▶ প্রশ্ন: আন-নাসখ বলতে কী বোঝায়? আন-নাসখ কত প্রকার ও কি কি? সুন্নাহ দ্বারা কুরআন রহিত করা যায় কী আলোচনা করুন। ▶ বিষয়: (IST-505) Principles and History of Tafsir Literature ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাই তিনিই মানুষের কল্যাণ সম্পর্কে ভালো জানেন। তিনি কখনো একটি বিধান প্রবর্তন করেন, আবার মানুষের মঙ্গলের দিক চিন্তা করে তিনিই আবার সেই বিধান পরিবর্তন করে দেন। উসুলে তাফসীরের ভাষায় এটাকে নসখ বলে।
আন নাসখ কি
আরবী শব্দ নসখের আভিধার্নিক অর্থ রহিতকরণ, বাতিলকরণ, বন্ধ করন, দুরীকরণ, রদকরণ, স্থগিতকরণ। অর্থাৎ কারো ক্ষমতা বলে চলমান কোন আইনকানুন বা বিবি-বিধান প্রত্যাহার, পরিবর্তনকরণ, সংশোধন করাকে নসখ বলে।
পারিভাষিক অর্থে শরিয়তের কোন বিধানকে অন্য কোন শরিয়তের বিধানের মাধ্যমে রদ করে দেয়াকে নসখ বলে বা কোরআনের কোন আয়াতকে অন্য কোন আয়াত দ্বারা বাতিল করা বা কোন হুকুম কে অন্য কোন হুকুম দ্বারা বাতিল করে দেয়াকে নসখ বলে।
এক্ষেত্রে যে বিধানটিকে বাতিল করা হয় তাকে মানসুখ ও নতুন বিধানটিকে নসখ বলে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারা এর ১০৬ নম্বর আয়াতে বলেন-
مَا نَنۡسَخۡ مِنۡ اٰیَۃٍ اَوۡ نُنۡسِہَا نَاۡتِ بِخَیۡرٍ مِّنۡہَاۤ اَوۡ مِثۡلِہَا ؕ اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
অর্থ: আমি কোন আয়াত রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান।
আরো পড়তে পারেন: ইসলামে বিতর্ক বলতে কি বোঝায়? বিতর্ক সংক্রান্ত কুরআনের ৮টি আয়াত লিখুন।
আন-নাসখ প্রসঙ্গে আল্লামা সাঈদ আহমেদ বলেন, “নসখ হল কোন শরয়ী হুকুমকে অন্য শরয়ী হুকুম দ্বারা বিলুপ করা।
নসখের প্রকারভেদ
নসখ প্রধানত চার প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন-
- কোরআন দ্বারা কোরআনের নসখ
- কোরআন দ্বারা হাদিসের নসখ
- হাদীস দ্বারা হাদীসের নসখ
- হাদীস দ্বারা কোরআন নসখ
নিম্নে এই ৪ প্রকারের নাসখ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
আরো পড়তে পারেন: ১০ জন প্রসিদ্ধ মুফাসসির সাহাবির পরিচয় দিন? সাহাবীদের যুগে তাফসিরের বৈশিষ্ট্য লিখুন।
(১) কোরআন দ্বারা কোরআনের নসখ:
এ ক্ষেত্রে কোরআনের পূর্ববর্তী একটি আইন পরবর্তী আইন দ্বারা রহিত হয়। যেমন ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা নিসা এর ১৫নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে-
وَالّٰتِیۡ یَاۡتِیۡنَ الۡفَاحِشَۃَ مِنۡ نِّسَآئِکُمۡ فَاسۡتَشۡہِدُوۡا عَلَیۡہِنَّ اَرۡبَعَۃً مِّنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ شَہِدُوۡا فَاَمۡسِکُوۡہُنَّ فِی الۡبُیُوۡتِ حَتّٰی یَتَوَفّٰہُنَّ الۡمَوۡتُ اَوۡ یَجۡعَلَ اللّٰہُ لَہُنَّ سَبِیۡلًا
অর্থ: আর তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচারিণী তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চার জন পুরুষকে সাক্ষী হিসেবে তলব কর। অতঃপর যদি তারা সাক্ষ্য প্রদান করে তবে সংশ্লিষ্টদেরকে গৃহে আবদ্ধ রাখ, যে পর্যন্ত মৃত্যু তাদেরকে তুলে না নেয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোন পথ নির্দেশ না করেন।
এই আইনটি পরিবর্তীতে বাতিল করা হয়। যারা এ ধরণের মন্দ কাজ করবে তাদের সম্পর্কে সূরা নূর এর ২নং আয়াত নাযিল হয়।
اَلزَّانِیَۃُ وَالزَّانِیۡ فَاجۡلِدُوۡا کُلَّ وَاحِدٍ مِّنۡہُمَا مِائَۃَ جَلۡدَۃٍ ۪ وَّلَا تَاۡخُذۡکُمۡ بِہِمَا رَاۡفَۃٌ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ۚ وَلۡیَشۡہَدۡ عَذَابَہُمَا طَآئِفَۃٌ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
অর্থ: ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।
(২) কোরআন দ্বারা হাদীন নসখ
এক্ষেত্রে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর একটি নির্দ্দেশ কিংবা কোন সুন্নাহ পবিত্র কোরআনের কোন আয়াত দ্বারা রহিত হয়। যেমন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদীনায় আসার পর তার নির্দেশে সবাই বাধ্যতামূলক ভাবে আশুরার দিন রোজা রাখতো। তখন রমযানে সিয়াম পালনের বিধান নাযিল হয়নি। পরবর্তীতে এ নিয়ম বাতিল করে সূরা বাকারার ১৮৫নং আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহ বলেন-
شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَبَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَالۡفُرۡقَانِ ۚ فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ ؕ وَمَنۡ کَانَ مَرِیۡضًا اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّۃٌ مِّنۡ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ یُرِیۡدُ اللّٰہُ بِکُمُ الۡیُسۡرَ وَلَا یُرِیۡدُ بِکُمُ الۡعُسۡرَ ۫ وَلِتُکۡمِلُوا الۡعِدَّۃَ وَلِتُکَبِّرُوا اللّٰہَ عَلٰی مَا ہَدٰىکُمۡ وَلَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ
অর্থ: রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।
এরপর রমযান সিয়াম ফরয হল, আশুরার সিয়াম ছেড়ে দেয়া হল।
(৩) সুন্নাহ দ্বারা সুন্নাহ নসখ
যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কোন নির্দেশ তাঁর আরেকটি নির্দেশ দ্বারা বাতিল হয়ে যায়। যেমন- ইসলামের প্রথম দিকে কেউ রান্না করা খাবার খেলে রাসুল তাকে সালাত আদায়ের পূর্বে আবার ওযু করার নির্দ্দেশ দিতেন। কিন্তু পরে তা রহিত হয়ে যায়। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দুটি নির্দেশের শেষেরটিতে আগুনে পাকানো বস্তু খাওয়ার পর ওযু ভঙ্গ না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ রান্না করা খাবার খেলে পুনরায় ওযু করার প্রয়োজন নাই।
(৪) হাদীস দ্বারা কুরআন নসখ
এ ধরনের নসখ বৈধ। কুরআনের বহু আম বিধানকে হাদীস দ্বারা খাস করা হয়েছে। যেমন- সালাতের রাকাআত ও পদ্ধতি যাকাতের নিসাব ও পরিমাণ, হজের নিয়মাবলী-ইত্যাদি। হাদীস দ্বারা কুরআন রহিতকরণ দুটি ধরন হতে পারে।
- মুতাওয়াতীর হাদীস: যখন কোন স্তরে হাদীস বর্ণনাকারি অনেক থাকে যারা মিথ্যা ব্যাপারে একমত হতে পারেনা।
- খবরে ওয়াহেদ: যখন হাদীস বর্ণনাকারি একত্র থাকে।
মুতাওয়াতীর হাদীস দ্বারা কোরআনের বিধান রহিত করার উদাহরণ হল সূরা বাকারার ১৮০নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
“যখন তোমাদের কারো সামনে মৃত্যু উপস্থিত হয় এবং মুমূর্ষ ব্যক্তির যদি কোনো সম্পদ থাকে তবে সে ব্যক্তি পিতামাতা ও নিকট আত্মীয়দের জন্য অসীয়তে করার বিধান প্রনীত হল।”
এ বিধানটি মুতাওয়াতীর হাদীস দ্বারা রহিত হয়েছে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক পাওনাদারের পাওনা (হক) নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং অংশীদারদের জন্য অসীয়ত করার বিধান নেই।”
(২) খবরে ওয়াহেদ দ্বারা কোরআনের বিধান রহিত করার সম্পর্কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মতামত থাকলেও অধিকাংশ ফকীহদের মতে এটি জায়েয নয়।
এছাড়া কোরআনে আরো চার ধরনের নসখ রয়েছে যেমন-
(১) কোরআনের আয়াত ও হুকুম দুটোই বাতিল হয়েছে এ ধরণের নসখ বিরল।
(২) কোরআনের আয়াত রহিত হয়েছে কিন্তু হুকুম রয়েছে যেমন- বৃদ্ধ নারী ও পুরুষ ভ্যবিচারে লিপ্ত হলে আদের বেত্রঘাত ও পাথর মার। বর্তমানে এ আয়াতটি কোরআনে নৈই কিন্তু হুকুম আছে।
(৩) কোরআনের আয়াত আছে কিন্তু হুকুম রহিত হয়েছে যেমন- রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে পরামর্শকালে বাধ্যতা ভাবে তাকে হাদীযা দেয়ার বিধানটি বাতিল/রহিত হয়ে গেছে কিন্তু আয়াতের তেলাওয়াত রয়েছে।
(৪) কোরআনের আয়াত ও হুকুম দুটোই রয়েছে কিন্তু আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন নবী রাসূলদের তাহাজ্জুদ নামায বাধ্যতামূলক ছিল আমাদের জন্য নয়।
উপসংহার
আন-নাসখ ইসলামী শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সম্পর্কে জ্ঞান রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে ইসলামী শরীয়াতের অনেক বিষয় বোধগম্য হবে না এবং সে বিষয়গুলো নিয়ে মনে সংশয় সৃষ্টি হতে পারে। তাই নাসখ সম্পর্কে জ্ঞান রাখা জরুরী।
• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence •