▶ প্রশ্ন: ধর্ম কাকে বলে? মানব জীবনে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করুন। ▶ বিষয়: IST-511 : Study of Religions (Islam, Buddhism, Hinduism, Judaism, Christianity) ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (১ম পর্ব)
ভূমিকা
মানুষ জন্ম গ্রহনের পর থেকে পৃথিবীর আলো-বাতাসসহ সব ধরণের সুবিধা ভোগ করে বড় হতে থাকে। সময়ে সাথে সাথে এই তার কর্মকান্ড, চাহিদা ও পৃথিবীতে বিচরণ করার পরিধি বাড়তে থাকে। পৃথিবীতে মানুষের জীবন যাপনের জন্য অনেক নিয়মকানুনের প্রয়োজন হয়। আর মানুষের জীবন পরিচালনার এসব নিয়ম কানুন আদিভাবে ধর্ম থেকেই আসে। তাই পৃথিবীর মানুষের জীবন যাপন সুন্দর ও সহজ করার জন্য ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
ধর্মের সংজ্ঞা
ধর্ম হলো নির্দিষ্ট আচরণ ও অনুশীলন, নৈতিকতা, বিশ্বাস, বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, গ্রন্থ, পবিত্র স্থান, ভবিষ্যদ্বাণী, ধর্মে নীতিশাস্ত্র বা সংস্থার একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, যা মানবতাকে অতিপ্রাকৃত, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিকতা উপাদানগুলোর সাথে সম্পর্কিত করে। সংস্কৃত ধৃ হতে ধর্ম শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ ধারণ। একজন ব্যক্তি তার জীবনে যত প্রকার বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে তা-ই ধর্ম। ব্যক্তির বিশ্বাস, পরম্পরাগত শিক্ষা, আচার ব্যবহার ইত্যাদি সবই ধর্ম। যেমন আগুনের ধর্ম দহন করা, পানির ধর্ম শীতলতা আনয়ন করা, পশুর ধর্ম পশুত্ব, তেমনিভাবে মানুষের ধর্ম হলো মনুষ্যত্ব।
মানবজীবনে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
একজন ব্যক্তি বা মানুষের সমগ্র জীবন ব্যাপী ধর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানবজীবনে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
- মানসিক শান্তি (Mental Peace): মানসিক শান্তি ব্যতীত কোন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তার জীবনের কোন মূল্য অনুধাবন করতে পারে না। প্রচুর ধন-সম্পদের মাঝেও যদি কারো মানসিক শান্তি না থাকে তাহলে তার জীবন অর্থহীন হয়ে যায়। মানুষের মানসিক প্রশান্তি লাভে ধর্ম বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একমাত্র ধর্ম ব্যতীত পৃথিবীতে আর কোন নিয়ামত নেই যা ব্যক্তির মাঝে মানসিক শান্তি আনতে পারে। মুসলমানরা যখন মসজিদে অবস্থান করে, তখন তারা একটি বিশেষ শান্তি অনুভব করে। মসজিদকে সব সময় একটি শীতলতম পবিত্র স্থান মনে হয়। ঠিক তেমনি অন্যান্য ধর্মের লোকজন তাদের উপাসনালয়ে গিয়ে শান্তি অনুভব করে।
- পারস্পরিক ঐক্য সংরক্ষণ (Act of establishing Unity): মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টিতে ধর্ম ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে একটি গভীর ঐক্য লক্ষ করা যায়। যদি কোনো ধর্মের লোক অন্য কোনো ধর্মের লোকের কাছে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার ধর্মের লোকজন একত্র হয়ে তাকে সাহায্য করে। এছাড়াও মানুষের জাগতিক জীবনকে সহজ ও সুন্দর করার জন্য ঐক্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নিয়ামত। যা নিশ্চিত করার জন্য ধর্মের ভূমিকা অনন্য। শান্তির ধর্ম ইসলামে বলা আছে- এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। কাজেই সে তার উপর যুলুম করবে না, তাকে লজ্জিত করবে না এবং তাকে হীন মনে করবে না। কোন ব্যক্তির মন্দ কাজ করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে নিজের কোন মুসলমান ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। বস্ত্ততঃ একজন মুসলমানের সব কিছুই অপর মুসলমানের জন্য হারাম। তার জান, মাল ও ইজ্জত।
- জীবনের নিরাপত্তা বিধান (Safeguard of Life): পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে তার নিজের জীবন সবচেয়ে মূল্যবান। ধর্ম মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মেই অন্যায় হত্যাকাণ্ডকে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হত্যাকারীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান কার্যকর করার রীতিও বেশির ভাগ ধর্মে বর্ণিত হয়েছে। অন্যায় হত্যাকান্ডকে নিরুৎসাহিত করে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা ও সৌহার্দ্য রক্ষা কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে ধর্ম।
- সম্পদের নিরাপত্তা বিধান (Safeguard of Wealth): জীবনের পরেই মানুষের অত্যন্ত প্রিয় বস্তু হলো তার সহায়-সম্পদ তথা ধন-সম্পদ। ধর্ম মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে যথাযথ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, অর্থ আত্মসাৎ, লুণ্ঠন ও অবৈধ উপার্জন অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এসব কাজকর্মের জন্য শাস্তির বিধান আছে। অন্যের অর্থ-সম্পদ অবৈধভাবে দখল বা আত্মসাৎ করাকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে।
- সামাজিক নিয়ন্ত্রণ (Social Control): সমাজ পরিচালনার নানা বিষয়ে ধর্ম বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ধর্মের সঠিক ব্যবহারই সমাজকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সমাজে শান্তি বিনষ্ট হলে মানুষের জীবন বিষিয়ে উঠে। তাই মানুষের ব্যক্তি জীবনকে শান্তিময় করার জন্য সামাজিক শান্তি আনয়নের ধর্মের ভূমিকা অপরিসীম। ইসলাম ধর্মে সম্পদশালীদের তার অসহায় ও গরিব নিকট আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদের আর্থিক সহযোগিতা করার বিধান রয়েছে। যার মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও সৌহার্দ্য আনয়ন করার সম্ভব খুব সহজেই।
- সম্মানের নিরাপত্তা বিধান (Safeguard of Prestige): ধর্ম মানুষের সম্মান ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান করে। কারণ মান-সম্ভ্রম মানুষের জীবন ও সম্পদের চেয়েও বেশি প্রিয় হিসেবে প্রতীয়মান। মানুষ তার মান-সম্মান রক্ষার জন্য অকাতরে সম্পদ ব্যয় করে, জীবন উৎসর্গ করে। প্রতিটি ধর্মে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া, অহংকার করা, মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, ছোট করা বা অসম্মান করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এগুলোর জন্য শাস্তিরও বিধান রাখা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা, মিথ্যা দোষারোপ, চোগলখুরি, কু-ধারণা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, কারো সম্মানে আঘাত লাগে—এমন কথা বলা বা কাজ করা ইত্যাদিকে সব ধর্মে পরিহার করতে বলা হয়েছে।
- ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম (Religion in Personal Life): ব্যক্তিগত জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে ধর্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম মানুষকে সৎ, কর্মঠ, দায়িত্বশীল, সহানুভূতিশীল ও পরস্পরকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। ব্যক্তির স্বাস্থ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা, সৌন্দর্য, আহার- বিহার, চিত্তবিনোদন, শিক্ষা, বিবেক-বুদ্ধি, অল্পে তুষ্টি, চারিত্রিক স্বচ্ছতা, কর্মোদ্যম, ধীরস্থিরতা, বিচক্ষণতা, বিনয় নম্রতা, ভদ্রতা, মহানুভবতা, সততা, নৈতিকতা, পরার্থপরতা, ভালো কাজ, অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রভৃতি বিষয়ে সকল ধর্মেই শিক্ষা দেওয়া হয়।
- পারিবারিক জীবনে ধর্ম (Religion in Family Life): পরিবার সমাজের একটি ক্ষুদ্রতম আদিম সংগঠন। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে পরিবারব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বিবাহবন্ধন না থাকলে তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশা, অবাধ যৌনাচার, লিভ টুগেদার, সমকামিতা, ব্যভিচার, ধর্ষণ, বিবাহের নামে অনেক স্ত্রী গ্রহণ প্রভৃতির দ্বারা মানবজাতি পাপপঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয়ে যেতো। তাই বিবাহ একটি সুষ্ঠু পারিবারিক জীবন উপহার দেয়, যেখানে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন মিলে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। বিশ্বের সব ধর্ম পরিবারব্যবস্থাকে অটুট ও স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- সামাজিক জীবনে ধর্ম (Religion in Social Life): ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমাজ জীবনকে স্বাভাবিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ, মূল্যবোধ, নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক সংহতি রক্ষায় ধর্মের ভূমিকা অনন্য। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মানুষ একত্র হয়ে পারস্পরিক সহানুভূতি ও প্রীতির সঞ্চার করে। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মে মানবপ্রেম, মানবসেবা, পরার্থপরতা, দয়া, সহনশীলতা, সহযোগিতা, সদাচার প্রভৃতির শিক্ষা দেয়া হয়।
- রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্ম (Religion in State Life): পৃথিবীর প্রতিটি দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার পেছনে ধর্মের ভূমিকা অনন্য। যে দেশে যে ধর্মের লোক বেশি, সাধারণত সেই ধর্মের লোকজন ক্ষমতায় আরোহণ করে। ধর্মের কারণেই রাষ্ট্র সুসংহত ও স্থায়ী হয়। তাই যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত থাকেন, তাঁরা যেন স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্ববাদী না হন- ধর্ম থেকে সেই শিক্ষাই আমরা লাভ করি। ধর্ম রাষ্ট্রের প্রধানকে প্রজাপালক, প্রজাকল্যাণকর ও জনদরদি হতে নির্দেশ দেয়। জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি সব ধর্মের দিকনির্দেশনা রয়েছে।
- আন্তর্জাতিক জীবনে ধর্ম (Religion in International Life): বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে ধর্মের ভূমিকা অপরিসীম। পৃথিবীর সব মানুষ উৎসগত বিবেচনায় এক এবং অভিন্ন। তাদের মা-বাবা এক, সৃষ্টিকর্তা এক এবং তাদের জীবনের উদ্ভব, বিকাশ ও গন্তব্য এক। ধর্ম একান্তভাবে বিশ্বমানবকে পারস্পরিক অভিন্নতার এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।
উপসংহার
ধর্ম হলো মানুষের জীবনের আদি ও অপরিহার্য একটি বিষয়। পৃথিবীতে মানুষের জন্মের পূর্বেই ধর্মের আবির্ভাব। অর্থাৎ মানুষ পৃথিবীতে এসে কিভাবে তার জীবন সুচারু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করবে তার শিক্ষা, বর্ণনা ও দিক নির্দেশনা রয়েছে ধর্মে। তাই ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু মানুষের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে তথা পৃথিবীতে শান্তি আনয়নের জন্য ধর্মের বিকল্প কোন নিয়ামক পৃথিবীতে নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে যারা সঠিক ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন নিয়ামক দিয়ে শান্তি আনয়নের চেষ্টা করেছে তারা সকলেই ব্যর্থ হয়েছে।
সম্ভাব্য প্রশ্ন এবং উত্তরসমূহ (এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ)
• IST-507 : Study of Al-Hadith (Al-Mishkat Al-Masabih: Al-Iman, AlILM and Al-Salat (Selected Hadith) • IST-508 : Principles and History of Hadith literature • IST-509 : Muslim Personal Law and Law of Inheritance in Islam • IST-510 : Banking and Insurance in Islam • IST-511 : Study of Religions (Islam, Buddhism, Hinduism, Judaism, Christianity) • IST-512 : Muslim Contribution to science and technology •
[…] ধর্ম কাকে বলে? মানব জীবনে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করুন। ➔ উত্তর দেখুন […]