Friday, November 15, 2024

পিতামাতার হক সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশনা

পিতামাতার হক সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশনা

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌ পাক বলেন,

وَوَصَّیْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَیْهِ ۚ حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ وَهْنًا عَلٰی وَهْنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیْ عَامَیْنِ اَنِ اشْكُرْلِیْ وَ لِوَالِدَیْکَ ؕ اِلَیَّ الْمَصِیْرُ ﴿۱۴﴾ (لقمان:١٤)

“আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু-বছরে শেষ হয়েছে। আর আমি নির্দেশ দিতেছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রাখবে) অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে।”(সূরাহ লুকমান, আয়াত ১৪)

মহান আল্লাহ্‌ অন্যত্র ইরশাদ করেন

وَقَضٰی رَبُّکَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا ؕ اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَکَ الْکِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوْ کِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا کَرِیْمًا ﴿۲۳﴾ وَ اخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَۃِ وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا ﴿ؕ۲۴﴾

“তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কোন একজন অথবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধ্যক্যে উপনীত হন, তবে ধূস্‌, দুর বা এ ধরনের বিরক্তি প্রকাশ করার কোন শব্দ তাদের ব্যাপারে ব্যবহার করো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদেরকে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো। আর তাদের সামনে ভালবাসার সাথে নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলো- হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করুন, যেমন তারা অতি আদর ও মায়া-মহব্বতের দ্বারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।”(সূরাহ বনী ইসরাঈল, আয়াত ২৩-২৪)

হাদীস শরীফে হযরত আবু হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা তিনবার বললেন- তার নাসিকা ধূলোয় ধূসরিত হোক! সাহাবায়ে কিরাম রাযি. জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কার ব্যাপারে এসব বদ দু’আ করছেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতা উভয়কে অথবা একজনকে বার্ধক্যে উপনীত অবস্থায় পেল, তবুও সে (তাদের খিদমত করে) জান্নাতে প্রবেশের পথ সুগম করতে পারল না।” (মুসলিম শরীফ, ২৫৫১)


আরো পড়তে পারেন: সন্তানের উপর পিতা মাতার হক ১৪টি


হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- “মাতা-পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং মাতা-পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ অসন্তুষ্টি।” (তিরমিযী শরীফ, ১৯০৪)

হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- কোন বাধ্যগত সন্তান স্বীয় মাতাপিতার দিকে রহমতের (আনুগত্য ও ভক্তির) দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে, প্রতি দৃষ্টিতে একটি কবুল হজ্জের ছাওয়াব তার আমলনামায় লিখা হয়। সাহাবায়ে কিরাম রাযি. জিজ্ঞাসা করলেন, সে যদি প্রতিদিন একশতবার দৃষ্টিপাত করে? রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ! তাতে একশত হজ্জের সাওয়াবই হবে। আল্লাহর দান কল্পনাতীত, তিনি অক্ষমতা হতে অতি পবিত্র। (মিশকাত শরীফ– ২/২০৯, বায়হাকী ১০/২৮৯)

হযরত আবু বাকরাহ রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা ইচ্ছে করলে বান্দার সকল প্রকার গুনাহ মাফ করে দিতে পারেন, কিন্তু মাতাপিতার অবাধ্যতার গুনাহ তিনি মাফ করবেন না। আর অবাধ্য সন্তানের সাজা তার মৃত্যুর পূর্বে এই দুনিয়াতেও হবে। (মিশকাত শরীফ ৪২১, বায়হাকী শরীফ)

হযরত আবু উমামাহ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি নবী করীম- সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট জিজ্ঞাসা করলেন- সন্তানের উপর পিতামাতার কি হক? নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন-“পিতামাতা তোমার জান্নাত বা জাহান্নাম। অর্থাৎ তাদের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির মধ্যে আল্লাহ্‌ তা’আলার সন্তুষ্টি ও জাহান্নাম নিহিত।” (ইবনে মাজাহ, ৩৬৬২)

এসব আলোচনা ইলমে দীনের শিক্ষার্থী, তালিবে ইলমের সামনে থাকার কারণে দুনিয়াতে তারা পিতামাতা উভয়ের অথবা যে কোন একজনের হায়াতে উপস্থিতি সবচেয়ে বড় গণিমত মনে করে থাকে এবং নিজের জানমাল সব কিছু দিয়ে পিতামাতার সেবা-যত্ন করতে চেষ্টা করতে থাকে। তার মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি বা কার্পণ্য করে না। নিজের আরাম-আয়েশ নিজের বিবি-বাচ্চার আরাম-আয়েশ সব কিছুর উপর পিতামাতার সেবা-যত্নকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কারণ-সে জানে, কিয়ামতের বড় বড় ১৫টি আলামতের মধ্যে আছে যে, মানুষ বিবিদের কথা মান্য করবে এবং মায়ের নাফরমানী করবে। বন্ধু-বান্ধবকে নিকটবর্তী করবে এবং পিতাকে দূরে রাখবে। (তিরমিযী শরীফ, ২২১৬)



এসব গুনাহে কবীরা আল্লাহ্‌র নাফরমানীর কাজ থেকে বাঁচার জন্য সর্বদা সে ফিকিরমান্দ থাকে। বাস্তবিক পক্ষে এ ধরণের একজন সন্তান পিতামাতার আত্মার প্রশান্তি এবং নয়নমণি- যা সাধারণ জ্ঞান দ্বারাও বুঝা সম্ভব।

এখন দেখুন, দুনিয়ার যিন্দেগী তো কোন রকম পার হয়ে যাবে, কেউ বালাখানায়, কেউ কুঁড়ে ঘরে, কেউ আরামে, কেউ দুঃখ-কষ্টে, সর্ব অবস্থায়ই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর ইরশাদ মুতাবিক এ উম্মতের অধিকাংশের হায়াত (৬০ থেকে ৭০ বছরের হায়াত) শেষ হয়ে যাবেই। কেউ দুনিয়াতে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবে না। সে যত বড় রাজা, বাদশাহ আর সম্পদশালী কিংবা বৃহৎ ইজ্জতের অধিকারী হোক না কেন। সকলকেই শেষ অবস্থা অতিক্রম করতে হবে- সকলেরই বিশেষ পরিণতিই এটা যে তাকে সারা জীবনের অর্জিত গাড়ী, বাড়ী, রাজত্ব-কর্তৃত্ব, বাগ-বাগান, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সব কিছু রেখে সম্পূর্ণ খালি হাতে পরপারের সফরের প্রথম ষ্টেশন বা ঘাঁটি কবরে পৌঁছতে হবে। মাল-দৌলত, ইযযত-সম্মান, স্ত্রী-পুত্র কেউ সাথী হবে না। দাফনের পর সকলেই বাড়ীতে ফিরে আসবে। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ধকার কবরে অত্যন্ত ভয়ংকর ও ভয়াবহ আকৃতিতে মুনকার-নকীরের আগমন ঘটবে।

এখানে তার ঈমানের পরীক্ষা অবশ্যই দিতে হবে। সেই পরীক্ষায় দুনিয়ার কাউকে সহযোগিতা করার জন্য পাবে না। দুশ্চিন্তা ও পেরেশানীর সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকবে। তার অবস্থা স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, মৃত ব্যক্তির অবস্থা কবরে এরূপ হয়, যেরূপ সাগরে ডুবন্ত ব্যক্তি সাহায্য প্রাপ্তির আশায় চিৎকার করতে থাকে এবং চতুর্দিকে হাত-পা মারতে থাকে; যাতে বাঁচার কোন ব্যবস্থা লাভ করতে পারে। (বায়হাকী, ১০/৩০০)

তেমনিভাবে মৃত ব্যক্তি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের দু’আর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, মন থেকে আকাঙ্খা করতে থাকে। অতঃপর যখন তাদের পক্ষ থেকে কোন দু’আ, ইস্তিগফার বা দান-খাইরাত তার নিকট পৌঁছে, তখন সেটা তাঁর কাছে সমগ্র দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা আছে, তার চেয়েও উত্তম বলে মনে হয়।

আর তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের দু’আকে আল্লাহ্‌ তা’আলা পাহাড় সমতুল্য প্রবৃদ্ধি করে মৃত ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করেন। নবী কারীম  সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,’মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের পক্ষ থেকে হাদিয়া হলো- তাদের জন্য ইস্তিগফার করা অর্থাৎ তাদের গুনাহ মাফ করার জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে প্রার্থনা করা।” (মিশকাত শরীফ, ১/৪৪০)

উল্লেখিত হাদীস অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি স্বীয় সন্তানকে কুরআন ও দীনী ইলম শিক্ষা দেন, তাহলে নিশ্চয় তিনি কবরের মধ্যে সাগরে ডুবন্ত ব্যক্তির ন্যায় থাকবেন না, সাহায্যকারী পাবেন। তিনি কখনও একাকিত্ববোধ করবেন না। বরং তার সন্তানদের পক্ষ থেকে সর্বক্ষণ তার নিকট হাদিয়া দু’আ-ইস্তিগফার পৌঁছতে থাকবে। তার সন্তান যখন হাত তুলে আল্লাহর দরবারে আল্লাহর শিখানো দু’আ দ্বারা দু’আ করতে থাকবে, তখন তো সেই মৃত পিতামাতা খুশীতে বাগবাগ হয়ে যাবেন। এমন কি যে মুহূর্তে সন্তান দীনের কাজে লিপ্ত থাকবে, লোকদের কুরআনে কারীম শিক্ষা দিবে, ওয়াজ-নসীহত ও দাওয়াতে তাবলীগের মাধ্যমে লোকদেরকে দীনের দিকে আহবান করতে থাকবে এবং বাহ্যিক ভাবে পিতামাতার জন্য দু’আ করার অবসর পাবে না, তখনও তার সকল নেক কাজে পিতামাতার সহায়ক এবং অংশীদার হওয়ার কারণে ছাওয়াব পেতে থাকবেন। আর এভাবে তাদের নেকী বাড়তেই থাকবে। এমন কি যদি তাদের কারোর মৃত্যুর সময় গুনাহ বেশী এবং নেকী কম থেকে থাকে তাহলে সন্তানদের পক্ষ থেকে অহরহ দীনের খিদমতের নেকী তাদের আমল নামায় যোগ হওয়ার কারণে ইনশাআল্লাহ তাদের নেকীর পাল্লা গুনাহের পাল্লা থেকে ভারী হয়ে তারা আযাব থেকে মুক্তি লাভ করবেন। এর চেয়ে বড় খুশীর বিযয় আর কি হতে পারে?



হযরত আবু হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “মানবের মৃত্যুতে তার আমলের অবসান ঘটে, তিনটি আমল ব্যতীত। এবং সেগুলো হল- সদকায়ে জারিয়া, ইলম- যার দ্বারা (জগৎ) উপকৃত হয়, নেক সন্তান- যে তার জন্য দু’আ করতে থাকে।” (মুসলিম শরীফ, ১৬৩১)

হযরত আবু হুরাইরাহ রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা নেক বান্দার মৃত্যুর পর জান্নাতে তার দরজা বুলন্দ করে দিবেন অর্থাৎ তাকে জান্নাতে উচ্চ সম্মান দান করবেন। অনন্তর সে বলবে- হে প্রভু! কি করে এত বড় দরজা ও সম্মান আমার নসীব হলো? তদুত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলবেন- তোমার জন্য তোমার সন্তানের দু’আ ও ইস্তিগফারের উসীলায় তোমাকে এত বড় মর্তবা দেয়া হয়েছে।”  (মুসনাদে আহমদ ২/৫০৯, মিশকাত ২০৬ পৃঃ)

হযরত ঈসা ইবনে মারিয়াম আ. একটি কবরের পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন, উক্ত কবরের মৃতকে আযাবের ফেরেশতাগণ আযাব দিচ্ছেন। প্রয়োজন সেরে ঈসা আ. প্রত্যাবর্তন কালে তিনি ঐ কবরটির নিকট দিয়েই যাচ্ছিলেন। এবার তিনি দেখলেন সেখানে রহমতের ফেরেশতাগণকে, যাদের সাথে রয়েছে জান্নাতী নিয়ামতে পরিপূর্ণ নূরের বহু তশতরী। এতে তিনি আশ্চর্যান্বিত হলেন। অনন্তর তিনি নামায পড়ে আল্লাহ্‌র নিকট এর কারণ জানার জন্য দু’আ করলেন। আল্লাহ তা’আলা তার নিকট ওহী প্রেরণ করলেন-হে ঈসা! এই ব্যক্তি ছিল পাপী। তাই মৃত্যুর পর হতে সে আমার আযাবে গ্রেফতার ছিল। সে তার স্ত্রীকে গর্ভাবস্থায় রেখে এসেছিল। অতঃপর সে একটি (পুত্র) সন্তান জন্ম দিল। স্ত্রী তাকে প্রতিপালন করল। ধীরে ধীরে ছেলেটি বড় হল এবং সে তাকে (মক্তবে) উস্তাদের নিকট আল্লাহ তা’আলার কালাম শিক্ষা করার জন্য প্রেরণ করল। মুআল্লিম তাকে পড়ালেন- “বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম।” অতঃপর আমার বান্দাকে ভূগর্ভে আমার অগ্নির শাস্তি প্রদান করতে আমার লজ্জা হল যখন দেখলাম তার সন্তান ভূ-পৃষ্ঠে আমার নামের যিকর করছে। আমার কালাম পাক পাঠ করছে। (তাফসীরে কাবীর, ১১/৭২০)



লক্ষ্য করুন, সন্তানকে কালামে পাক শিক্ষা দেয়ার কারণে পিতা-মাতার কবরের যিন্দেগী কত আরামদায়ক ও সুখের হতে পারে। এত বড় কামিয়াবীর খবর জানার পর কোন মুসলমান কি তার সন্তানকে দীনী ইলম থেকে বঞ্চিত রেখে হতভাগা হতে পারে? আর সেই অবস্থায় তাকে কি কবরের যিন্দেগীর উপর ঈমান রাখে বলে বিশ্বাস করা যায়? এ হচ্ছে- সন্তানকে দীনী ইলম শিক্ষাদানে পিতামাতার মর্তবা। পক্ষান্তরে দীন বর্জিত পার্থিব বিদ্যার মধ্যে এ ধরনের ফজীলতের একটা কথাও কুরআন হাদীসে নেই।

কারণ- তার ভিত্তি তো কুরআন-হাদীসের উপরে নয়, বরং তার ভিত্তি হলো- তীব্র ক্ষুধায় কাতর পেট, প্রবৃত্তি ও যৌনক্ষুধা কোন পন্থায় নিবারণ করা যায়, তার উপর। সেই বিদ্যার সারাংশ হল- শরীরের আরাম-আয়েশের ধান্ধায় চব্বিশ ঘণ্টা মগ্ন থাকা। সে কে? কেন দুনিয়ায় এসেছে? তার গন্তব্যস্থল কোথায়? এসব চিন্তার ধার সেই বিদ্যা ধারে না। পশু বৃত্তির এ ধরনের জিন্দেগী থেকে আল্লাহ তা’আলা সকল মুসলমানকে হিফাজত নসীব করুন।  (আমীন)

বলাবাহুল্য, কোন মুসলমান পরকাল ও আখিরাত থেকে বে-ফিকির থাকতে পারে না। হাশরের ময়দান কত কঠিন বিষয়। সেই দিনের ভয়াবহতা এবং ভয়ঙ্করতা কত মারাত্মক এবং সেই দিনটার প্রতিটি মুহূর্ত কত বিভীষিকাময় হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, সেই দিনটি পঞ্চাশ হাজার বছর লম্বা হবে। সেই দিনে সূর্য মানুষের মাথার একেবারে কাছে থাকবে। গুনাহগাররা গুনাহ অনুযায়ী শরীরের ঘামের মধ্যে ডুবে যাবে। গুনাহের পরিণামে বিভিন্ন আকৃতিতে রূপান্তরিত হবে। পিপাসায় কাতর থাকবে। আমলনামা ডান হাতে আসবে, না বাম হাতে আসবে, সে ব্যাপারে চরম শঙ্কিত থাকবে। মীযানের নেকী-বদীর চিন্তায় ভীত সন্ত্রস্ত থাকবে এবং পুলসিরাত পার হওয়ার দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়বে। আম্বিয়া আ. গণ পর্যন্ত আল্লাহ্‌ তা’আলার দরবারে কথা বলার সাহস করবেন না। স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন কেউ কারোর পরিচয় দিবে না। কেউ কারো খোঁজ-খবরও নিবে না। সকলেই নিজের পেরেশানীতে পাগল পারা হয়ে ঘুরতে থাকবে। সেই দিনের অবস্থা স্বয়ং রাব্বুল আলামীন এভাবে অংকিত করেছেনঃ

یَوْمَ یَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ اَخِیْهِ ﴿ۙ۳۴﴾ وَ اُمِّهٖ وَ اَبِیْهِ ﴿ۙ۳۵﴾ وَ صَاحِبَتِهٖ وَ بَنِیْهِ ﴿ؕ۳۶﴾ لِكُلِّ امْرِیًٔ مِّنْهُمْ یَوْمَئِذٍ شَاْنٌ یُّغْنِیْهِ ﴿ؕ۳۷﴾

“সেদিন মানুষ পলায়ন করবে তার ভ্রাতা থেকে, তার পিতামাতা থেকে! তার স্ত্রী ও সন্তানদের থেকে। সে দিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে- যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে।”(সূরাহ আবাসা-৩৪-৩৭)

অন্যত্র আল্লাহ্‌ তা’আলা ইরশাদ করছেন-

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْ ۚ اِنَّ زَلْزَلَۃَ السَّاعَۃِ شَیْءٌ عَظِیْمٌ ﴿۱﴾ یَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَۃٍ عَمَّاۤ اَرْضَعَتْ وَ تَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَ تَرَی النَّاسَ سُکٰرٰی وَمَا هُمْ بِسُکٰرٰی وَلٰکِنَّ عَذَابَ اللهِ شَدِیْدٌ ﴿۲﴾

“নিশ্চয়ই কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ংকর ব্যাপার। সেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করে ফেলবে। আর মানুষদের তুমি দেখবে মাতাল, অথচ তারা মাতাল নয়। বস্তুতঃ আল্লাহ্‌র আযাব বড়ই কঠিন।” (সূরাহ হাজ্বঃ ১-২)

এই কঠিনতম দিনে পিতা-মাতা কলিজার টুকরা সন্তানের সুফল ভোগ করবে, যদি তারা সন্তানকে কুরআনের তালীম দিয়ে থাকেন।



এ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- হযরত মুআয জুহানী রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে তদনুযায়ী আমল করল, (কুরআনী যিন্দেগী অবলম্বন করল) কিয়ামত দিবসে তার মাতাপিতাকে একটি (করে) নূরের মুকুট পরিয়ে দেয়া হবে। সূর্য তোমাদের দুনিয়ার ঘরে থাকলে যে আলো হত, তার চেয়েও অধিক উত্তম (উজ্জ্বল) হবে সেই মুকুটের জ্যোতি। তাহলে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাদের কুরআনের উপর স্বয়ং আমল করবে?” (আবু দাউদ ২/৯৭)

হযরত আলী রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুরআন পড়ল ও মুখস্থ করল এবং তার হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম জেনে তদনুযায়ী আমল করল, আল্লাহ্‌ তাকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করাবেন এবং তার পরিবারের এমন দশজন লোকের জন্য তার সুপারিশ গ্রহণ করবেন, যাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গিয়েছিল।”(তিরমিযী শরীফ ২৯১০)

হযরত আনাস রাযি. হযরত রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, “যে ব্যক্তি স্বীয় পুত্রকে এতটুকু ইলম (হলেও) শিক্ষা দিবে, যেন সে দেখে দেখে কুরআন শরীফ পড়তে পারে, তার পূর্বাপরের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। আর যে সন্তানকে পবিত্র কুরআন হিফয করাবে, তাকে কিয়ামতের দিন পূর্ণিমার চন্দ্রের ন্যায় করে উঠান হবে এবং তার পুত্রকে বলা হবে- পড়। যখন সে একটি আয়াত পড়বে, তখন পুত্রের দরজা বুলন্দ হওয়ার সাথে সাথে তার পিতামাতারও একটি দরজা বুলন্দ করা হবে। এভাবে পূর্ণ কুরআন খতম করা হবে। (তাবারানী শরীফ ১/৫২৪)

উল্লেখিত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা গেল, সন্তান-সন্তানাদি পিতামাতার জন্য যবরদস্ত নিয়ামত, যা তার দুনিয়া, কবর ও আখিরাতের সকল ঘাঁটিতে কাজে আসবে যদি তারা সন্তানদের কুরআনে কারীমের তা’লীম দিয়ে থাকে। নতুবা এ সন্তান প্রত্যেক ঘাটিতে তাদের জন্য সমূহ বিপদের ও আযাবের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ- তারা আল্লাহ্‌ তা’আলার এ মহা দৌলত ও নিয়ামতের কদর করেনি। বরং নাশুকরী করেছে। তাই এর দরুন তারা কঠোর শাস্তিতে ভুগবে। সুতরাং প্রত্যেকেরই এ ব্যাপারে যত্নবান হওয়া একান্ত কর্তব্য ও জরুরী।  দীনের ইলম না থাকার দরুন অসংখ্য পিতামাতা নিজেদের ও সন্তানের কল্যাণ-কামনায় ভুল পদ্ধতিতে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করছে। কিন্তু বস্তুতঃ এর দ্বারা কেউ প্রকৃত কল্যাণ হাসিল করতে পারছে না। তাই সময় ও সুযোগ থাকতে এ নিয়ামতের সৎ ব্যবহার করা কর্তব্য।

সূত্র

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,606FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles