▶ প্রশ্ন: সীরাত সাহিত্য বলতে কী বুঝায়? কোরআন ও হাদিসের আলোকে রাসূল (সা.) এর জীবনী অধ্যয়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করুন ▶ বিষয়: (IST-503) Al-Sirat Al-Nababiah ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
এই পৃথিবীর বুকে পূর্ণ মানব হওয়ার একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি হলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। তাঁর সমগ্র জীবনের সামগ্রিক কর্মকান্ড একটি পরিপূর্ণ উম্মতের জীবনাদর্শ। তাঁর গোটা জীবন ইসলামের জীবন্ত ব্যাখ্যা। একজন পূর্ণমানব হিসেবে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে অধ্যয়ন করা, তাঁর সীরাত বিষয়ে তথ্যনির্ভর, সহীহ-শুদ্ধ গ্রন্থ পড়ে দেখা সকলের-ই উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নিত্যনৈমিত্তিক পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সকল আপডেট আমাদের অধ্যয়নে থাকলেও সীরাত অধ্যয়নে উম্মতের অবহেলা ও উদাসীনতা ব্যাপক।
সিরাত কাকে বলে
সিরাত একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ চাল-চলন, গতি ইত্যাদি। আরবি ভাষার বিখ্যাত অভিধান ‘আল মুজাম আল আজম’ ও ‘মিসবাহুল লুগাত’-এ সিরাত শব্দের অর্থ করা হয়েছে- যাওয়া, প্রস্থান করা, চলা, গতি, পথ, পদ্ধতি, ধারা, আকার, আকৃতি, মুখাবয়ব, চেহারা, আকৃতি, অবস্থা, কর্ম-নৈপুণ্য, ঢঙ, চাল, সুন্নত, জীবন চলার ধরণ ইত্যাদি। মোটকথা, সিরাতের আভিধানিক অর্থ হলো, কোনো ভালো মানুষের বা নেককার মানুষের চাল-চলন, ওঠাবসা, কাজ, মেজাজ-মর্জি। এককথায় জীবন পদ্ধতি বা জীবন চরিত। আর সিরাত শব্দের পারিভাষিক অর্থ বোঝানো হয়েছে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সার্বিক জীবন চরিতকে।
আরো পড়তে পারেন: আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে কী বুঝ? অথবা, জাহেলিয়াতের যুগ কাকে বলে?
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিখ্যাত জীবনী গ্রন্থগুলোর নামের সঙ্গে এই সিরাত শব্দটি সম্পৃক্ত দেখা যায়। যেমন- সিরাতে ইবনে ইসহাক, সিরাতে ইবনে হিশাম, সিরাতে হালবিয়া, সিরাতে রাসূল, সিরাতে মুগলতাই, সিরাতে খাতিমুল আম্বিয়া ইত্যাদি।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবনী অধ্যয়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সার্বিক জীবনাদর্শ উম্মতের জন্য পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবনী অধ্যয়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিচে আলোচনা করা হলো-
সীরাত অনুকরণীয় আদর্শ
মানবজীবনের এমন কোন দিক নেই যেখানে প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদচারণার নিদর্শন নেই। ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকান্ডে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে। এমন কোন অনুভূতি নেই যা তিনি অনুভব করেননি। মানব জীবনের ব্যবহারিক, আধ্যাত্মিক, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সমস্ত কিছুই তাঁর জীবন ও সাধনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ফলে তাঁর জীবনাদর্শ সর্বকালের সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। জীবন চলার পথের পাথেয়, আলোকবর্তিকা ও দিকনির্দেশনা স্বরূপ। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা আযহাবের ২১ নম্বর আয়াতে বলেন-
لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَالۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَذَکَرَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا ؕ
অর্থ: যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।
এই আয়াত থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কথা ও কাজ অনুসরণ অনুকরণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পরিপূর্ণ ও নিখাঁদ অনুসরণের জন্যে গভীরভাবে সীরাত অধ্যয়ন প্রয়োজন।
আরো পড়তে পারেন: বদর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা করুন
আমল যাচাইয়ের মাপকাঠী সীরাত
ব্যক্তিক বা সামগ্রিক জীবনের কোন কাজ ও আমল কতটুকু সঠিক তা যাচাই করার জন্য মাপকাঠী হলো সীরাত। অর্থাৎ নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোন কাজটি কিভাবে করেছেন সেটা দেখে সঠিকভাবে পালন করা। যেই আমল রাসূলের সীরাত ও সুন্নাতের মানদণ্ডে ঠিকে সেটিই সঠিক আর যেটি ঠিকেনা সেটি অশুদ্ধ এবং সেটা বর্জনীয়। সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাওয়ী ওয়া আদাবিস সামে’ তে উল্লেখ করেন যে, “নিঃসন্দেহে এটা সর্বজন স্বীকৃত বিষয় যে, রাসূল সা. এর সীরাত হলো ইসলামের সকল বিষয়ের সত্যাসত্যের অন্যতম মানদণ্ড। সুতরাং, সকল আমালকে তাঁর জীবনাচার, স্বভাব-চরিত্রের নিক্তিতে মেপে দেখতে হবে। যা কিছু এর সাথে সামঞ্জস্য রাখবে, তাই সত্য। আর যা কিছু সামঞ্জস্য রাখবেনা তা অসত্য।” তাই সঠিকভাবে আমল করতে হলে সীরাতের পাঠের বিকল্প নেই।
কুরআন অনুধাবনে সহায়ক সীরাত
জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পবিত্র আল-কুরআন। পবিত্র আল কোরআন সমগ্র বিশ্ববাসীর হেদায়াত স্বরূপ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। কুরআন হলো পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববিষয়ের মূল বিষয়। তাই মানুষের সামগ্রিক জীবনে কোরআনের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য কুরআন বোঝা প্রয়োজন। আর নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবন ছিল কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ তরজমা ও তাফসির। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশার (রা.) কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সীরাত ও আখলাক সম্পর্কে তখন তিনি বলেছিলেন, “তাঁর আখলাক (সীরাত) ছিল আল-কুরআন।” অর্থাৎ কুরআন হলো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবনচরিতের সংরক্ষিত ও লিখিত নমুনা। কেউ তাফসীরের কিতাব অধ্যয়ন করতে চাইলে অবশ্যই সীরাত অধ্যয়ন করতে হবে। কারণ কুরআনের বহু আয়াত নাযিলের পিছনে এমন প্রেক্ষাপট রয়েছে, যা সরাসরি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সীরাতের সাথে সম্পর্কিত।
সীরাত অধ্যয়ন রাসূলের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন
পৃথিবীর প্রতিটি মুসলমানের কাছে তার নিজের প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় ও ভালোবাসার পাত্র হলেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ইমরানের ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-
قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَیَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَاللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
অর্থ: বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “সেই আল্লাহর শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ। তোমাদের কেউ প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষন না আমি তার নিকট তার পিতা ও সন্তানাদির চেয়ে অধিক ভালবাসার পাত্র হই”।
যত বেশি পরিমাণে সীরাত অধ্যয়ন করা যাবে, রাসুলের প্রেম অন্তরের মধ্যে তত বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। নিজের আচার-আচরণ, চলাফেরা সকল কাজে নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠবে।
সীরাত অধ্যয়নে ঈমান শক্তিশালী হয়
মহান আল্লাহ তায়ালা রাসুল নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা মুমিনুন এর ৬৯ নম্বর আয়াতে বলেন-
اَمۡ لَمۡ یَعۡرِفُوۡا رَسُوۡلَہُمۡ فَہُمۡ لَہٗ مُنۡکِرُوۡنَ ۫
অর্থ: না তারা তাদের রসূলকে চেনে না, ফলে তারা তাঁকে অস্বীকার করে?
সীরাত অধ্যয়নের ফলে অমুসলিমদের ইসলামের প্রতি আকর্ষণ এবং মুসলমানদের মাঝে ঈমানের বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক লোক রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এসে দুই পাহাড়ের মাঝামাঝি ছাগলগুলো চাইলে তিনি তাকে তা দিয়ে দিলেন। অতঃপর সে লোক তার গোত্রের নিকট প্রত্যাবর্তন শেষে বলল, হে আমার জাতি ভাইয়েরা! তোমরা ইসলাম কবূল কর। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অভাবের আশঙ্কা না করে দান করেন।
উপসংহার
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সীরাত মানবজীবনের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। সীরাত অধ্যয়ন, অনুসরণ ও অনুকরণ এবং সামগ্রিক জীবনে তা বাস্তবায়ন ছাড়া কারো দুনিয়া এবং আখিরাতের শান্তির আশা করা যায় না। যেহেতু দুনিয়া-আখেরাতের একমাত্র সফলতা আর সকল সৌভাগ্য রাসূলের পদাঙ্ক অনুসরণের মাঝেই নিহিত। কাজেই প্রত্যেকের উচিত নিজের জীবনে কল্যাণ আর সফলতার জন্য যেন নবীজীর সীরাত অধ্যয়ন করা।
• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence •
বিগত বছরের প্রশ্নসমূহ (এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ)
- (IST-501) Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) | Click for Details
- (IST-502) Introduction to Islamic Dawah | Click for Details
- (IST-503) Al-Sirat Al-Nababiah | Click for Details
- (IST-504) Human Rights in Islam | Click for Details
- (IST-505) Principles and History of Tafsir Literature | Click for Details
- (IST-506) Principles of Islamic Jurisprudence | Click for Details