু মিলিয়ে শরবত বানিয়ে সেবন করতে হবে। পাতলা পায়খানার ক্ষেত্রে এভাবে বারবার সেবন করতে হবে।
- যক্ষ্মা রোগে বাসক পাতার রস এক চা-চামচ পরিমাণ এক চা-চামচ মধু এবং এক চা-চামচ আদার রস মিশিয়ে কিছু দিন খেলে উপকার পাওয়া যাবে।
- এক গ্লাস গরম দুধ বা গরম পানিতে ২চা-চামচ মধু মিশিয়ে কয়েকবার খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য ভালো হবে।
পবিত্র কোরআনে মধু সম্পর্কে যা বলা হয়েছে
ثُمَّ كُلِي مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا ۚ يَخْرُجُ مِن بُطُونِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِّلنَّاسِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
অর্থ: এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ কর এবং আপন পালনকর্তার উম্মুক্ত পথ সমূহে চলমান হও। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙে পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্যে রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। — সূরা: আন নাহল, ৬৯।
পবিত্র কোরআনে আন নাহল নামে এই সূরাটি নাযিল হয়েছে। এটি পবিত্র কোরআনের ১৬ নম্বর সূরা। আরবি পরিভাষায় মৌমাছিকে ‘নাহল’ বলা হয়। উপরের আয়াতে যে পানীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে তা হলো মধু। এই মধুতে মানুষের রোগের প্রতিকার রয়েছে। যা মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘোষণা করেছেন। বুঝাই যাচ্ছে মধুর কতো গুণ।
এছাড়াও পবিত্র কোরআনের ৪৭ নম্বর সূরা মুহাম্মদ- এর ১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
مَّثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ ۖ فِيهَا أَنْهَارٌ مِّن مَّاءٍ غَيْرِ آسِنٍ وَأَنْهَارٌ مِّن لَّبَنٍ لَّمْ يَتَغَيَّرْ طَعْمُهُ وَأَنْهَارٌ مِّنْ خَمْرٍ لَّذَّةٍ لِّلشَّارِبِينَ وَأَنْهَارٌ مِّنْ عَسَلٍ مُّصَفًّى ۖ وَلَهُمْ فِيهَا مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ وَمَغْفِرَةٌ مِّن رَّبِّهِمْ ۖ كَمَنْ هُوَ خَالِدٌ فِي النَّارِ وَسُقُوا مَاءً حَمِيمًا فَقَطَّعَ أَمْعَاءَهُمْ
অর্থ: পরহেযগারদেরকে যে জান্নাতের ওয়াদা দেয়া হয়েছে, তার অবস্থা নিম্নরূপঃ তাতে আছে পানির নহর, নির্মল দুধের নহর যারা স্বাদ অপরিবর্তনীয়, পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু শরাবের নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। তথায় তাদের জন্যে আছে রকমারি ফল-মূল ও তাদের পালনকর্তার ক্ষমা। পরহেযগাররা কি তাদের সমান, যারা জাহান্নামে অনন্তকাল থাকবে এবং যাদেরকে পান করতে দেয়া হবে ফুটন্ত পানি অতঃপর তা তাদের নাড়িভূঁড়ি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেবে?
উপরের আয়াত অনুযায়ী, বেহেশতেও মধুর একটি নদী থাকবে। আল্লাহ তায়ালার অনেক নেয়ামতপূর্ণ একটি খাবার হলো মধু। যা বেহেশতের মধ্যে থাকবে। এখানে এগুলো তুলে ধরা হয়েছে মধুর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। যেখানে মধু সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন।
ইসলামের বিভিন্ন বুযুর্গ এবং ওলিগণ মধুর মধ্যে যে সর্বরোগের প্রতিষেধক রয়েছে তা স্বীকার করেছেন। তারা নিজেদের প্রয়োজনে মধু ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় তারা মধু ব্যবহার করেছেন। হযরত ইবনে ওমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তার শরীরে ফোঁড়া বের হলে তিনি তাতে মধুর প্রলেপ দিয়ে চিকিৎসা করেন। এর কারণ তিনি বলেন- আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কি বলেননি যে, তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। -(কুরতুবী)