Friday, November 22, 2024

ইসলামি ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রম বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করুন।

প্রশ্ন: ইসলামি ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রম বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করুন। বিষয়: IST-605 : Trade, Commerce and Business Studies in Islam কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (ফাইনাল)



ইসলামি ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রম বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করুন।

ভূমিকা

ইসলামি ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংক সমূহের ন্যায় সুদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেনি। তাছাড়া ইসলামি ব্যাংক শুধু সুদকে পরিহার করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং সকল কর্ম কান্ডের সকল স্তরের ইসলামি শরী’আতকে অনুসরণ করে ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর আর্থ-সামাজিক ও শরীআতী প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ইসলামি ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা তার মৌলিক বিধান ও কর্মপদ্ধতির সকল স্তরে ইসলামি শরী’আতের নীতিমালা মেনে চলতে বদ্ধপরিকর এবং রাষ্ট্রীয় কর্ম-কান্ডের সকল পর্যায়ে সুদ বর্জন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

ইসলামি ব্যাংকের উৎপত্তি

ইসলামের প্রাথমিক যুগে বর্তমান কালের মত প্রাতিষ্ঠানিক কোন ব্যাংকের অস্তিত্ব ছিল না, তবে সরকারী কোষাগার ছিল, যাকে বায়তুল মাল বলা হত। তখনকার প্রয়োজনীয় আর্থিক লেন-দেন সমাপনের জন্য এ বায়তুল মালই যথেষ্ট ছিল। বায়তুল মালের লেন-দেন ছিল সম্পূর্ণ সুদমুক্ত। অতীতের এ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই মুসলিম বিশ্বে ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।


No posts


মদীনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ইসলামের অর্থনৈতিক বিধানসমূহ প্রবর্তন করা হয়। সুদ বর্জন করার নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। উমাইয়া শাসনামলে ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। এরপর থেকে মুসলমানরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত একটি উন্নত ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু রাখতে সক্ষম হয়।

অষ্টাদশ শতকে পাশ্চাত্য জগতের সংস্পর্শে আসার পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে সুদবিহীন ইসলামি অর্থব্যবস্থা চালু ছিল। এই শতকে ইসলামি অর্থব্যবস্থার উপর পাশ্চাত্য অর্থ ব্যবস্থা প্রাধান্য বিস্তার করে এবং মুসলিম অর্থনীতি তথাকথিত মুক্ত অর্থনীতির সংস্পর্শে আসে। তখন হতে সুদের সাথে মুসলমানদের পরিচয় ঘটে এবং ধীরে ধীরে তা মুসলমানদের জীবন যাত্রার সাথে মিশে যায়।



সুদের প্রবর্তন

ইসলামের প্রাথমিক যুগে আধুনিককালের ন্যায় কোন ব্যাংকের অস্তিত্ব ছিল না বটে কিন্তু মুসলমানগণ ইসলামি পদ্ধতিতে নিজস্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। আল্লাহর রাসূল (সা) ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় আর্থিক লেনদেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্যে ‘বায়তুল মাল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘বায়তুল মাল’ এর লেনদেন ছিল সম্পূর্ণ সুদমুক্ত। পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদুনের যুগেও ‘বায়তুল মাল’ বহাল ছিল এবং ইসলামি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় আর্থিক লেনদেন ‘বায়তুল মাল’ এর মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হতো। প্রাথমিক যুগের এ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই মুসলিম দুনিয়ার আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে।

ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা কেবল আরব জাহানেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সমগ্র বিশ্বেই ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা চালু ছিল। এমন এক যুগ ছিল যখন বিশ্বের শাসন ক্ষমতা ছিল মুসলমানদের হাতে; আর চালু ছিল সুদবিহীন অর্থ ব্যবস্থা। অষ্টাদশ শতকে পাশ্চাত্য জগতের সংস্পর্শে আসার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় সমগ্র বিশ্বে সুদ বিহীন অর্থ ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু মুসলিম জাতি বিবিধ কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। অষ্টাদশ শতকে পাশ্চাত্য শক্তি মুসলিম দুনিয়ার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং মুসলিম জাতি সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির সংস্পর্শে আসে। ফলে সুদ বিহীন ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।



ইয়াহুদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সুদী ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে সুদকে মুসলিম জাতির উপর চাপিয়ে দেয় এবং ইসলামি নতিমালার ভিত্তিতে আল্লাহর রাসূল (সা) কর্তৃক প্রবর্তিত এবং খোলাফায়ে রাশেদুন কর্তৃক অনুসৃত সুদবিহীন যে অর্ত ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে প্রায় সমগ্র বিশ্বে পরিচালিত হয়ে আসছিল তাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হল। ইয়াহুদীরাই ছিল সুদের প্রবর্তক এবং সুদী প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র মালিক। যতদূর জানা যায় প্রাচীন গ্রীক সমাজে যখন ব্যাংক একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে তখন ব্যাংকে সুদ গ্রহণ ছিল নিষিদ্ধ। খ্রিষ্টানদের ‘ওল্ড টেস্টমেন্ট’ ধর্মগ্রন্থেও সুদ নিষিদ্ধ ছিল।

কিন্তু ইয়াহুদী জাতি এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ব্যাংকসমূহে সুদের প্রবর্তন করে। পরবর্তীতে খ্রিষ্টানরাও তাদের অনুসরণ করে এবং উত্তরোত্তর মুসলমানরাও সুদী কারবার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। কালের বিবর্তনের সাথে সাথে মুসলমানদের মনমগজ ও চিন্তাধারার এমন পরিবর্তন ঘটে যে, ব্যাংকিং বলতে তারা কেবল সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যাংক ব্যবস্থাকেই বুঝে। ইসলামি ব্যাংকিং বললে তারা যেন কিছুই বুঝে না। ব্যাংকিং বলতে তারা সুদী ব্যাংকের নাম, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করে।



আমরা জানি, বর্তমান যুগে ব্যাংকের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। একে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কারণ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ কার্যাদি, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক লেনদেন, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অর্থ স্থানান্তর, আমদানী রাপ্তানী ইত্যাদি যাবতীয় অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী ব্যাংকের মাধ্যমেই সম্পন্ন হচ্ছে। ব্যাংক ব্যতীত এ সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিরাপদ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এদিক থেকে ব্যাংক একটি কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সুদ প্রথার কারণে সমগ্র ব্যবস্থাই অপবিত্র এবং মানবজাতির জন্যে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক থেকে যদি সুদের মত এ ভয়াবহ পাপ ও অভিশাপটিকে দূর করা যায় তাহলেই ব্যাংক সত্যিকার অর্থে একটি কল্যাণকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে এবং সবার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে।

ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ

বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম মনীষীগণ শুরু থেকেই গোটা ব্যাংক ব্যবস্থাকে ইসলামিকরণের জন্যে ব্যাংক থেকে সুদ প্ৰথা দূর করে এটিকে একটি প্রকৃত কল্যাণকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার এবং মুসলিম জাতিকে সুদের ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। তাঁরা কখনো নীরব থাকেননি। মুসলিম মনীষীগণ সর্বযুগেই ইসলামি নীতিমালাকে পুনঃ প্রবর্তনের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন।

সুদী ব্যাংক ব্যবস্থাকে ইসলামিকরণ করার বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামি চিন্তাবিদ, ইসলামি আইনবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, সাহিত্যিক, শিক্ষক, শিল্পপতি, ব্যাবসায়ী, গবেষক এবং দার্শনিকগণ বিভিন্ন সভা- সমিতি, কনফারেন্স, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য পেশ করতে থাকেন। তাঁদের এ বক্তব্য এবং লিখনীর ভাষা কখনো ছিল বলিষ্ঠ আবার কখনো ছিল মন্থর। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বিশ্বের মুসলিম মনীষীগণ সুদ বিহীন ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বপক্ষে ব্যাপক গবেষণা, লেখালেখি এবং জোরালো বক্তব্য পেশ করতে থাকেন। তাঁদের এ বক্তব্য ক্রমান্বয়ে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ নেয় এবং ষাটের দশক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুদবিহীন ইসলামি ব্যাংক, বীমা, ইন্সুরেন্স কোম্পানী এবং সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।


শিশুর আধুনিক, সুন্দর ও অর্থবহ নাম


১৯৬৩ সালে মিসরে সর্বপ্রথম সুদ বিহীন ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ডঃ আহম্মদ আল নাজ্জার স্বউদ্যোগে মিসরীয় বদ্বীপ শহর মিটগামারে ‘মিটগামার ব্যাংক’ নামে একটি সেভিংস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল আধুনিক বিশ্বের প্রথম সুদবিহীন ইসলামি ব্যাংক। স্বল্প সময়ের মধ্যে এ ব্যাংক বিপুল সাফল্য অর্জন করে। ১৯৬৩-৬৭ সালের মধ্যে মিসরের ৯টি প্রদেশে মোট ৯টি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু মিসরের তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সরকার ১৯৬৭ সালে রাজনৈতিক কারণে সকল ইসলামি ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। অতপর মিসর সরকার জনগণের দাবী ও আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে এবং রাজনৈতিক সমর্থন লাভের জন্যে ১৯৭২ সালে ‘নাসের সোশ্যাল ব্যাংক’ নামে অপর একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৭০ সালে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (OIC) গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-এর পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামি অর্থ সংস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে প্রথম বারের মত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের অপর সম্মেলনে ‘আইডিবি’ (ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক) চার্টার গৃহীত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালে সৌদী আরবে ‘ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক’ (আইডিবি) প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ঐ বছরই সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘দুবাই ইসলামি ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করে। অতপর ক্রমান্বয়ে, কুয়েত, সেনেগাল, বাহরাইন, পাকিস্তান, ইরান, সুইজারল্যান্ড, জাম্মান, জর্দান, বাংলাদেশ প্রবৃতি দেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইরান ও পাকিস্তানের গোটা ব্যাংক ব্যবস্থাকে ইসলামিকরণ করা হয়।

উপসংহার

বর্তমান বিশ্বে ইসলামি ব্যাংক কেবলমাত্র মুসলিম দেশসমূহেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, জার্মানী এর মত অমুসলিম দেশেও ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৪২টি দেশে ১৫৫ টিরও অধিক সুদ বিহীন ইসলামি ব্যঅংক ও অন্যান্য অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান ইসলামি শরীআর নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে এবং মরীআর নীতিমালাকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করার প্রচেষ্টা অব্যাহক রেখেছে। গোটা বিশ্বের মুসলমানগণ তাঁদের ব্যাংকিং এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম ইসলামি শরীআর ভিত্তিতে পরিচালনা করবে এবং সুদের ভয়াবহ অভিশাপ, শোষণ ও জুলম থেকে মুক্তি লাভ করবে।



• IST-601 : Study of al Tafsir (Tafsir Ibn Kathir : Surah-al-Maieda verse 1 to 77) • IST-602 : Study of al-Fiqh • IST-603 : Philosophy of religion and Comparative Religion • IST-604 : History of Sufism in Bangladesh and some prominent • IST-605 : Trade, Commerce and Business Studies in Islam

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,606FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles