শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষার মাধ্যমে হযরত আদম আ. ফেরেশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছেন। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তার রবকে চিনতে পারে, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা এবং হক-বাতিলের মাঝে পার্থক্য করতে পারে। উন্নতি-অগ্রতি এবং উভয় জাহানের শান্তি-সফলতা ও কামিয়াবীর সোপানে আরোহণ করতে পারে । শিক্ষার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “দ্বীনী ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয।” (সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং ২২৪)
আমাদের দেশের অনেক বিজ্ঞজন (?) এই হাদীসে উল্লেখিত ইলম বা বিদ্যা দ্বারা ব্রিটিশ সিলেবাস তথা দুনিয়াবী শিক্ষা উদ্দেশ্য নিয়ে থাকেন, যা স্পষ্টই ভুল। কারণ যে শিক্ষার দ্বারা মানুষ নিজের রবকে চিনতে পারে না, যে শিক্ষার দ্বারা মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে পারে না, যে শিক্ষা গুনাহ থেকে বাঁচতে শিখায় না তাকে ইলম বলে না। দুনিয়াবী শিক্ষা তো দূরের কথা, দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরও কেউ যদি গুনাহ থেকে বেঁচে না থাকে, নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়তে না পারে, তাহলে তার শিক্ষাকেও শরীয়াতের দৃষ্টিতে ইলম বলা হবে না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেছেনঃ
وَمِنَ النَّاسِ وَالدَّوَآبِّ وَالۡاَنۡعَامِ مُخۡتَلِفٌ اَلۡوَانُہٗ کَذٰلِکَ ؕ اِنَّمَا یَخۡشَی اللّٰہَ مِنۡ عِبَادِہِ الۡعُلَمٰٓؤُا ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَزِیۡزٌ غَفُوۡرٌ
‘নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে কেবল আলেমগণই আল্লাহকে ভয় করে’ (সূরা ফাতিরঃ২৮)।
এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রকৃত আলেম তথা শিক্ষিত তারাই যারা আল্লাহকে ভয় করে। অতএব, ইলম তথা শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি হতে হবে খোদা ভীতির উপর আর দ্বীনী শিক্ষার ভিত্তিও হলো খোদা ভীতির উপর। তাই হাদীসে বর্ণিত ইলম দ্বারা যে খালেস দ্বীনী শিক্ষা উদ্দেশ্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে দুনিয়াবী বিদ্যা হাসিল করা কি জায়িয নেই? এর উত্তর হলো: ফরয পরিমাণ ইলম অর্জনের পরে কেউ যদি দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জন করে, চাই দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ হাসিলের জন্য করুক বা দ্বীনের খেদমতের নিয়তে করুক, তাতে কোনো সমস্যা নেই; বরং শরীয়ত মোতাবেক চলে দ্বীনের খেদমতের উদ্দেশ্যে যদি কেউ দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জন করে তাহলে তাতে সে সাওয়াবেরও আশা করতে পারে। কারণ হাদীসে এসেছে ‘কর্মের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভর করে’ (বুখারী হা.নং ১)
কিন্তু বাস্তব কথা হলো, স্কুল-কলেজে ফরয পরিমাণ ইলম শিক্ষা দেয়া হয় না এবং সেখানে শরীয়ত মোতাবেক চলতে উৎসাহিত করা হয় না; বরং সেখানে এমন অনেক মতবাদ শিক্ষা দেয়া হয় যা ঈমানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনেক স্কুলের পরিবেশই এমন যে, কেউ চাইলেও শরীয়ত মোতাবেক চলতে পারে না। এমতাবস্থায় দুনিয়ার ৬০-৭০ বছরের যিন্দেগীর কল্পিত সুখ-শান্তির আশায় নিজেকে এবং নিজের সন্তানকে নৈতিকতা বিবর্জিত দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত করা উচিত হবে নাকি পরকালের অশেষ-অসীম যিন্দেগীর সুখ-শান্তি অর্জনের আশায় নিজেকে এবং নিজের সন্তানকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করা উচিত হবে? এর ফয়সালার ভার সুবিবেচকের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেয়া হলো।
আজকাল লাখো মানুষ দ্বীনের সঠিক বুঝ না থাকার কারণে নিজের বুঝকে সঠিক মনে করে নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে দু- চার পয়সার লোভে কিংবা দুনিয়াবী সম্মানের আশায় দ্বীনী ইলম শিক্ষা না দিয়ে দুনিয়াবী শিক্ষা নামের ব্রিটিশদের তৈরি করা শিক্ষা কারিকুলাম পড়াচ্ছে।
আবার কেউ কেউ তো দ্বীনী শিক্ষার ব্যাপারে নিম্নোক্ত মন্তব্য করতেও কুণ্ঠা বোধ করে না।
- ‘(কওমী) মাদরাসার বিদ্যা ফকীরি বিদ্যা’ (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ কুরআন-হাদীসের ইলমের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করার কারণে ঐ লোকের ঈমান ধ্বংস হওয়ার যথেষ্ট আশংকা রয়েছে।
- ‘মাদরাসায় লেখা-পড়া করলে না খেয়ে মরবে’। অথচ দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো লোক না খেয়ে মরেছে এর কোন প্রমাণ বা উদাহরণ তারা দেখাতে পারে না এবং পারবেও না ইনশাআল্লাহ। কারণ আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় বান্দাদেরকে না খাইয়ে মারবেন না।
- কিছু দ্বীনদার (?) লোক মনে করে সন্তানকে (কওমী) মাদরাসায় পড়ানোর দরকার নেই। স্কুল-কলেজে পড়াবো। তারপর সন্তান বড় হলে তাকে দ্বীনের রাস্তায় মেহনত করার সুযোগ করে দিয়ে দ্বীনদার বানিয়ে নিব। অথচ স্কুলে পড়ে সে বদ্দীন হবেনা তার গ্যারান্টি কে দিবে? অথবা দ্বীনদার হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই সে মারা গেলে তার পরিণতি কী হবে? তা মোটেও ভেবে দেখে না।
মানুষ যাতে দ্বীনী শিক্ষা ও দুনিয়াবী শিক্ষার পার্থক্য বুঝতে পেরে নিজেকে এবং নিজের সন্তানকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারে, তাই নিম্নে দ্বীনী শিক্ষা ও দুনিয়াবী শিক্ষার মধ্যে বাস্তব কিছু পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর মহামানব তথা নবী-রাসূলগণের ওয়ারিশ অর্থাৎ তারা ‘নায়েবে নবী’। কেননা নবী-রাসূলগণ শুধু ইলমের ওয়ারিশ বানান, অর্থ-কড়ির নয়। আর এরাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইলম শিখে, টাকা-পয়সার জন্য নয়। (মাজমাউয যাওয়েদ হা.নং ৫২৩)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা ঐ শিক্ষার সিলেবাস যারা তৈরি করেছে তাদের ওয়ারিশ। নবী-রাসূলগণের ওয়ারিশ নয়, কেননা তারা শিক্ষা অর্জনই করে টাকা-পয়সা কিংবা কোনো পদ হাসিলের জন্য।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদেরকে নবীগণের বাস্তব ওয়ারিশ বানানোর জন্য তাদেরকে ঈমান, আমল, দাওয়াত, তা‘লীম, তাযকিয়া শিক্ষা দেওয়া হয়। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষার শিক্ষার্থীদেরকে কীভাবে দুনিয়া উপার্জন করা যাবে তা শিক্ষা দেওয়া হয়। ঈমান-আমল সেখানে গুরুত্বহীন বিষয়।
- যারা দ্বীনী শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয় তাদের সম্মানার্থে ফেরেশতারা নিজেদের নূরের পাখা বিছিয়ে দেয়। (আবূ দাঊদ হা.নং ৩৬৪১)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষার ছাত্রদের ব্যাপারে ফেরেশতাদের পাখা বিছানোর কোনো হাদীস নেই।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা যেহেতু ইবাদত-বন্দেগী করে থাকে, তাই তাদের দ্বারাই আল্লাহ তা‘আলার দুনিয়াতে মানুষ পাঠানোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে মানুষ পাঠিয়েছেন তার ইবাদত করার জন্য। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার দুনিয়ায় মানুষ পাঠানোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ তারা সাধারণত আল্লাহর নির্দেশ মতো চলে না। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি উলামায়ে কেরামের সুহবতে আসে বা দাওয়াতের কাজে জুড়ে থাকে সেটা ভিন্ন কথা।
- খালেস দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কেউ বেকার থাকে না। তাদের কারণে দেশের বেকারত্ব বাড়ে না; বরং তারা একদিকে নিজ দেশে দ্বীনের খেদমত করছেন অন্য দিকে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইমাম, মুয়ায্যিন, মাদরাসার শিক্ষক হয়ে কিংবা অন্য কোন খেদমত করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন, যার দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হচ্ছে। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতদের অনেকেই বেকার থাকছে। কারণ দুনিয়াবী শিক্ষাটা হলো ‘কর্মমুখী শিক্ষা’ অর্থাৎ এ শিক্ষায় শিক্ষিতরা দুনিয়ার বিভিন্ন কর্ম করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে কর্মের সুযোগ কম থাকায় আর কর্মের প্রার্থী বেশি হওয়ায় অনেক বড় বড় ডিগ্রিধারীরাও বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ অবধি বেকারত্বের কারণে কেউ অর্থ উপার্জনের অনৈতিক পথ বেছে নিচ্ছে, আবার কেউবা ছিনতাই রাহাজানির মতো ভয়ংকর পথ বেছে নিতে দ্বিধা করছে না।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষাকেন্দ্র কওমী মাদারেসে দ্বীনী শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজন পরিমাণ বাংলা, অংক, ইংরেজী ইত্যাদি শিক্ষা দেয়া হয়। আর এখানে সরকারের কোন অনুদান নেয়া হয় না। যার কারণে সরকার নিজের খেয়াল-খুশি মোতাবেক এখানকার সিলেবাস পরিবর্তন করতে পারে না। পক্ষান্তরেঃ স্কুল-কলেজে প্রয়োজন পরিমাণ দ্বীনী ইলম শিক্ষা দেওয়া হয় না। আর স্কুল-কলেজ সরকারী হওয়ায় বা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ সরকারের অনুদান গ্রহণ করায় সরকার চাইলেই নিজের খেয়াল-খুশি মোতাবেক সিলেবাস পরিবর্তন করতে পারে। আর এতে যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
- কওমী মাদারেসে ফরযে আইন এবং ফরযে কেফায়া উভয় প্রকারের ইলম শিক্ষা দেয়া হয়, যার দ্বারা এখানকার শিক্ষার্থীরা নিজেকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা থেকে বাঁচাতে পারে আবার সাধারণ মানুষকেও সিরাতে মুস্তাকীম এর উপর পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষার শিক্ষা কেন্দ্র স্কুল-কলেজে ইলমের কিছু তো নেই-ই; বরং তাদের সিলেবাসে ঈমান বিধ্বংসী অনেক মতবাদ রয়েছে। যার একটি মানাই ঈমান ধ্বংস হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যেমনঃ জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের মূল সমস্যা বলে আখ্যায়িত করা।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদেরকে প্রকৃত অর্থে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদেরকে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, গুরুজন, প্রতিবেশী এমনকি প্রাণীর হকও শিক্ষা দেওয়া হয়। যার ফলে তারা প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে উঠে। পক্ষান্তরেঃ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় না। পত্রিকা খুললেই স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটির ছাত্রদের কীর্তি (?) দেখে চোখ ধাঁদিয়ে যায়। আজকাল তো তারা বিশেষভাবে শিক্ষকদের পিটাতে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে। তাছাড়া ওখানকার ছাত্ররাই তো পথে-ঘাটে ইভ-টিজিং করে বেড়াচ্ছে।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা নিজ পিতা-মাতার জানাযা নামায পড়ানোর যোগ্যতাও অর্জন করে এবং কেবল তারাই সহীহভাবে পিতা-মাতার রূহে সাওয়াব রেসানী করতে পারে। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত কোন লোকেরই এই যোগ্যতা নেই যে, সে ঐ বিদ্যা দিয়ে পিতা-মাতার জানাযা নামায পড়াবে বা তাদের রূহে সাওয়াব রেসানী করবে কিংবা তাদের মৃত্যুর পরের হকগুলো আদায় করবে।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা নিজ পিতা-মাতার জন্য সদকায়ে জারিয়া স্বরূপ। অর্থাৎ পিতা-মাতা মৃত্যুর পরও কিয়ামত পর্যন্ত আলেম তথা নেক সন্তানের নেক আমলের সওয়াব পেতে থাকবে। (তিরমিযী হা.নং ১৩৭৬)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেই নিজ পিতা-মাতার জন্য গুনাহে জারিয়া স্বরূপ। অর্থাৎ পিতা-মাতা মৃত্যুর পরও তাদের বদ আমলের ভাগীদার হতে থাকে। কারণ তারা তাদেরকে কোনো নেক আমল শিক্ষা দেয়নি এবং জীবিত অবস্থায় তাদেরকে গুনাহের কাজ করতে নিষেধ করেনি।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা দুনিয়ার মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার পথ দেখায় এবং জান্নাতের রাহবারী করে। এজন্যই তারা বিভিন্ন মাদরাসা-মসজিদে, মাঠে-ময়দানে কুরআন-হাদীসের কথা জনসাধারণকে শুনিয়ে থাকে। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেই মানুষকে জাহান্নামের পথ দেখায়। যেমনঃ তারা নাটক, সিনেমা ইত্যাদি তৈরি করে তা দেখার জন্য মানুষকে প্রেক্ষাগৃহে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। অনেকে লেখনীর মাধ্যমে নাস্তিক্যবাদ প্রচার করে। তাছাড়া আরো অগণিত উদাহরণ আপনি ভাবলেই পেয়ে যাবেন।
- হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা যখন শিক্ষা অর্জনের জন্য বসে তখন ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে, আল্লাহর রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেয় এবং তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয়। (জামিউ বয়ানিল ইলম হা.নং ৪৫)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে এ ধরণের কোনো ফযিলত নেই; বরং তারা তো শিখতে বসে ক্লাস রুমেও অনেক গুনাহের কাজ করে। যেমনঃ ছেলেদের মেয়েদেরকে দেখা, মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করা।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা ইসলাম ধর্ম টিকিয়ে রাখছে। কারণ ইলম শিক্ষার ধারা বন্ধ হয়ে গেলে ধীরে-ধীরে পৃথিবী থেকে ইসলাম উঠে যাবে। আর সাধারণ মানুষ যে যতটুকুই দ্বীন পালন করছে বা দ্বীনের চর্চা করছে তা এদের উসিলায় করছে। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজদের অনুকরণ করে এবং তাদের অর্থে পরিচালিত এনজিওগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে ইসলাম ধর্মের অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতে সাহায্য করছে। বাংলাদেশে দিন দিন খৃষ্টানদের সংখ্যা বেড়ে চলাই এর প্রমাণ বহন করে। সামান্য অর্থের লোভে বাংলাদেশী ছেলে-মেয়েরাই তো এসব এনজিওতে কাজ করছে।
- হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের শেষ পরিণাম কল্যাণকর হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা যার কল্যাণ চান তাকেই দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করেন। (জামেউ বয়ানিল ইলম হা.নং ৮০.)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতদের শেষ পরিণাম অজানা; বরং বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাদের শেষ পরিণাম সুখকর হবে না। যারা আল্লাহর হুকুম মানবে না তাদের শেষ পরিণতি খারাব হওয়াই স্বাভাবিক।
- হাদীসের ভাষ্য মোতাবেক ‘দুনিয়ার গোটা সৃষ্টিজগত দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীর জন্য দু‘আ করে’। (আবূ দাঊদ হা.নং ৩৬৪১ )। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতরা এ দু‘আ থেকে বঞ্চিত থাকে।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা আল্লাহর বন্ধু। কারণ তারা আল্লাহর হুকুম মোতাবেক জীবন যাপন করে। আর তারা শয়তানের শত্রু কারণ তারা শয়তানের বিরুদ্ধাচরণ করে।পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতরা যদি কোনোভাবে দ্বীন না শিখে, চাই উলামায়ে কেরামের সুহবতে এসে হোক কিংবা অন্য কোনোভাবে হোক, তাহলে এর বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। কারণ তখন তারা না জানার কারণে বা আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন না করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই শয়তানের পথে পরিচালিত হবে।
- প্রকৃত দ্বীনী শিক্ষার প্রকৃত শিক্ষার্থীরা মুসলমানদের সর্বক্ষেত্রে ইমাম হওয়ার (নেতৃত্ব দেয়ার) যোগ্যতা রাখে। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতরা মুসলমানদের প্রতি দিনের আমল পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের ইমামতীটুকু করার যোগ্যতা রাখে না।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা দুনিয়ার অর্থের লোভে নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয় না। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতরা এক দুই টাকার লোভেও নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে কুণ্ঠা বোধ করে না। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের বারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হওয়াই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা আল্লাহ তা‘আলার নির্বাচিত বান্দা (সৈনিক)। এদের মাধ্যমে তিনি নিজ দ্বীনের হেফাজত করছেন। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতরা ইংরেজদের মানস সন্তান। কারণ তারা তাদের চিন্তা-চেতনাই লালন করে।
- হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী, হক্কানী আলেম-উলামা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত। কারণ গোমরাহীর অন্ধকারে মানুষ তাদের মাধ্যমে সুপথ পেয়ে থাকে। (মাজমাউয যাওয়ায়িদ হা.নং ৪৮৯)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতদের কোনো ফযিলত নেই; বরং তাদের কারো কারো মাধ্যমে পৃথিবী গোমরাহীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। তবে কেউ ব্যক্তিগতভাবে দ্বীনদার হলে সেটা ভিন্ন কথা।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের উসিলায় আল্লাহ তা‘আলা সারা দুনিয়ার মানুষকে রিযিক দিচ্ছেন, খাওয়াচ্ছেন এবং পরাচ্ছেন। (তাহযীবে তারীখে দামেস্ক ৫/ ৪৩৮)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্য থেকে অনেকের ভয়ানক গুনাহের কারণে দুনিয়ার মানুষকে আযাবে এবং দুর্ভিক্ষে পড়তে হয়।
- খালেস দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা (কওমী মাদরাসার ছাত্ররা) ইসলামের ইউনিফর্ম পরে থাকে। যেকেউ তাদেরকে দেখলেই খাঁটি মুসলিম মনে করতে বাধ্য হয়। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতরা বিধর্মীদের ইউনিফর্ম পরে থাকে। ফলে সে মুসলিম না কাফের বাহ্যিকভাবে তা বুঝার কোনো উপায় থাকে না।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর ‘হায়াত’। যত দিন তারা দ্বীন চর্চায় লিপ্ত থাকবে ততদিন আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াকে বহাল রাখবেন। কিয়ামাত ঘটাবেন না। (মুসলিম হা.নং ১৪৮)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতরা যত বড় ডিগ্রিধারীই হোক না কেন, তাদের কারণে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াকে টিকিয়ে রাখবেন না; বরং দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা যত বাড়বে পৃথিবী ততই কিয়ামাতের দিকে এগিয়ে যাবে।
- দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিতরা মৃত্যু পর্যন্ত দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে থাকেন, অবসর গ্রহণ করেন না। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতদের অনেকে তো চাকুরিই পায় না। আর পেলেও ৩০-৩৫ বছর পর অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
- দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিতদেরকে হাশরের ময়দানে প্রচন্ড রোদের মাঝে যখন আল্লাহ তা‘আলার আরশের ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া থাকবে না, তখন তাদেরকে আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দেওয়া হবে। (তিরমিযী হা.নং ২৩৯১)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য এ ধরনের কোনো ওয়াদা বা আশ্বাস কুরআন-হাদীসের কোথাও বর্ণিত হয়নি; বরং তারা সংশোধন না হলে, হাশরের ময়দানে তাদেরকে ভয়ানক অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।
- দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিতদের লকব বা সনদ চিরস্থায়ী। বেহেশতে প্রবেশ করেও তারা এ উপাধিতে ভূষিত হবেন। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিতদের সনদ একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। অবসর গ্রহণের পরই তাদের সনদ অনেকাংশে অকেজো হয়ে পড়ে। আর মরার পর কবরে ও হাশরে এ সনদের কোনো মূল্যায়নই হবে না।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের পিতা-মাতা বা অন্য যে কেউ যত টাকা খরচ করে তাতে সে বে-হিসাব সাওয়াব পায়। (সহীহ ইবনে হিব্বান হা.নং ৪৬২৯)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের জন্য টাকা খরচ করলে সাওয়াব হবে এমন কোনো কথা কুরআন-হাদীসে নেই; বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের পিছনে টাকা ব্যয় করলে গুনাহ হয়। যেমনঃ অভিনয়, নাচ-গান, প্রাণীর ছবি আঁকা ইত্যাদি শিখার ক্ষেত্রে যে টাকা ব্যয় করা হয় তাতে গুনাহ হয়।
- দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থী যদি ইলম শিক্ষা করা অবস্থায় ইন্তেকাল করে তাহলে সে শহীদের মর্যাদা লাভ করে। (আবূ দাঊদ হা.নং ৩৬৪১)। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষার শিক্ষার্থী শিক্ষাকালীন অবস্থায় মারা গেলে এ মর্যাদা পাবে না; বরং গুনাহের কোনো কিছু শিক্ষারত অবস্থায় মারা গেলে খারাব পরিণতির আশংকাই প্রবল।
- হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা মহান আল্লাহ তা‘আলার পরিবারের সদস্য। সুতরাং পরকালে তাদের বিশেষ পাওয়ার থাকবে । (মুসনাদে আহমাদ ৩/১২৮)।। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা আল্লাহর পরিবারের সদস্য হওয়া তো দূরের কথা তারা অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহর শত্রু সাব্যস্ত হয়ে যায়।
- সর্বোপরি দ্বীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের মাঝে খোদাভিরুতা, নম্রতা, ভদ্রতা, এবং চারিত্রিক উৎকর্ষতার গুণ থাকার কারণে তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং বিভিন্ন ফেতনায় জর্জরিত সমাজকে জাহিলিয়াতের অতল গহবর থেকে উঠিয়ে হেদায়েতের আলোকে উদ্ভাসিত করতে পারে। আদর্শ, সুশীল সমাজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। যা দেশ ও জাতির জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষণ। পক্ষান্তরেঃ দুনিয়াবী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের দ্বারা অসামাজিক কার্য-কলাপ। যেমনঃ হত্যা, লুণ্ঠন, রাহাযানী, ধর্ষণ, ইভ-টিজিং, গাড়ী ভাংচুর, মারা-মারি, কাটা-কাটি, নেশা-মদ্যপান ইত্যাদি জঘন্য কর্মকান্ড সংঘটিত হওয়ার কারণে আদর্শ সমাজও বর্বর যুগের অসভ্য সমাজে পরিণত হতে বাধ্য। আজ নৈতিকতা বিবর্জিত, ধর্মহীন শিক্ষার কারণেই দেশজুড়ে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তারপরও কি আমরা সন্তানদেরকে দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত করার দুঃসাহস দেখাতে পারি!
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার এবং নিজ অধীনস্থদের উক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার তাওফিক দান করুন। আমীন ।