▶ প্রশ্ন: সুফি শব্দের অর্থ কি? সুফিবাদের ক্রমবিকাশ আলোচনা করুন। ▶ বিষয়: IST-604 : History of Sufism in Bangladesh and Some Prominent ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (ফাইনাল)
সুফি শব্দের অর্থ কি? সুফিবাদের ক্রমবিকাশ আলোচনা করুন।
ভূমিকা
কবি শেখ সাদী (র.) বলেন, ‘এই সমুদ্রে হাজার কিশতী ডুবে গেছে; কিন্তু একটিও ভেসে উঠে নদীর তীরে পৌঁছেনি।’ জড়বাদ মানুষের যে অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে, বুদ্ধিবাদ তা পূর্ণ করতে পারেনি বলে সেই শূন্যতা পূরণ করেছে ইসলামের আধ্যাত্মিকতা। আর ইসলামের এই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের নাম হলো সুফিবাদ। মানুষের জীবন আত্মা এবং দেহের সমন্বয় গঠিত। সুফিবাদের যে জ্ঞানের সাহায্যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা হয়, তাকে বলা হয় এলমে তাসাউফ।
সুফি শব্দের অর্থ
সুফি শব্দটি ‘বিশুদ্ধতা’ গুণ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। সূফ শব্দের অর্থ হলো বিশুদ্ধ পশম। সূফ শব্দটি বিশুদ্ধতাকে বোঝায় না কারণ বিশুদ্ধ হলো পশমের গুণ। কিন্তু যখন সূফ শব্দটি বিশেষণ হিসেবে প্রয়োগ হয় তখন হয় সুফি। সুফি হলো বিশেষণ বা গুণ প্রকাশক। সুফি সাধক মানে বিশুদ্ধ সাধক। সুফি সাধনা মানে বিশুদ্ধতার সাধনা।
সুফিবাদ বলতে ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক দর্শনকে বোঝায়। এই দর্শনের মূল লক্ষ্য হল আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা।
‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি
ইবনে খালিদুন, ড. এ. ই. আফিফী, আল-কালবাদী, আর-রুদবারী, আবু নসর আস-সাররাজ প্রমুখ পণ্ডিতগণের মতে, ‘সুফি’ শব্দটি সুফুন থেকে আসা; যার অর্থ পশম। পশমি বস্ত্র সরলতা ও আড়ম্বহীনতার প্রতীক। হজরত মোহাম্মদ (স.) ও তাঁর সাহাবিরা বিলাসী জীবনযাপনের পরিবর্তে সাধাসিদে পোশাক পরতেন এবং পরবর্তীকালে সুফিগণ সাদাসিধে জীবনযাপনের জন্য এই পোশাক গ্রহণ করে কম্বল-সম্বল করে চলেন বলে তাদের সুফি বলা হয়। আলী হাজাবিরী, মোল্লা জামী (র.)-এর মতে, সুফি কথাটি সাফা থেকে এলেও এর অর্থ হলো পবিত্রতা, আত্মশুদ্ধি ও সচ্ছলতা। যারা আত্মার পবিত্রকরণ সাধনায় নিয়োজিত থাকেন, তাদের সুফি বলা হয়।
সুফিবাদ
মুসলিম দার্শনিকরা ও আধ্যাত্মিক সাধনায় সাধনাকারী ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে সুফিবাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যেমন— ইমাম শামী (রহ.) বলেন, ‘সুফিবাদ হলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান যে জ্ঞানের সাহায্যে মানুষের সৎ গুণাবলীর প্রকারভেদ এবং তা অর্জনের পন্থা ও অসৎ গুণাবলীর প্রকারভেদ ও তা থেকে রক্ষার উপায় জানা যায়।’
জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.) বলেন, ‘আত্মিক পবিত্রতা অর্জন ও আল্লাহ ছাড়া সবকিছু থেকে প্রভাবমুক্ত হওয়ার নাম হলো সুফিবাদ।’
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘তাসাউফ এমন একটি বিদ্যা যা মানুষকে পশু থেকে উন্নীত করে মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।’
উল্লেখিত সংজ্ঞাগুলো পর্যালোচনায় বলা যায়, নবী করিম (স.)-এর নির্দেশিত পথে আত্মশুদ্ধি করে ইসলামের বাহ্য ও অন্তর জীবনের প্রেমপূর্ণ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে পরম সত্তার পূর্ণ জ্ঞানার্জন ও তার নৈকট্য লাভজনিত রহস্যময় উপলব্ধিকে সুফিবাদ বলা হয়।
সুফিবাদের উৎপত্তি
সুফিবাদের উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। তাদের মতামত পর্যালোচনায় যা পাওয়া যায়—
- বেদান্ত ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব;
- খ্রিস্টীয় ও নিও-প্লেটানিক প্রভাব;
- পারসিক প্রভাব ও
- কোরআন-হাদিসের প্রভাব।
প্রথম তিনটি মতবাদকে অভ্যন্তরীণ মতবাদ বলা হয় আর শেষেরটিকে বলা হয় বাহ্যিক উৎস। পাশ্চাত্যের কিছু চিন্তাবিদ তথা গোল্ডজিহার, এইচ মার্টেন প্রমুখের মতে, সুফিবাদ বেদান্ত দর্শন ও বৌদ্ধ দর্শন হতে উদ্ভূত। কারণ মুসলমানরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে এরপর থেকে ভারতীয় সন্ন্যাসী ও বেদান্ত বৌদ্ধদের প্রভাবে প্রভান্বিত হয়ে মুসলমানরা কঠোর সংযম ও কৃচ্ছ্র সাধনের স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। আর সে থেকে মুসলমানদের ভেতর সুফিবাদের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু হাসান বসরি, জুন্নুন মিসরী, আবুল হাশিম কুফি, ইব্রাহীম বিন আদহাম, রাবেয়া বসরি প্রমুখ সুফিদের আবির্ভাব ও সাধনা প্রমাণ করে, সুফিবাদ ভারতীয় আমদানি নয়; বরং ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার ফলে সুফিবাদের উদ্ভব ঘটে।
ঐতিহাসিক ব্রাউনি ও তার কিছু অনুসারীর মতে, সুফিবাদের উৎপত্তি ঘটেছে পারসিক প্রভাব থেকে। কিন্তু এ মতও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন। কারণ বেশিরভাগ সুফি পারস্যের হলেও তার মানে এই বোঝায় না যে, সুফিবাদ পারস্য থেকে এসেছে। কেননা আবু বকর ইবনুল আরাবি ও ইবনুল ফরিদসহ অনেক দার্শনিক আরবিভাষী ছিলেন। প্রকৃত অর্থে, ইসলামী আধ্যাত্মিক শিক্ষার মূল উৎস হলো কোরআন। যদিও কোরআন ও হাদিসে ‘সুফিবাদ’ শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করা হয়নি; তবে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস দ্বারা সুফিবাদ তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দিকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইবনে খালিদুন অত্যন্ত জোর গলায় বলেছেন, ‘সুফিবাদ এমন এক ধর্মীয় বিজ্ঞান যার উৎপত্তি খোদ ইসলাম থেকে হয়েছে।’
সুফিবাদের ক্রমবিকাশ
প্রকৃতপক্ষে সুফিবাদের আবির্ভাব মোহাম্মদ (সা.)-এর সময় থেকে শুরু হলেও সর্বপ্রথম মুসলিম সুফি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় হজরত হাসান বসরি (র.)-কে। তাঁর জ্ঞানতত্ত্বের আলোকে সুফি-সাধকগণ সুফিবাদের ক্রমবিকাশে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ভিন্নমতে, সর্বপ্রথম সুফি হিসেবে যার নাম স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সে হলো আবয় হাশিম কুফী। কেউ কেউ আবার জাবির বিন হাইয়্যানকে প্রথম সুফি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। হিজরি দ্বিতীয় শতকে সুফিবাদের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য সুফিগণ হলেন— ইব্রাহীম বিন আদহাম, রাবেয়া বসরি, দাউদ আততায়ী ও ফুজায়ল বিন হাইয়াজ প্রমুখ। পরবর্তীকালে সুফিবাদের ক্রমবিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন জুন্নুন মিসরী। তিনি সুফিবাদের সর্বপ্রথম ব্যাখ্যাদানকারী।
কালক্রমে সুফিবাদের ভেতর সর্বেশ্ববাদের ধারণা যুক্ত হতে থাকে। এ ধরনের মতবাদের মূল প্রবক্তা বায়েজিদ বোস্তামি ও মানসুর হাল্লাজ। তবে মানসুর হাল্লাজের বক্তব্য কিছুটা বিতর্কিত ছিল। অতঃপর ইমাম গাজ্জালির সময় থেকে সুন্নিবাদী মতবাদ সুফিবাদের ভেতরে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নেয়। তিনি গোড়া ইসলাম ও সুফিবাদের মধ্যে সুন্দর সমন্বয় করেন। তার সময়ের সুফিদের মধ্যে আবদুল কাদির জিলানী, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, আল-কুশাউরী, শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সপ্তম হিজরীতে স্পেনে ইবনুল আরাবি সর্বেশ্বরবাদের প্রচলন করেন। তার মরমি ধারার ক্রমবিকাশে সাহায্য করেছিলেন জালালুদ্দিন রুমি (র.)। অতঃপর ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক সুফির আবির্ভাব ঘটে, যাদের মধ্যে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, বাহাউদ্দিন নকশেবন্দি, শিহাবুদ্দিন, মুজাদ্দেদ আল ফেসানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার
বিশ্বের অতুলনীয় প্রতিভা ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন, হিজরীর প্রথম সোনালী তিন যুগে সূফী শব্দটি প্রসিদ্ধ ছিল না। কেউ বলেন, ‘সূফী’ শব্দটি ‘আহলে সুফ্ফাহ’-এর সাথে জড়িত। কেউ বলেন, এটা আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো প্রথম সফ্ (কাতার)-এর সাথে সম্পর্কিত।
• IST-601 : Study of al Tafsir (Tafsir Ibn Kathir : Surah-al-Maieda verse 1 to 77) • IST-602 : Study of al-Fiqh • IST-603 : Philosophy of religion and Comparative Religion • IST-604 : History of Sufism in Bangladesh and some prominent • IST-605 : Trade, Commerce and Business Studies in Islam •
[…] সুফি শব্দের অর্থ কি? সুফিবাদের ক্রমবিকাশ আলোচনা করুন। ➔ উত্তর দেখুন […]