নামাযের মধ্যে অস্বাভাবিক কোন কারণে বা মানুষের ইচ্ছাকৃত কোন কারণে যদি ওযূ নষ্ট হয়ে যায়, তবে ওযূর সঙ্গে সঙ্গে নামাযও বাতিল হয়ে যাবে। যেমন নামাযের মধ্যে যদি কারো গোসলের হাজত হয় বা খিলখিল করে হেসে উঠে, বা বেহুশ হয়ে পড়ে যায়, বা ইচ্ছাপূর্বক পেটের উল্টা বাতাস বাহির করে, তবে ওযূ তো নষ্ট হয়ে যাবেই, সঙ্গে সঙ্গে নামাযও নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্ত যদি অনিচ্ছাকৃত কোন স্বাভাবিক কারণে ওযূ ছুটে যায় (যেমন- যদি হঠাৎ অনিচ্ছায় পেটের উল্টা বাতাস বের হয়ে যায়, তবে ওযূ ছুটে যাবে।) তাহলে নামায ছেড়ে তৎক্ষাণাৎ ওযূ করে পুনরায় শুরু হতে নামায পড়ে, তবে তাই উত্তম এবং মোস্তাহাব। আর যদি এই অবস্থায় নামায বাকী রাখতে চায়, তবে তারও উপায় আছে।
নামাযরত অবস্থায় ওযু ছুটে গেলে নামায বাকী রাখার শর্তসমূহ
ওই অবস্থায় নামায বাকী রাখবার জন্য কতকগুলি শর্ত আছে। যেমন-
- ওযূ ছুটে যাওয়া মাত্রই নামায ছেড়ে দিবে এবং পুনরায় ওযূ করতে যাবে। সে অবস্থায় নামাযের কোন রোকন আদায় করবে না।
- ওযূ করতে যাওয়ার সময়ও কেরাআত ইত্যাদি কোন রোকন আদায় করবে না।
- কথাবার্তা ইত্যাদি যে সব কাজ নামাযের পরিপন্থী অথচ তা হতে বেচে থাকা সম্ভব, তা করবে না। (অবশ্য ওযূর পানি পূর্ব, দক্ষিণ বা উত্তর দিকে থাকলে মুখ না ফিরায়া যাওয়া অসম্ভব; কাজেই যাবার সময় ক্বেবলা দিক হতে মুখ ফিরিয়ে গেলে তাতে ক্ষতি হবে না।)
- ওযূ ছুটে যাওয়ার পর বিনা ওযরে এক রোকন আদায় করার সময় পরিমাণ দেরী করবে না। তাৎক্ষণিক ওযূ করতে হবে, অবশ্য জমা’আতে যদি অনেকগুলি কাতার থাকে এবং প্রথম কাতার হতে আসতে আসতে কিছু দেরী হয় বা নিকটে পানি না থাকা অবস্থায় পানির কাছে যেতে কিছু দেরী হয়, সে দেরীতে ক্ষতি হবে না।
নামাযের মধ্যে ওযূ নষ্ট যাওয়া সংক্রান্ত কতগুলো মাসআলা
- মোনফারেদের যদি নামাযের মধ্যে ওযূ ছুটে যায়, তবে ওযূ করে পুনরায় শুরু হতে নামায পড়াই তার জন্য উত্তম। কিন্ত যদি সে ‘বেনা’ করতে অর্থাৎ যে পর্যন্ত পড়েছে সে পর্যন্ত ঠিক রেখে ওযূ করে তার পর হতে অবশিষ্ট টুকু পড়ে নামায শেষ করতে চায়, তবে সে ওযূ নষ্ট হওয়া মাত্রই নামায ছেড়ে দিয়া তৎক্ষণাৎ ওযূ করবে। ওযূ করতে সর্বাপেক্ষা অধিক নিকটবর্তী পানির দ্বারা অতি শীঘ্র ওযূ করবে। (কিন্ত ওযূর সুন্নত, মোস্তাহাব ছাড়বে না) ওযূর নিকটবর্তী স্থানেই অবশিষ্ট নামায পড়বে, যদি পূর্বের স্থানে যাওয়ার সুযোগ থাকে, তাও জায়েয আছে।
- ইমামের যদি নামাযের মধ্যে ওযূ ছুটে যায় (এমন কি, আখেরী বৈঠকের মধ্যেও ওযূ নষ্ট হয়ে যায়) তবে তার জন্যও এক দিকে সালাম ফিরায়া নামায ছেড়ে ওযূ করে নতুনভাবে নামায পড়া আফযল; কিন্ত যদি ‘বেনা’ ও ‘এস্তেখলাফ’ করতে চায় অর্থাৎ, যে পর্যন্ত পড়েছে তারপর হতে মুক্তাদীদের মধ্যে হতে অন্য একজন দ্বারা পড়াতে চায়, তবে তার দিকে ইশারা করে খলীফা (কায়েম মকাম) বানিয়ে ওযূ করতে যাবে। এক্ষেত্রে মুদরেককে খলীফা বানানো উত্তম। যদি মাসবুককে খলীফা বানায় তবুও জায়েয। কিন্ত মসবুককে ইশারায় বলে দিবে যে, আমার উপর এত রাকা’আত ইত্যাদি বাকী আছে। রাকা’আতের জন্য আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করবে। যেমন- এক রাকা’আত বাকী থাকলে এক আঙ্গুল দুই রাকা’আত বাকী থাকলে দুই আঙ্গুল উঠাবে। রুকূ বাকী থাকলে হাটুর উপর হাত রাখবে, সেজদা বাকী থাকলে কপালে, কেরাআতবাকী থাকলে মুখের উপর, সেজদায়ে তেলাওয়াত বাকী থাকলে কপালে এবং জিহ্বার উপর, সেজদায়ে সাহু করতে হলে সীনার উপর হাত রাখবে। অবশ্য যখন সেও এই সঙ্কেত বুঝে, নচেৎ তাকে খলীফা বানাবে না। তারপর ওযু করে এসে যদি জমা’আত পায়, তবে মুক্তাদী স্বরূপ শামিল হয়ে যাবে এবং অবশিষ্ট নামায যা জমা’আতে সঙ্গে পেয়েছে তা মুক্তাদী স্বরূপ এবং যদি দুই এক রাকা’আত মাঝখানে ছুটে যেয়ে থাকে তা লাহেকরূপে পরে পড়বে। যদি ওযূর স্থানে দাড়িয়ে এক্তেদা করে, তবে যদি মাঝখানে এমন কোন জিনিস বা ব্যবাধান থাকে, যাতে এক্তেদা দুরুস্ত হয় না, তবে তথায় থেকে এক্তেদা করা দুরুস্ত হবে না। আর যদি ওযূ করে জমা’আত না পায়, তবে এক একা অবশিষ্ট নামায পড়বে (ওযূর স্থানে পড়ুক বা জমা’আতের কাতারে এসে পড়ুক)।
আরো পড়তে পারেন: সন্তানের উপর পিতা মাতার ১৪টি হক
- পানি যদি মসজিদের ভিতরেই থাকে, তবে খলীফা বানান ছাড়াও ইচ্ছা করলে ‘বেনা’ করতে পারে। নামায ছেড়ে দিয়া অতি শীঘ্র ওযূ করে অবশিষ্ট অংশ পূর্ণ করবে ইমাম যথাস্থানে ফিরে না আসা পর্যন্ত মুক্তাদীগণ যে অবস্থায় আছে ঐ অবস্থায় অপেক্ষায় থাকবে।
- খলীফা বানানোর পর, ইমাম আর ইমাম থাকবে না, মুক্তাদী হয়ে যাবে। কাজেই যদি জমা’আত শেষ হয়ে যায়, তবে অবশিষ্ট নামায তিনি লাহেকরূপে পড়বেন। যদি ইমাম কাউকে খলীফা না বানান, কোন মুক্তাদী নিজে আগে সামনে যায় বা মুক্তাদী তাকে ইশারা করে আগে আসতে দেয়, তবুও দুরুস্ত হবে। কিন্ত যতক্ষণ ইমাম মসজিদে ভিতরে আছেন, কিংবা যদি নামায মসজিদে না হয়, তবে কাতার কিংবা ছোতরা হতে আগে না যায়, ততক্ষণ এইরূপ হতে পারবে, নতুবা ইমাম যদি খলীফা না বানায়া মসজিদ হতে বাইরে না যায়, তবে সকলের নামায ফাসেদ হবে এবং কেও আর খলীফা হতে পারবে না।
- মুক্তাদীর যদি নামাযের মধ্যে ওযূ ছুটে যায়, তবে তার জন্যও ‘বেনা’ না করে তৎক্ষণাৎ ওযূ করে মাসবুকরূপে জমা’আতে শরীক হওয়া বা জমা’আত না পাইলে এক একা নুতন করে নামায পড়া উত্তম। কিন্ত যদি ‘বেনা’ করতে চায়, তবে তৎক্ষণাৎ ওযূ করে যদি জামা’আত বাকী থাকে জমা’আতে শামিল হয়ে যাবে। নামাযের জন্য যদি প্রথম জায়গায় যেতে পারে, তবে ভাল (নতুবা পিছনের কাতারে দাঁড়িয়ে যতটুকু জমা’আতে পায় ততটুকু মাসবুকরূপে জমা’আতের সঙ্গে পড়বে এবং যদি দুই এক রাকা’আত মাঝখানে ছুটে যেয়ে থাকে তা পরে লাহেকরূপে পড়বে।) কিন্ত যদি ইমাম ও তার ওযূর স্থানের মধ্যে এক্তেদায় বাধাজনক কোন জিনিস না থাকে, তবে এখানেও দাঁড়ানো জায়েয আছে। আর যদি জমা’আত শেষ হয়ে গিয়ে থাকে তবে ওযূর নিকটবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে অবশিষ্ট নামায লাহেকরূপে পড়া উত্তম। যদি পূর্ব স্থানে গিয়া পড়ে তাও জায়েয আছে।
- ইমাম যদি মাসবুক মুক্তাদীকে খলীফা বানায়, তাও জায়েয আছে, কিন্ত তা হলে সে ইমামের অবশিষ্ট নামায পূর্ণ করে সালাম ফিরাবে না, সালাম ফিরাবার জন্য একজন মোদরেক মুক্তাদীকে ইশারা দ্বারা আগে বাড়াইয়া নিবে; নিজে একটু বসে দাঁড়ায়া যে সব রাকা’আত তার আগে ছটে গিয়েছে, তা পড়ে শেষে পৃথকভাবে সালাম ফিরাবে। এই জন্যই মোদরেককে খলীফা বানান উত্তম।
- শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পড়ার পর সালাম ফিরাবার আগে যদি অনিচ্ছায় (বা স্বাভাবিক উপায়ে) কারও ওযূ ছুটে যায়, কিংবা পাগল হয়ে যায়, বা গোসলের হাজত হয়, বা বেহুশ হয়ে যায় তবে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে এবং পুনরায় নুতন করে নামায পড়তে হবে। (বেনা করতে পারবে না।)
- বেনা এবং এস্তেখলাফের মাসআলা অতি সূক্ষ্ম। তা স্বরণ রাখা অতি কঠিন। তাছাড়া একটু ভুল হলেই নামায নষ্ট হবার প্রবল আশঙ্কা আছে। কাজেই বেনা এবং এস্তেখলাফ না করে ওযূ নষ্ট হয়ে গেলে ডান দিকে সালাম ফিরায়া নামায ছেড়ে দিয়া ওযূ করে নতুন করে নামায পড়াই উত্তম।
তথ্য সূত্র
- বেহেশতী জেওর • লেখক: হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) • অনুবাদক: হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)