▶ প্রশ্ন: ইহুদি ও নাসারা কাকে বলে এবং কেন আল্লাহর পুত্র মনে করে? ▶ বিষয়: IST-601 : Study of Al Tafsir ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (ফাইনাল)
ইহুদি ও নাসারা কাকে বলে এবং কেন আল্লাহর পুত্র মনে করে?
ভূমিকা
কুরআনে ইহুদি নাসারাদের কথা এসেছে। অনেকেই জানে না ইয়াহুদি নাসারাদের পরিচয়। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকের ধর্ম গ্রন্থেই শেষ নবি ও রাসুল আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন। উল্লেখিত জাতির যারাই শেষ রাসুলকে পাবে, তারা অবশ্যই তাঁর প্রচারিত জীবন ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার এবং তাঁকে মেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইহুদি ও নাসারাদের পরিচয়
উল্লেখিত জাতিসমূহের পরিচয় তুলে ধরা হলো-
- ইহুদি: হযরত মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরাই (বনি ইসরাইল) ইহুদি। ইহুদি শব্দের অর্থ হচ্ছে বন্ধুত্ব। যেহেতু মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা অপরাধের কারণে আল্লাহর নিকট তাওবা করে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে তাই তাদেরকে ইহুদি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কেউ কেউ বলেন, ইহুদের সন্তান ছিল বলে তাদেরকে ইহুদি বলা হয়। হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বড় ছেলের নাম ছিল ইহুদ। তারা তাওরাত পড়ার সময় নড়াচড়া করত বিধায় তাদেরক ইয়াহুদ বা হরকতকারী বলা হয় বলেও একটি মত পাওয়া যায়।
Click to see Ad
- নাসারা: বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের যারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে পেয়েছে তাঁদের প্রতি নির্দেশ ছিল ঈসা আলাইহিস সালামের শরীয়তকে মেনে নেয়া। তাঁকে বিশ্বাস করা এবং মেনে নেয়া ছিল ওয়াজিব। তাদের নাম হয় নাসারা তথা সাহায্যকারী। কেননা তারা একে অপরকে সাহায্য করেছিল। তাদেরকে আনসারও বলা হয়। কুরআনে ঈসা আলাইহিস সালামের কথা উদ্ধৃতি করে বলা হয়েছে, আল্লাহর দ্বীনে আমার সাহায্যকারী কে আছে? হাওয়ারীগণ বলে, আমরা আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী। কেউ কেউ বলেন, এসব লোক যেখানে অবতরণ করে ঐ জায়গার নাম নাসেরাহ বিধায় তাদেরকে নাসারা বলা হয়েছে।
ঈসা মসীহকে কেন আল্লাহর পুত্র বলা হয়?
এক সময়ে ইসলামের অনুসারীদের এক অংশের মধ্যে বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল যে, আল্লাহ্ তায়ালার দেহ বা হাত পা ছিল। তারা বিশ্বাস করত, আল্লাহ্ ছিল হাত, মুখ ইত্যাদি দৈহিক অঙ্গপ্রতঙ্গ ধারণকারী। কোরআন ও হাদিসের অংশ বিশেষের আক্ষরিক বর্ণনার ফলে, এই বিশ্বাসকে প্রমাণ করে তুলেছেন। যেমন ইসলামী দর্শনে লেখা আছে, “এদের (যাহারিয়া ও মুশাব্বিহা) মতে, আল্লাহ্ শরীরী, আপন আসনে আসীন। তাঁর হাত মুখ আছে। তিনি রসুল করীমের পবিত্র স্কন্ধে হাত রাখেন এবং রসুল করীমও তার হাতের স্নিগ্ধতা অনুভব করেন।”
পরবর্তীতে অবশ্যই ইসলামী চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, আক্ষরিক দৃষ্টিকোণে ঐ সব অংশের ব্যাখ্যা দেয়া বা গ্রহণ করা যাবে না। ঐ সব অংশকে সব সময় অলংকারিক রূপক অর্থে গণ্য করতে হবে।
রূপক ব্যাখ্যা
এক সময়ে এটা বুঝতে পারা গেল যে, ধর্মগ্রন্থের কোন কোন অংশকে রূপকভাব অবশ্যই গণ্য করতে হবে। এর পরে কীভাবে অন্যান্য কঠিন অংশগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যেমন নিম্নলিখিত হাদিসগুলো আক্ষরিক অর্থে বুঝতে খুবই কষ্টকর ছিল। রসুল করিম বলেছিলেন, “কালো পাথর (হাজরে আসওয়াদ) হলো আল্লাহর হাত।”, “মুসলমানের অন্তর আল্লাহর আঙ্গুলসমূহের মধ্যে অবস্থিত।’, “আমি ইয়ামেন থেকে আল্লাহ্ খোশবু পাচ্ছি”।
এখানে অপ্রত্যক্ষ এবং রূপক ব্যাখ্যা গ্রহণ করায় সমস্ত অসুবিধাগুলো দূরীভূত হয়েছে এবং প্রকৃত অর্থ স্পষ্টরূপে ভেসে উঠেছে। আগেকার ভুল বুঝাবুঝি উক্ত প্রকৃতির ধর্মীয় ভুল বুঝাবুঝি শুধুমাত্র কোরআন এবং হাদিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তৌরাত, জবুর এবং ইঞ্জিলের মধ্যেও এমন বহু ব্যাখ্যার জটিলতা আছে। যেমন, নবিদের উপাধিগুলো নিয়ে সহজেই ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করা সম্ভব।
Click to see Ad
ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ
উদাহরণস্বরূপ আমরা হযরত ইবরাহিম (আঃ) সম্বন্ধে একটু চিন্তা করতে পারি। তাঁকে উপাধিটা দেয়া হয়েছিল ‘খলিলুল্লাহ্” বা ‘আল্লাহর দোস্ত’। এখানে যারা আক্ষরিক অর্থ উপাধিটা বুঝতে চায়, তাদের অনেক জটিলতা ও সমস্যা রয়েছে। কারণ মানুষের দোস্ত থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহর দোস্ত থাকা কেমন করে সম্ভব? একজন মানুষ তার বন্ধুর সাথে উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া করে, এবং তার কাছে পরামর্শ পায়। জগতের দিক দিয়ে ‘দোস্ত’ শব্দটা সেই অর্থে বুঝায়। কিন্তু সে অর্থে কি আল্লাহর দোস্ত কোন দিন থাকতে পারে? কখনও না। বরং এর নিশ্চিত অর্থ হলো রূপক।
এটা স্পষ্ট যে, সর্বশক্তিমান ও নিরাকার আল্লাহ তায়ালার সাথে হযরত ইবরাহিম (আঃ) উঠা-বসা ও খাওয়া-দাওয়া করেননি বা তার কাছে পরামর্শের জন্য যাননি। আর তা করা সম্ভবও ছিল না। বরং আল্লাহর কাছে ইবরাহিম নবী তাঁর জীবনকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করলেন। আল্লাহ্ হুকুমে তিনি তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ী ও আত্মীয়স্বজন সবাইকে ত্যাগ করে অন্য এক দেশে চলে গেলেন। সব সময় তিনি আল্লাহর অনুগত ছিলেন এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য চেষ্টাই তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল। সেইজন্য এখানে ‘খলিলুল্লাহ্’-এর স্পষ্ট অর্থ হলো আক্ষরিক নয় বরং রূপক। আল্লাহ্তা’আলার সাথে ইবরাহিম নবীর ঘনিষ্ঠ রূহানিক বা আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল বলে তাঁকে বলা হয় ‘খলিলুল্লাহ্’। রূপক অর্থে তিনি আল্লাহ্র দোস্ত ছিলেন, জাগতিক অর্থে নয়।
আল্লাহর পুত্র
তারপর কিতাবের আর একটি উপাধি আছে যার সঠিক ব্যাখ্যা করার পিছনে অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সে উপাধি হলো ‘আল্লাহর পুত্র’ এবং সেটাকে নিয়ে নিঃসন্দেহেই ব্যাপক ও কঠিন ভুল বুঝাবুঝি অবকাশ আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ‘আল্লাহর পুত্র’ শব্দটা সমগ্র ইহুদী জাতিকে জড়িত করে, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ঈসা মসীকে জড়িত করে।
আক্ষরিক অর্থ নয় বরং রূপক যারা এই অভিধানিক শব্দটার আপত্তি তুলেছে তারা এর আক্ষরিক অর্থকে গ্রহণ করেছে এবং এর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করায় তাদেরকে অনেক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করলে, এ মেনে নিতে হবে যে, আল্লাহর একজন স্ত্রী ছিল এবং আল্লাহ্ দৈহিক প্রক্রিয়ায় সন্তানাদির জন্ম দিয়েছিলেন (নাউজুবিল্লাহ্)। কিন্তু ইঞ্জিলের নিজস্ব শিক্ষাই পরিষ্কার রূপে এমন একটি মারাত্মক ভুলের বিরোধিতা করেছে। ঈসা মসীহ্ নিজেই ইঞ্জিল শরীফের সাক্ষ্য দিয়েছেন যে আল্লাহ্ এক এবং তাঁর কোন শরিক নেই। উনি মানুষকে হেদায়েত করলেন এভাবে,
“আমাদের মাবুদ আল্লাহ এক। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ, সমস্ত মন এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহকে মহব্বত করবে।”
ইঞ্জিল কিতাব আরো পরিষ্কার শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর কোন দেহ নেই। আল্লাহ্ প্রাকৃতিক নিয়মে বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান জন্ম দান করেন, এই ধারণা যেমন অসম্ভব তেমনি জঘন্য ও কুৎসিকতাপূর্ণ। অতএব যারা ‘আল্লাহর পুত্র’ এর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করবে; তারা তাদের মতো একই সমস্যায় পতিত হবে যারা কোরআন ও হাদিসের উপরোক্ত অংশের ব্যাখ্যার আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে ‘আল্লাহর পুত্র’ শব্দটাকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করতে হবে বলে ইঞ্জিলের প্রকৃত অনুসারীরা সবাই এক বাক্যে মেনে নিয়েছেন। তাই এখন শব্দটার রূপক ভাবার্থ উপলব্ধি করার জন্য আসুন আমরা আরো কতগুলো বিষয়ের দিকে নজর দেই।
ঈসা কালিমুল্লাহ
কোরআন শরীফ ও ইঞ্জিল শরীফে ঈসা মসীহের আর একটি উপাধি ‘কালেমাতুল্লাহ্’ বা আল্লাহর বাণী লিপিবদ্ধ আছে। এ ক্ষেত্রেও উপাধিটাকে পরিষ্কারভাবে আক্ষরিক অর্থে নেয়া যাবে না। তিনি একটি আক্ষরিক কালাম, আওয়াজ, অক্ষর বা শব্দ নন। বরং এখানে ‘কালাম’ শব্দটাকে রূপক অর্থে গ্রহণ করতে হবে। রূপক অর্থে ‘কালাম’ হচ্ছে একটি মাধ্যম একজনের চিন্তা এবং ইচ্ছাকে অপরের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্র বা বাহক। ঠিক সেভাবে ঈসা মসীহ্ ছিলেন আল্লাহ্ এবং মানব জাতির সাথে আল্লাহ তায়ালার যোগসূত্র। ঈসা মসীহের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর চিন্তাধারা এবং আকাঙ্খাকে মানুষের নিকট ব্যক্ত করতে পারতেন। এখন এটা সুস্পষ্ট যে, ‘খলিলুল্লাহ্’ উপাধিটার মতো ‘কালিমাতুল্লাহ্’ উপাধিটাকেও রূপক অর্থে বুঝতে ও গ্রহণ করতে হবে। তাই এটা আশ্চর্যজনক কিছু নয় যে, কিতাবের আর একটা উপাধি ‘আল্লাহর পুত্র’ রূপক অর্থে থাকবে। এই ধরণের রূপক অর্থ শুধু ধর্মীয় বষয়ে নয়, বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। যেমন এটা সহজভাবে প্রমাণ করা যায় যে, আমরা ঠিক যেভাবে ব্যাখ্যা দিতেছি ‘পুত্র’ ও ‘পিতা’ শব্দগুলো প্রায়ই সেইভাবে, রূপক অর্থে, ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
উপসংহার
সাধারণভাবে বলা হয় যে, অমুক ব্যক্তি একটা জাতির পিতা। কিন্তু কেউই এতো বোকা নয় যে সে চিন্তা করবে যে ঐ নামীয় ব্যক্তিটি ঐ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্মদাতা পিতা। কিন্তু তা নয়, প্রকৃতপক্ষে এটা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেহেতু জাতীয় স্বাধীনতা এবং অগ্রগতিতে ওই ব্যক্তি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন, তাই তাঁকে সম্মান ও স্নেহসূচক ‘জাতির পিতা’ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়। এ শুধু একটি উপাধি। ঐ ব্যক্তি যে তার দেশের সাথে নিবিড় সম্পর্ক পোষণ করে, এই আখ্যার দ্বারা তাই প্রতিপন্ন হয়। পিতার এই ধরনের রূপক ব্যবহার শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহ্র প্রতি তা প্রয়োগ হতে দেখা যায়। আল্লাহ্ শেষ পর্যন্ত সব কিছুর স্রষ্টা, সরবরাহকারী ও পালনকারী।
• IST-601 : Study of al Tafsir (Tafsir Ibn Kathir : Surah-al-Maieda verse 1 to 77) • IST-602 : Study of al-Fiqh • IST-603 : Philosophy of religion and Comparative Religion • IST-604 : History of Sufism in Bangladesh and some prominent • IST-605 : Trade, Commerce and Business Studies in Islam •