নেককার মহিলাদের কাহিনী • হযরত হাজেরা (আঃ)
মহান আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন মানুষের হেদায়াতের জন্য। তাদের একত্ববাদের দাওয়াত ও শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে প্রেরণ করেছিলেন। ঠিক তেমিনভাবে অনেক নেককার মহিলাও দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যেও আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য মুজিজা দিয়েছিলেন। যেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। এখানে তেমনিভাবে আল্লাহর কিছু প্রিয় নেককার মহিলাদের কাহিনী ও তাদের শিক্ষা তুলে ধরা হলো।
হযরত হাজেরা (আঃ)
বিবি হাজেরা হযরত ইব্রাহীম খালীলুল্লাহ্ এর সহধর্মিণী ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর মাতা। হযরত ইসমাঈল (আঃ) তখন দুগ্ধপোষ্য শিশু। এই সময় আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছা হলো- তিনি হযরত ইসমাঈলের সন্তান-সন্ততিগণের মাধ্যমে দিগন্ত বিস্তৃত মরুময় মক্কাভূমিকে বস্তিতে পরিণত করবেন। তাই তিনি প্রিয় নবী হযরত ইব্রাহীমকে হুকুম করলেন বিবি হাজেরা ও তাঁর দুধের সন্তানকে ভয়াবহ মরু ময়দানে ছেড়ে আসতে।
হযরত ইব্রাহীম খালীলুল্লাহ্ আল্লাহর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। ছেড়ে আসলেন বিবি হাজেরাকে তাঁর দুধের সন্তানসহ নির্জন মরু-ময়দানে। রেখে আসলেন তাঁদের জন্য এক মশক পানি ও এক থলি খোরমা। আসার সময় বিবি হাজেরা (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, ওহে খালীলুল্লাহ্! আমার প্রাণের স্বামী, আমাদেরকে একাকী কোথায় ছেড়ে যাচ্ছেন? উত্তরে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নিরুত্তর রইলেন। বিবি হাজেরা কাতর স্বরে গদ্গদ্ কণ্ঠে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, তবে এটা কি আল্লাহর আদেশ?
খালীলুল্লাহ্ বললেন, হাঁ! এবার সহাস্যে উৎফুল্ল হৃদয়ে বিবি হাজেরা হেসে উঠলেন, তবে আর কি চাই? করুণাময়ের আদেশ; তাই আর কোন চিন্তা নাই; তিনি নিশ্চয়ই নিখিল মানবের পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, সৃষ্টিকর্তা। এরপর বিবি হাজেরা সেখানে প্রশান্ত চিত্তে অবস্থান করতে লাগলেন। খোরমা খেয়ে, পানি পান করে দিনের পর দিন অতিবাহিত করতে লাগলেন। ছেলেকে স্তনের দুগ্ধ পান করাতে লাগলেন। অবশেষে এমন একদিন উপস্থিত হলো যখন খোরমা ও পানি সবই ফুরাইয়া গেল। স্তনও দুগ্ধহীন হয়ে পড়লো। উভয়ের ক্ষুধা ও পিপাসার চরমে পৌঁছিল। পিপাসার তাড়নায় মরুভূমির উত্তাপে দুধের শিশু ছট্ফট্ করতে লাগলো। মা ও ছেলের প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত হয়ে আসলো।
পানির সন্ধানে বিবি হাজেরা দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। ছাফা পাহাড়ে উঠে চতুর্দিকে পানি তালাশ করলেন। কোথাও পানির লেশমাত্র দেখতে পেলেন না। সেখান থেকে নেমে মারওয়া পাহাড় পানে দৌড়ে ছুটলেন। পাহাড়ের উপর উঠে চতুর্দিকে পানি তালাশ করলেন। কোথাও একবিন্দু পানির সন্ধান পেলেন না। উভয় পাহাড়ের মধ্যবর্তী এলাকা নিচু ছিল। যতক্ষণ সমভূমিতে চলতেন, তখন চাতক পাখীর ন্যায় অনিমেষ নেত্রে ছেলের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেন। কিন্তু নিম্নস্থানে অবতরণ করলে আর ছেলেকে দেখা যেতো না। তাই তিনি ঐ স্থানটুকু বেগে দৌড়ে অতিক্রম করতেন। এইভাবে বিবি হাজেরা দৌড়ে দৌড়ে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চড়ে কয়েকবার পানির সন্ধান করলেন। বর্তমানে উভয় পাহাড়ের মধ্যবর্তী নিম্নভূমি সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিবি হাজেরার এই দৌড়ান আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এত পছন্দনীয় হলো যে, তিনি হাজীদের জন্য উক্ত স্থানে সাতবার দৌড়ান এবাদতে পরিণত করে দিলেন।
অবশেষে বিবি হাজেরা মারওয়া পাহাড়ে চড়ে এক গায়েবী আওয়াজ শুনতে পেলেন। পুনরায় ঐ আওয়াজ অস্পষ্টভাবে শুনতে পেলেন কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। তিনি বললেন, আমি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, যদি কেউ এমন বিপদের সময় সাহায্য করতে চায়, তবে এগিয়ে আসতে পারে। তৎক্ষণাৎ বর্তমান যমযম কূয়ার জায়গায় ফেরেশ্তা দেখা গেল। ফেরেশ্তা তাঁর বাজু দ্বারা মাটিতে আঘাত করায় পানি উথালিয়া উঠিতে লাগলো। বিবি হাজেরা মাটির বাঁধে পানি আটকাইয়া ফেলিলেন। নিজে পানি পান করলেন, ছেলেকে পান করালেন, মশক ভরে পানি রাখিলেন। ফেরেশ্তা বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। এখানে খোদার ঘর ‘খানায়ে কা’বা’ রয়েছে। এই ছেলেই তাঁর পিতার সাথে মিলে এই ঘরের মেরামত করবেন। এই ভয়াবহ নির্জন মরু-ময়দান আবাদী জমিতে পরিণত হবে। দেখতে দেখতে সকলই বাস্তবায়িত থেকে লাগলো।
এক মরু কফেলা পানির সন্ধান পেয়ে সেখানে বসিত স্থাপন করলো। যথাসময়ে হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর শাদী মোবারক সুসম্পন্ন হলো। আল্লাহর আদেশ পেয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) সেখানে উপস্থিত হলেন। পিতা-পুত্রের সাক্ষাৎ হলো। উভয়ে মিলে খানায়ে কা’বা নির্মাণ করলেন। যমযমের পানি ঐ সময় বিস্তৃত হয়ে পড়ে। পরে তা কূয়ার আকার ধারণ করে। বিবি হাজেরার আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভরসা ছিল অপরিমেয়। তাই ‘মরুময় ময়দানে অবস্থান করা, আল্লাহর হুকুম জানতে পেরে তিনি একেবারে শান্ত ও নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ে- ছিলেন। অবশেষে এই ভরসার বদলে কত নেয়ামতই না জাহের হলো। তাঁর মামুলী দৌড়া-দৌড়িই হাজীদের জন্য ইবাদতে পরিণত হয়ে গেল। মকবুল বান্দার অতি সাধারণ কার্যগুলিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত হয়। এর শত শত নযীর ইতিহাসে বিদ্যমান। অতএব, সর্বদা সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ তা’আলার উপর নির্মল আস্থা ও ভরসা রাখা চাই।
নেককার মহিলাদের কাহিনী ও তাদের জীবনী
• হযরত হাওয়া (আঃ) • হযরত সারা (আঃ) • হযরত হাজেরা (আঃ) • হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বিবি • বাদশাহ্ নমরুদের কন্যা • আইয়ূব নবীর স্ত্রী বিবি রহিমা • হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর খালা • হযরত মূসা (আঃ)-এর মাতা • হযরত মূসা (আঃ)-এর বোন • হযরত মূসা (আঃ)-এর বিবি ছফুরা • হযরত বিবি আছিয়া • ফেরাউনের কন্যা ও বাঁদী • হযরত মূসার এক বৃদ্ধা লস্কর • হাইসূরের ভগ্নী • হযরত বিলকিস • বনি-ইসরাইলের এক দাসী • বনি-ইসরাইলের এক বুদ্ধিমতী নারী • হযরত বিবি মারইয়াম • হযরত খাদিজা • হযরত সওদা • হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা • হযরত হাফসা • হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ • হযরত যোয়ায়রিয়াহ • হযরত মায়মুনাহ • হযরত সাফিয়া • হযরত যয়নব • হযরত রোকেয়া • হযরত উম্মে কুলসুম • হযরত ফাতেমা (রাঃ) • হযরত হালিমা সাদিয়া •
তথ্যসূত্র
- বেহেশতী জেওর • লেখক: হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) • অনুবাদক: হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)