Friday, November 22, 2024

প্রযুক্তির উন্নয়নে মুসলমানদের অবদান লিখুন৷

প্রশ্ন: প্রযুক্তির উন্নয়নে মুসলমানদের অবদান লিখুন৷ বিষয়: IST-512 : Muslim Contribution to Science and Technology কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)



ভূমিকা

মানব জাতির সূচনালগ্ন থেকেই মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব থাকার কারণে লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটে এবং পড়ালেখার চর্চাসহ গ্রন্থরাজি রচনার জন্য লিখন উপকরণ আবিষ্কারের এক মহাবিপ্লবের সূচনা ঘটে। মুসলিম জাহানের বাগদাদে ৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম কাগজের কারখানা স্থাপিত হয়। বাগদাদের পর এ শিল্প কৌশলটি সিসিলি, ইউরোপের স্পেন, ইতালি ও ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর বিজ্ঞানের সকল শাখায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান রয়েছে অনবদ্য।

প্রযুক্তির উন্নয়নে মুসলমানদের অবদান লিখুন৷

প্রযুক্তি কাকে বলে?

প্রযুক্তি (Technology) বলতে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিককে বোঝায়। অক্সফোর্ড ডিকশনারি- তে প্রযুক্তি- র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, The application of scientific knowledge for practical purposes. প্রযুক্তি বলতে কিছু প্রায়োগিক কৌশলকে বোঝায়, যার সাহায্যে মানুষ প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপাদানকে নিজের প্রয়াজেনে সহজে ও দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পারে। যেমন- আগে মানুষ যোগাযোগের জন্য উচু পাহাড়, সৃষ্ট প্রতিধ্বনি। আগুনের ধোঁয়া প্রভৃতি ব্যবহার করত। কিন্তু যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষ এখন কম্পিউটার, রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল, স্যাটেলাইট প্রভৃতি ব্যবহার করছে।

প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্র

প্রযুক্তির আরও নানাবিধ ক্ষেত্র রয়েছে। মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি দিকের সাথেই প্রযুক্তি জড়িত। প্রযুক্তির প্রতিটির বিষয়ের উদ্ভাবন ও উন্নয়ন মানুষের জীবনকে করেছে আরো সহজতর ও গতিশীল। প্রযুক্তির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র হলো- জৈব প্রযুক্তি, মহাকাশ প্রযুক্তি, যোগাযোগ প্রযুক্তি, চিকিৎসা প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি, নৌ প্রযুক্তি, ন্যানো প্রযুক্তি, রাসায়নিক প্রযুক্তি, কৃষি প্রযুক্তি, নির্মাণ প্রযুক্তি প্রভৃতি।

প্রযুক্তির ধারা

প্রযুক্তির ধারা অত্যন্ত গতিশীল ও নিত্য পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে মানবসভ্যতার যেমন বিবর্তন ঘটেছে তেমনি মানুষ নিত্যদিনের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে প্রযুক্তিরও উন্নয়ন করেছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে দৈনন্দিন কাজকে করেছে সহজ থেকে সহজতর। মহান আল্লাহ তায়ালা ১৮ হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। বাকি সব মাখলুকাত মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্বের সব সৃষ্টিই সরাসরি মানুষের প্রয়োজন পূরণে কাজে লাগানো সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযাজন। এজন্যই মানুষ প্রযুক্তির সাহায্য নেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিভিন্নভাবে মানুষকে প্রযুক্তির প্রতি উৎসাহিত করেছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টির পরেই আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের বিভিন্ন বিষয়ের নাম ও সেগুলোর ব্যবহার শিখিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন হলো বিশ্বের সব জ্ঞানের উৎস। এমন কোনো বিষয় নেই যার ইঙ্গিত কুরআনে নেই।

প্রযুক্তি সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত

প্রযুক্তির উন্নয়নের লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্নভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। খাদ্য সংরক্ষণে প্রযুক্তির উৎকর্ষের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে সুরা ইউসুফের ৪৭-৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

قَالَ تَزْرَعُوْنَ سَبْعَ سِنِیْنَ دَاَبًا ۚ فَمَا حَصَدْتُّمْ فَذَرُوْهُ فِیْ سُنْۢبُلِهٖۤ اِلَّا قَلِیْلًا مِّمَّا تَاْكُلُوْنَ ﴿۴۷﴾


অর্থ: ইউসুফ বলল, তোমরা একাধারে সাত বছর শস্য উৎপন্ন করবে। এ সময়ের ভেতর তোমরা যে শস্য সংগ্রহ করবে তা তার শীষসহ রেখে দিও, অবশ্য যে সামান্য পরিমাণ তোমাদের খাওয়ার কাজে লাগবে (তার কথা আলাদা)।

ثُمَّ یَاْتِیْ مِنْۢ بَعْدِ ذٰلِکَ سَبْعٌ شِدَادٌ یَّاْكُلْنَ مَا قَدَّمْتُمْ لَهُنَّ اِلَّا قَلِیْلًا مِّمَّا تُحْصِنُوْنَ ﴿۴۸﴾


অর্থ: এরপর তোমাদের সামনে আসবে এমন সাতটি বছর, যা অত্যন্ত কঠিন হবে। তোমরা এই সাত বছরের জন্য যা সঞ্চয় করে রাখবে, তা খেতে থাকবে, অবশ্য যে সামান্য পরিমাণ তোমরা সংরক্ষণ করবে (কেবল তাই অবশিষ্ট থাকবে)।

প্রযুক্তিতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান

কুরআন ও হাদিসের ইঙ্গিতপূর্ণ বিভিন্ন বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে মুসলিম বিজ্ঞানী প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় নিজ নিজ অবদান রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদের অবদান নিচে তুলে ধরা হলো-

  • কাগজ আবিষ্কারের আগে সাহাবিগণ ওহি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করতেন গাছের পাতা, বাকল, পাথর প্রভৃতি। ৭০৪ খ্রি, সমরখন্দ মুসলমানদের আয়ত্তে আসলে চীনের কাগজ শিল্পে প্রযুক্তির প্রাথমিক স্তরের ব্যাপক উন্নয়ন করেন মুসলমানগণ।
  • মুসলিম বিজ্ঞানী আল জাজারী (১১৩৬-১২০৬ খ্রি.) ঘূর্ণায়মান হাতল আবিষ্কারের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের যন্ত্র তৈরি করেন, যা হাইড্রো পাওয়ার প্রযুক্তিতে চলত। মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই তার তৈরি এ যন্ত্রের ব্যবহার হতো। তিনি পানিচালিত জলঘড়িও তৈরি করেছিলেন।
  • স্পেনের বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী আব্বাস ইবনে ফারনাস (৮১০-৮৭৫ খ্রি.) সর্বপ্রথম সূক্ষ ক্রোনোমিটার ও চশমা আবিষ্কার করেন।
  • মিশরের মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে ইউনুস (৯৫০-৯৯৬) ঘড়িতে পেন্ডুলামের সফল ব্যবহার করেন।
  • ইবনে সিনা (চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক) তার মায়ার আল আকল এ কপিকল ভারোক্তোলোক, স্ক্রু, গোঁজ, চরকি এর ব্যবহার সম্পর্কে প্রথম আলোকপাত করেন।
  • মহাবিজ্ঞানী যাকারিয়া আল রাযি নবম শতাব্দীতে কেরোসিন উৎপাদন পদ্ধতি আবিষ্কার করে তৈরি করেন নাফাতাহ্ বা কেরোসিনের বাতি। তিনি কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরির পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেন।
  • চিকিৎসা প্রযুক্তিতে ইবনে সিনাকেই জনকের আসন দেওয়া হয়। আল রাযি, হাসান ইবনে হায়সাম প্রমুখ মনীষীগণ শরীরের বাড়তি গোশত কাটা, হাড় কাটা, দাঁত তোলা, ক্ষত সেলাই করা প্রভৃতি কৌশলী যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রযুক্তিতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিলেন।
  • হাসান ইবনে হায়সামের তৈরি করা ‘ম্যাগনিফাইং গ্লাস’ গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল । এটি বর্তমানেও গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
  • মুসলমানদের মধ্যে ইব্রাহীম আল ফাজারী হলেন প্রথম প্রযুক্তিবিদ, যিনি সূর্য ও নক্ষত্রের উচ্চতা নির্ণয়ের সহায়ক যন্ত্র অ্যাস্ট্রলেইব (Astrd abe) নির্মাণ করেন। এছাড়াও একাদশ শতাব্দীর দিকে সূর্যের উচ্চতা নির্ণয়ের নিমিত্তে মুসলিম বিজ্ঞানী আবু মোহাম্মদ আল খুজাব্দী তৈরি করেন ‘আস সুদ আল ফাখরী এবং ‘আল আলা-আস সামিল’ নামে দুটি যন্ত্র। দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে জনাব নাসিরউদ্দিন তুসী একটি ‘মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসে “ইকুয়েটেরিয়াম’ নামে গ্রহসমূহের অবস্থান নির্ণয়ে সহায়ক একটি যন্ত্র তৈরি করেন মুসলিম জ্যোতির্বিদ জামশিদ গিয়াসউদ্দিন আল কামী।
  • মুসলমান পরমাণু বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভারতের ড. এ. পি. জে আব্দুল কালাম ও পাকিস্তানের ড. আব্দুল কাদির খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

এছাড়াও পোশাক প্রযুক্তির উন্নয়ন মুসলমানদের হাত ধরেই হয়েছিল। কুফাতে তৈরি মেয়েদের ওড়না কুফিয়া বাগদাদের ‘বাদাচিন’, মাওসিলের, ‘মসলিন’ মিসরের ফুসতাতের কাপড় ‘ফাসতিযান’ প্রভৃতি কাপড় তৈরির উন্নত প্রযুক্তির স্বাক্ষর বহন করে। বর্তমানেও ইরানের কার্পেট ও সিরামিক শিল্প বিখ্যাত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ।

উপসংহার

উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, মানুষ তার প্রয়োজন পূরণে প্রযুক্তির উন্নয়নে সর্বদাই সচেষ্ট ছিল। আর এ সব উন্নয়নে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। মুসলমানগণই ছিলেন এই উন্নয়নের পথ প্রদর্শক। বর্তমানের এই আধুনিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, যার শুরুটা হয়েছিল মুসলমানদের হাতেই।



সম্ভাব্য প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ (এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ)

• IST-507 : Study of Al-Hadith (Al-Mishkat Al-Masabih: Al-Iman, AlILM and Al-Salat (Selected Hadith) • IST-508 : Principles and History of Hadith literature • IST-509 : Muslim Personal Law and Law of Inheritance in Islam • IST-510 : Banking and Insurance in Islam • IST-511 : Study of Religions (Islam, Buddhism, Hinduism, Judaism, Christianity) • IST-512 : Muslim Contribution to science and technology

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,606FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles