পর্দার ব্যাপারে কুরআনের বিধান
(১) আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَاِذَا سَاَلْتُمُوْ هُنَّ مَتَاعًا فَسْئَلُوْ هُنَّ مِنْ وَّرَاءِ حِجَابٍ الاية
এ আয়াতের শানে নুযূলের বর্ণনায় বিশেষভাবে নবীপত্নীগণের উল্লেখ থাকলেও এ বিধান সমগ্র উম্মতের জন্যে নাযিল হয়েছে। (মা‘আরিফুল কুরআন-৭/১৩১)
উক্ত আয়াতের বিধানের সারমর্ম এই যে, বেগানা মহিলাদের নিকট থেকে পর পুরুষদের কোন ব্যবহারিক বস্তু, পাত্র ইত্যাদি নেয়া জরুরী হলে পুরুষগণ সামনে এসে নেবে না; বরং পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। আরও বলা হয়েছে যে, পর্দার এই বিধান পুরুষ ও নারী উভয়ের অন্তরকে শয়তানের কু-মন্ত্রণা থেকে পবিত্র রাখার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে। (সূরা আহযাব-৫৩)
এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, উক্ত আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুণ্যাত্মা পত্মীগণকে পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে, যাদের অন্তরকে পাক-সাফ রাখার দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং গ্রহণ করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّمَا یُرِیْدُ اللهُ لِیُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ اَهْلَ الْبَیْتِ وَ یُطَهِّرَكُمْ تَطْهِیْرًا
অর্থ:আল্লাহ তা‘আলা তো কেবল তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে চান। (সূরা আহযাব, ৩৩)
👉 আরো পড়তে পারেন: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কাযা নামায পড়ার বিধান
অপরদিকে যে সব পুরুষকে সম্বোধন করে এই বিধান দেয়া হয়েছে, তারা হলেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবায়ে কিরাম, যাদের মর্যাদা নবীগণের (আ.) পরে সকলের ঊর্ধ্বে। সকল মুসলমান, গাওস, কুতুব ও আবদালের মর্তবা একজন সর্বনিম্ন সাহাবীর সমান হতে পারে না, এ কথার উপর উম্মতের ইজমা হয়ে গেছে; কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাঁদের আন্তরিক পবিত্রতা রক্ষা এবং শয়তানের কু-মন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্যে পুরুষ ও নারী সাহাবা রা.গণের মধ্যে পর্দার ব্যবস্থা করা জরুরী ঘোষণা করা হয়েছে।
আজ এমন কোন পুরুষ আছে, যে তার মনকে সাহাবায়ে কিরামের মন অপেক্ষা এবং এমন কোন মহিলা আছে যে, তার মনকে পুণ্যাত্মা নবী পত্মীগণের মন অপেক্ষা অধিক পবিত্র হওয়ার দাবী করতে পারে? আর এটা কিভাবে হতে পারে যে, নারীদের সাথে তাদের মেলামেশা কোন অনিষ্টের কারণ হবে না? (মা‘আরিফুল কুরআন-৭/২০০)
(২) আরো ইরশাদ হয়েছে-
وَقَرْنَ فِیْ بُیُوْتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِیَّۃِ الْاُوْلٰی
অর্থ:(হে মুমিন মহিলাগণ!) তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং পূর্বের জাহিলী যুগের ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বের হবে না। (সূরা আহযাব-৩৩)
উক্ত আয়াতে পর্দা সম্পর্কিত আসল হুকুম এই যে, নারীগণ গৃহেই অবস্থান করবে। অর্থাৎ, জরুরী প্রয়োজনে শর‘ঈ অনুমতি ব্যতীত তারা বাইরে বের হবে না। সাথে সাথে একথাও বলা হয়েছে যে, যেভাবে ইসলামপূর্ব অজ্ঞ ও অন্ধ যুগে নারীরা প্রকাশ্যভাবে বেপর্দায় চলাফেরা করত, তোমরা কখনো সে রকম চলাফেরা করো না।
বর্ণিত আয়াতে পর্দা সম্পৃক্ত দু’টি বিষয় জানা গেলঃ
প্রথমতঃ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার নিকট নারীদের বাড়ী থেকে বের না হওয়াই কাম্য। গৃহকর্ম তথা গৃহের আভ্যন্তরীণ কর্ম সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এতেই তারা পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করবে। যেমন স্বামীর সেবা যত্ন, সন্তানদেরকে দ্বীনী ও কুরআনী তা‘লীম, স্বামীর সংসার ও সম্পদের সংরক্ষণ, মহিলা মহলে দ্বীনের দাওয়াত ও তা‘লীম এবং নিজের ইবাদত বন্দেগীই তার জীবনের মূল লক্ষ্য।
দ্বিতীয়ত:শর‘ঈ প্রয়োজনের তাকীদে যদি নারীকে বাড়ী থেকে বের হতেই হয়, তাহলে তার বের হওয়া জায়েয আছে বটে, তবে শর্ত হল যেন সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে বের হয়।বরং চেহারাসহ গোটা শরীর আবৃত করে ফেলে, এমন বোরকা অথবা এমন বড় আকারের চাদর ব্যবহার করে বের হবে। (মা‘আরিফুল কুরআন, ৭/১৩৩)
(৩) কুরআন শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে-
یٰنِسَآءَ النَّبِیِّ لَسْتُنَّ کَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ الخ
অর্থ: হে নবী পত্নীগণ! (উদ্দেশ্য উম্মতের সকল মহিলা) (মা‘আরিফুল কুরআন,৭/১৩১)
তোমরা অন্য নারীদের মত নও।যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাহলে পরপুরুষের সাথে এমন কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, যার ফলে যে ব্যক্তির অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে কু-বাসনা করবে। আর তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। (সূরা আহযাব, ৩২)
উক্ত আয়াতটিও নারীদের পর্দা সম্পর্কিত, তাদের কণ্ঠ ও বাক্যালাপ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আয়াতে فَلَاتَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ এর ব্যাখ্যা হচ্ছে যদি, পরপুরুষের সাথে পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে বাক্যালাপের সময় নারী কণ্ঠের স্বভাবসুলভ কোমলতা ও নাজুকতা কৃত্রিমভাবে পরিহার করবে। অর্থাৎ, এমন কোমলতা যা শ্রোতার মনে অবাঞ্ছিত কামনা সঞ্চার করে, তার কোন সুযোগ দিবে না। যেমন এর পরে ইরশাদ হয়েছে- فَيَطْمَعَ الَّذِىْ فِىْ قَلْبِه مَرَضٌ অর্থাৎ, এরূপ কোমল কণ্ঠে বাক্যালাপ করেনা, যা ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর বিশিষ্ট লোকের মনে কু-লালসা ও আকর্ষণ সৃষ্টি করে।
মোদ্দাকথা, নারীদেরকে পরপুরুষ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে পর্দার এমন উন্নত স্তর অর্জন করা উচিত, যাতে কোন অপরিচিত দূর্বল ঈমান বিশিষ্ট লোকের অন্তরে কোন কামনা ও লালসা সৃষ্টি করা তো দুরের কথা, তার নিকটেও ঘেঁষবে না। বরং তার বিরুদ্ধ অবস্থা ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। (মা‘আরিফুল কুরআন-৭/১৩২)
স্বর্ণযুগের সোনার মানুষ পুণ্যাত্মা নবীপত্নীগণকে যদি স্বর্ণযুগের স্বর্ণমানব সাহাবায়ে কিরামের সাথে পর্দার আড়াল সত্ত্বেও কথা বলার ক্ষেত্রে এমন কড়া নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে যে, তাদের কণ্ঠ ও বাক্যালাপও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাহলে আধুনিক যুগের নারী-পুরুষদের কি পর্দার প্রয়োজন নেই? অথবা পর্দার প্রয়োজন থাকলেও তাদের কণ্ঠ ও বাক্যালাপ নিয়ন্ত্রণ রাখার প্রয়োজন নেই? অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না; বরং বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর সে প্রয়োজন আরো তীব্রভাবে অনুভূত হয়।
(৪) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে:
يٰاَيُّهَا النَّبِىُّ قُلْ لِاَزْوَاجِكَ وَبَنٰتِكَ وَنِسَآءِ الْمُؤْمِنِيْنَ يُدْنِيْنَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيْبِهِنَّ ذٰلِكَ اَدْنٰى اَنْ يُّعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ الخ
অর্থ:হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মু‘মিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের বড় চাদরের বিশেষ অংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে (আযাদ মহিলা হিসাবে) চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে কেউ কষ্ট দিবে না। (সূরা আহযাব-৫৯)
উল্লেখিত আয়াতেও নারীদেরকে পর্দার আদেশ দেয়া হয়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে- فَلَايُؤْذَيْنَ অর্থাৎ, সমস্ত শরীর পর্দায় আবৃত রাখার ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। এতে প্রতীয়মান হয় যে, পর্দাই নারী জাতির নিরাপত্তার রক্ষা কবচ।
(৫) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে
فَانْكِحُوْهُنَّ بِاِذْنِ اَهْلِهِنَّ وَاٰتُوْهُنَّ اُجُوْرَهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ مُحْصَنٰتٍ غَيْرَ مُسٰفِحٰتٍ وَّلَا مُتَّخِذَاتِ اَخْدَانٍ
অর্থ: অতএব, তোমরা তাদেরকে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে বিবাহ কর এবং নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর। এমতাবস্থায় যে, তারা সতী-সাধ্বী হবে, ব্যভিচারিণী এবং গোপন বন্ধুত্ব গ্রহণকারিণী হবে না। (সূরা নিসা-২৫)
(৬) আরো ইরশাদ হয়েছে
وَالْمُحْصَنٰتُ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَ الْمُحْصَنٰتُ مِنَ الَّذِيْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلِكُمْ اِذَا اٰتَيْتُمُوْهُنَّ اُجُوْرَهُنَّ مُحْصِنِيْنَ غَيْرَ مُسٰفِحِيْنَ وَلَا مُتَّخِذِىْ اَخْدَانٍ
অর্থ:তোমাদের জন্য হালাল সতী-সাধ্বী মুসলমান নারী এবং তাদের সতী-সাধ্বী নারী, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমাদের পূর্বে, যখন তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদান করে বিবি বানিয়ে নাও। যিনা ব্যভিচারে লিপ্ত না হও এবং গোপনে তাদের সাথে সম্পর্ক না রাখ অর্থাৎ গুপ্ত প্রেমে লিপ্ত না হও। (সূরা মায়েদা-৫)
উক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা পুরুষ ও মহিলাদের উভয়কেই ব্যভিচারিতা এবং বিবাহপূর্ব অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন, যা পর্দা প্রথা রক্ষার কুরআনী নির্দেশ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষ মহিলাদের অবাধ মেলামেশা সহশিক্ষার কুফলে আজ বিবাহপূর্ব অবৈধ প্রেম-প্রীতি ও যিনা-ব্যভিচারে সয়লাব হচ্ছে এবং কুরআনের নিষেধাজ্ঞার সরাসরি বিরোধিতা করে আল্লাহর গযব নাযিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তথ্য সূত্র
- শরঈ পর্দা • লেখক: মুফতী মনসূরুল হক