Monday, December 23, 2024

মক্কা বিজয়ের বিবরণ দিন এবং এর ফলাফল আলোচনা করুন

প্রশ্ন: মক্কা বিজয়ের বিবরণ দিন এবং এর ফলাফল আলোচনা করুনবিষয়: (IST-503) Al-Sirat Al-Nababiahকোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)



ভূমিকা

যে মক্কাবাসীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গিয়েছিলেন, তারই ঠিক আট বছর পর সে মক্কা নগরীতে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রবেশ করলেন মহান বিজয়ী বেশে। যে মক্কা নগরী হতে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোন মতে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মদিনায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সে মক্কাবাসীদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মর্জির উপর। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কা বিজয় করে তাঁর ভূমিতে আল্লাহর দ্বীন ও স্বমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন।

মক্কা বিজয়ের কারণ

ক. সন্ধি অনুযায়ী মৈত্রী স্থাপন

হুদাইবিয়ার সন্ধির পর দু’টি বছর কেটে গিয়ে অষ্টম হিজরিতে রমযান মাস আসে। সন্ধির শর্ত ছিল যে. আরবের অন্যান্য জাতি তাদের ইচ্ছামত যে কোন পক্ষের সাথে মিত্রতা স্থাপন করতে পারবে। সন্ধি অনুযায়ী বনী খাযাআ গোত্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হয়। বনী বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে মৈত্রী আবদ্ধ হয়। খাযাআ ও বকও এ দু’গোত্রের মধ্যে দীর্ঘ দিনের শত্রুতা ছিল। আর এতেই হল সমস্যা।

খ. বনু বকর কর্তৃক বনু খাযাআ গোত্রে হামলা

বনু বকর ও বনু খাযাআ গোত্রের মধ্যে দীর্ঘ দিনের শত্রুতা ছিল। বনু বকর গোত্র প্রতিশোধ নেয়ার উত্তম সময় ভেবে সন্ধির শর্ত উপেক্ষা করে বনু খাযাআ গো্ত্রের উপর উক্রমণ করলো।

গ. বনু বকরের প্রতি কুরাইশদের সাহায্য

বনু বকর গোত্র অকস্মাৎ খাযাআ গোত্রের উপর আক্রমণ করল, তখন কুরাইশ নেতৃবৃন্ধ সন্ধির কথা ভুলে গিয়ে যুদ্ধ সম্ভার দিযে বনু বকর গোত্রে সাহায্য করেছিল। ইকরামা, ছাওয়ান ও সুহাইল রাতের অন্ধকারে মুখোশ পরে বনী বকরের সাথে যোগদান করল।


আরো পড়তে পারেন: মদীনায় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রধান কার্যাবলী বিবরণ দিন


ঘ. হেরেম শরিফের মর্যাদা ক্ষুণ্ন

বনু বকরের আকস্মিক হামলায় অনন্যোপায় হয়ে খাযাআ গোত্র হেরেম শরীফে আশ্রয় নিল। হেরেম শরিফের মর্যাদা রক্ষা জরুরি মনে করে প্রথমে বনু বকর আক্রমণ হতে বিতর হল। কিন্ত নওফেল বলল, এরূপ সুবর্ণ সুযোগ আর আসবে না। অবশেষে হেরেম শরিফের অভ্যন্তরেই বনু লোকদের হত্যা করা হল। লঙ্ঘন করা হল হেরেম শরিফের পবিত্রতা।

ঙ. কুরাইশ কর্তৃক হুদাইবিয়ার সন্ধি বাতিল ঘোষণা

হযরত মুহাম্মদ (স) এ ঘটনা জানতে পেরে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তিনি কুরাইশদেরকে দূত মারফত জানিয়ে দিলেন- “নিম্নলিখিত তিনটি শর্তের কোনটা তোমরা মেনে নেবে?”

  1. যুদ্ধে নিহতদের রক্তপণ দেয়া হোক
  2. বনু বকর গোত্রের সাথে কুরাইশ বনাম বনী বকর মিত্রতা ভঙ্গ করা হোক
  3. অথবা, ঘোষণা করা হোক হুদাইবিয়ার সন্ধি ভেঙ্গে গেছে।

কুরাইশরা তৃতীয় শর্তটি মেনে নিল।

মক্কা বিজয়ের ঘটনা প্রবাহ

ক. মহানবী (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রস্তুতি

দূতের কাছে সব কিছু শুনে হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বুঝতে পারলেন, কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। তিনি অবিলম্বে মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিলেন। মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ গোত্রসমূহকে দুত মারফত প্রস্তুত হয়ে আসতে নির্দেশ দিলেন। মক্কাবাসীরা যাতে এ  খবর জানতে না পারে সে জন্য পূর্ণ সাবধানতা অবলম্বন করা হল। অষ্টম হিজরির ১৮ই রমযান মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ১০ হাজার সাহাবীকে সাথে নিয়ে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। আরবদের তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেনাবাহিনীকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দিলেন। এতে সমগ্র মরুভুমি ঝলমল করে উঠল। কুরাইশ প্রধানগণ এ দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠল।


আরো পড়তে পারেন: বদর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা করুন


খ. মক্কার দিকে অগ্রসর

সোবেহ সাদেকের সঙ্গে সঙ্গে মরু উপত্যকা আযানের ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল। মুসলিম বাহিনী শয্যা ত্যাগ করল এবং জামায়াতে ফজর নামায আদায় করল। নামায শেষেই যাত্রার আদেশ হল। মুসলিম সেনাগণ মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হল।

গ. আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ

মরুভূমি ঝলমল করে উঠায় তথ্য জানতে এসে প্রহরী সৈন্য কর্তৃক আবু সুফিয়ান ধৃত হন। আটক আবু সুফিয়ানকে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ক্ষমা করে দেন। অবশেষে আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করে। মুসলমানদের বিশাল বাহিনী দেখে আবু সুফিয়ানের হৃদকম্পন শুরু হয়। সে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলে-

“মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তুমি কি তোমার স্বজনদেরকে (মক্কাবাসী) হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছ?” হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তর দিলেন, না- কখনই নয়। অতঃপর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবু সুফিয়ানকে বললেন, আবু সুফিয়ান- তুমি গিয়ে মক্কাবাসীকে অভয় দাও-আজ তাদের প্রতি কোন কঠোরতা হবে না। তুমি আমার পক্ষ থেকে ঘোষণা দাও-

  1. যে ব্যক্তি আত্মসমর্পন করবে, অথবা
  2. কাবায় প্রবেশ করবে
  3. যারা নিজেদের গৃহ দ্বার বন্ধ করে রাখবে, অথবা
  4. যারা আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, তাদেরকে অভয় দেয় হল।

শিশুর আধুনিক, সুন্দর ও অর্থবহ নাম


ঘ. মক্কায় মুসলিম বাহিনী

মক্কায় পৌছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইসলামের বিজয় পতাকা হনুজ নামক স্থানে উড্ডীন করতে নির্দেশ দিলেন। সৈন্যগণকে নিয়ে উচ্চভূমির দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য হযরত খালেদ (রা) কে আদেশ দিলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘোষণা করলেন, যতক্ষণ কেউ তোমাদের সঙ্গে লড়াই না করবে, তোমরা লড়াই করবে না।

ঙ. সামান্য যুদ্ধ

আবু জাহলের পুত্র ইকরামা ও সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া সসৈন্যে তীর নিক্ষেপ আরম্ভ করল। এতে করুজ ইবনে জাবের ফেহরী ও খুনাইজ ইবনে খালেদ (রা) শহীদ হন। ফলে হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ প্রতিশোধ গ্রহণ শুরু করলেন। যুদ্ধ বেঁধে গেল। মুসলমানগণ কাফিরদের মারতে মারতে মসজিদের দরজায় গিয়ে পৌঁছল, এতে ২৪ জন কাফির নিহত হল।

চ. মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শুকরীয়া আদায়

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কায় প্রবেশ করার পর আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে শুকরিয়া আদায় করলেন। খানায় কা’বার চতুর্দিকের এবং ভিতরের মূর্তি অপসারণ করা হল। অতঃপর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কা’বা অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নামায পড়লেন। মহাসমারোহে আল্লাহর ঘরে অগণিত মানুষ নামায আদায় করল। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কুরআনের বাণী ঘোষণা করলেন- “সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত আর মিথ্যার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।”



মক্কা বিজয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ

নির্বিঘ্নে ইসলাম প্রচার

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর সাহাবী মুসলমানগণ এতদিন নির্বিঘ্নে নিঃশঙ্ক চিত্তে ইসলাম প্রচার করতে পারতেন না। মক্কা বিজয়ের ফলে তিনি এখন আরব উপদ্বীপের একচ্ছত্র নেতা হলেন। নির্বিঘ্নে ইসলাম প্রচারের ফলে বেদুঈন, পৌত্তলিকসহ মক্কাবাসী দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করল। ঐতিহাসিক জোসেফ হেল বলেন, “এইরূপ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার আশার চরম সীমানায় উপনীত হন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মক্কা একত্ববাদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। গোটা আরব দেশ মদিনার ইসলামি সরকারের অধীনে আসল।”

নিশ্চিন্তে বসবাস

শত্রু কুরাইশদের মদিনা আক্রমণের আশংকায় মুসলমানদেরকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হত, কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর আর সে চিন্তা রইল না।

হজ্জ ও উমরা পালন

মক্কা বিজয়ের ফলে মুসলমানদের চিরকালের জন্য হজ্জ, উমরা ও তাওয়াফের সুযোগ সৃষ্টি হল। মক্কা বিজয়ের পর হতে আজ পর্যন্ত এ তিনটি কাজ কোন সময় ব্যাহত হয়নি।

প্রেম দ্বারা বিজয়ের শিক্ষা

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রক্ত দ্বারা নয়; বরং ক্ষমা ও প্রেম দ্বারা এ মহাবিজয় সম্পন্ন করলেন। প্রেমের এ বিজয়ের মহান শিক্ষা মুসলমানগণ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মক্কা বিজয় হতে গ্রহণ করলেন।



নব উদ্যমে মুসলমানদের তৎপরতা শুরু

মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানগণ নতুন জীবন লাভ করল। তাদের কণ্ঠে ফুটল নতুন ভাষা, বক্ষে জাগল নতুন আশা আর চক্ষে লাগল অনন্ত সম্ভাবনার স্বপ্ন। তাই মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানগণ নব উদ্যমে তাদের তৎপরতা শুরু করল। যার ঢেউ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

উপসংহার

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মক্কা বিজয় পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। জয়ের সমগ্র ইতিহাসে মক্কা বিজয়ের তুলনা নেই। মক্কা বিজয়ের বৈশিষ্ট্য মুসলমানগণ বিনা রক্তপাত মক্কা বিজয় করেছেন। প্রকৃত পক্ষে মুসলমানরা সন্ধির দ্বারা মক্কা বিজয় করতে চেয়েছিলেন; কিন্ত মক্কার কাফিরগণ হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্ত ভেঙ্গে মক্কা জয় করে নিতে সাহায্য করল।


• IST-501 : Study of Al-Quran (Surah: Al-Fatah and Al-Hujurat) • IST-502 : Introduction to Islamic Dawah • IST-503 : Al-Sirat Al-Nababiah • IST-504 : Human Rights in Islam • IST-505 : Principles and History of Tafsir literature • IST-506 : Principles of Islamic Jurisprudence

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,606FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles