▶ প্রশ্ন: দ্বীনের সংজ্ঞা দিন। দ্বীন, ধর্ম ও রিলিজিওনের মধ্যে সংজ্ঞাগত মৌলিক পার্থক্যটুকু কী? মানব জীবনে ধর্মের অপরিহার্যতা প্রমাণ করুন। ▶ বিষয়: IST-603 : Philosophy of Religion and Comparative Religion ▶ কোর্স: এমএ ইন ইসলামিক স্টাডিজ (ফাইনাল)
দ্বীনের সংজ্ঞা দিন। দ্বীন, ধর্ম ও রিলিজিওনের মধ্যে সংজ্ঞাগত মৌলিক পার্থক্যটুকু কী? মানব জীবনে ধর্মের অপরিহার্যতা প্রমাণ করুন।
ভূমিকা
মানব সভ্যতার মতোই ধর্ম মানব জীবনে একটি প্রচীনতম বিষয়। মানবজীবন ও ধর্ম শুরু থেকেই সহজাতভাবে বিকশিত হয়েছে। পৃথিবী সব দেশে, সবকালে, সব জাতি ও সভ্যতায় ধর্ম বিদ্যমান ছিল। অধিকাংশ সভ্যতার সুতিকাগার হিসেবে ধর্ম চিহ্নিত হয়েছে।
দ্বীন, ধর্ম ও রিলিজিওনের মধ্যে সংজ্ঞাগত পার্থক্য
দ্বীন একটি আরবী শব্দ যার শাব্দিক অর্থ হল অনুসরণ, প্রতিদান ইত্যাদি। পরিভাষাগত অর্থে, মানুষ ও বিশ্বের জন্যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন বলে বিশ্বাস এবং এই বিশ্বাস সম্পর্কিত যাবতীয় বিধি-নিষেধ হল ‘দ্বীন’।
দ্বীনের এই সংজ্ঞানুসারে, যারা সম্পূর্ণরূপে সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী এবং সৃষ্টিসমূহের সৃষ্টিকে সাংঘর্ষিক অথবা শুধুমাত্র প্রকৃতি ও পদার্থসমূহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল বলে মনে করেন, তারা বিধর্মী বলে পরিচিত। আর যারা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন, তাদের মতাদর্শ ও ধর্মানুষ্ঠানগুলো যতই সবিচ্যুতি ও কুসংস্কারাচ্ছন্নই হোক না কেন, তারা সধর্মী বলে পরিগণিত। এ মূলনীতির ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধর্মসমূহকে সত্যধর্ম ও মিথ্যাধর্মে বিভক্ত করা যায়।
সংস্কৃত ‘ধৃ’ ধাতুর সঙ্গে ‘মন’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে (ধৃ+মন) ধর্মের শব্দের উৎপত্তি। ধৃ- মানে ধারণ বা গ্রহণ করা, আর মন- মানে হলো আত্মা, অন্তর বা পরমাত্মা। তাই বলা যায়, মন যাকে গ্রহণ করে শান্তি লাভ করে তাকেই ধর্ম বলা হয়। অর্থাৎ যে জিনিসের সাথের মানুষের মনের বা আত্মার শান্তির বিষয়টি জড়িত তা-ই ধর্ম।
ইসলাম ধর্মানুসারে আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষের আত্মাকে একসাথে সৃষ্টি করেছেন। তাই স্বভাবগতভাবেই মানুষের মাঝে সৃষ্টিকর্তা তথা আল্লাহর প্রতি ভয় ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সব মানুষের অন্তরেই বিরাজমান।
ধর্ম শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো রিলিজিওন (Religion)। শাব্দিক বিবেচনায় এর অর্থ হলো অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ শক্তির অসিত্বে বিশেষত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা।
মানব জীবনে ধর্মের অপরিহার্যতা
মানবজীবনে ধর্মের গুরুত্ব, প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানবজীবনে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিম্নরূপ-
- মানসিক শান্তি: মানুষের মানসিক প্রশান্তি লাভে ধর্ম বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একমাত্র ধর্মই পারে মানসিক শান্তি আনতে। মুসলমানরা যখন মসজিদে অবস্থান করে, তখন তারা একটি বিশেষ শান্তি অনুভব করে। মসজিদকে সব সময় একটি শীতল পবিত্র স্থান মনে হয়। ঠিক তেমনি অন্যান্য ধর্মের লোকজন তাদের উপাসনালয়ে গিয়ে শান্তি অনুভব করে।
- জীবনের নিরাপত্তা বিধান: প্রত্যেক নাগরিকের কাছে তার নিজের জীবন সবচেয়ে মূল্যবান। ধর্ম মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মে অন্যায় হত্যাকাণ্ডকে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হত্যাকারীর জন্য সর্বোচ্চ দণ্ডবিধান মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রীতিও বেশির ভাগ ধর্মে অনুসৃত হয়েছে।
- ঐক্য সাধন: মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টিতে ধর্ম ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে একটি গভীর ঐক্য লক্ষ করা যায়। যদি কোনো ধর্মের লোক অন্য কোনো ধর্মের লোকের কাছে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার ধর্মের লোকজন একত্র হয়ে তাকে সাহায্য করে।
- সম্পদের নিরাপত্তা বিধান: জীবনের পরেই মানুষের অত্যন্ত প্রিয় বস্তু সহায়-সম্পদ তথা ধন-সম্পদ। ধর্ম মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে যথাযথ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, অর্থ আত্মসাৎ, লুণ্ঠন ও অবৈধ উপার্জন অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এসব কাজকর্মের জন্য শাস্তির বিধান আছে। অন্যের অর্থ-সম্পদ অবৈধভাবে দখল বা আত্মসাৎ করাকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে।
- সামাজিক নিয়ন্ত্রণ: সমাজ পরিচালনার নানা বিষয়ে ধর্ম বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ধর্মের সঠিক ব্যবহারই সমাজকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
- সম্মানের নিরাপত্তা বিধান: ধর্ম মানুষের সম্মান ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান করে। কারণ মান-সম্ভ্রম মানুষের জীবন ও সম্পদের চেয়েও বেশি প্রিয় বলে প্রতীয়মান হয়। মানুষ তার ইজ্জত, সম্মান রক্ষার জন্য অকাতরে সম্পদ ব্যয় করে, জীবন উৎসর্গ করে। প্রতিটি ধর্মে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া, অহংকার করা, মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, ছোট করা বা অসম্মান করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা, মিথ্যা দোষারোপ, চোগলখুরি, কু-ধারণা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, কারো সম্মানে আঘাত লাগে—এমন কথা বলা বা কাজ করা ইত্যাদিকে সব ধর্মে পরিহার করতে বলা হয়েছে।
- ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম: ব্যক্তিগত জীবনকে সমাজসিদ্ধভাবে পরিচালনা করতে ধর্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম মানুষকে সৎ, কর্মঠ, দায়িত্বশীল, সহানুভূতিশীল ও পরস্পরকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। ব্যক্তির স্বাস্থ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা, সৌন্দর্য, আহার-বিহার, চিত্তবিনোদন, শিক্ষা, বিবেক-বুদ্ধি, অল্পে তুষ্টি, চারিত্রিক স্বচ্ছতা, কর্মোদ্যম, ধীরস্থিরতা, বিচক্ষণতা, বিনয় নম্রতা, ভদ্রতা, মহানুভবতা, সততা, নৈতিকতা, পরার্থপরতা, ভালো কাজ, অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় সব ধর্মে শিক্ষা দেওয়া হয়।
- পারিবারিক জীবনে ধর্ম: পরিবার সমাজের একটি ক্ষুদ্রতম আদিম সংগঠন। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে পরিবারব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বিবাহবন্ধন না থাকলে তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশা, অবাধ যৌনাচার, লিভ টুগেদার, সমকামিতা, ব্যভিচার, ধর্ষণ, বিবাহের নামে অনেক স্ত্রী গ্রহণ প্রভৃতির দ্বারা মানবজাতি পাপপঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হতো। তাই বিবাহ একটি সুষ্ঠু পারিবারিক জীবন উপহার দেয়, যেখানে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন মিলে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। বিশ্বের সব ধর্ম পরিবারব্যবস্থাকে অটুট ও স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- সামাজিক জীবনে ধর্ম: সমাজজীবনকে স্বাভাবিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ, মূল্যবোধ, নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক সংহতি বিকাশে ধর্মের ভূমিকা অতুলনীয়। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মানুষ একত্র হয়ে পারস্পরিক সহানুভূতি ও প্রীতির সঞ্চার করে। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মে মানবপ্রেম, মানবসেবা, পরার্থপরতা, দয়া, সহনশীলতা, সহযোগিতা, সদাচার প্রভৃতির শিক্ষা দেওয়া হয়।
- রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্ম: পৃথিবীর প্রতিটি দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার পেছনে ধর্মের ভূমিকা অনন্য। যে দেশে যে ধর্মের লোক বেশি, সাধারণত সেই ধর্মের লোকজন ক্ষমতায় আরোহণ করে। ধর্মের কারণেই রাষ্ট্র সুসংহত ও স্থায়ী হয়। তাই যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত থাকেন, তাঁরা যেন স্বেচ্ছাচারী, কর্তৃত্ববাদী না হন, ধর্ম সেই শিক্ষাই দেয়। ধর্ম রাষ্ট্রের প্রধানকে প্রজাপালক, প্রজাকল্যাণকর ও জনদরদি হতে নির্দেশ দেয়। জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি সব ধর্মের দিকনির্দেশনা রয়েছে।
- আন্তর্জাতিক জীবনে ধর্ম: বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পৃথিবীর সব মানুষ উৎসগত বিবেচনায় এক ও অভিন্ন। তাদের মা-বাবা এক, সৃষ্টিকর্তা এক এবং তাদের জীবনের উদ্ভব, বিকাশ ও গন্তব্য এক। ধর্ম একান্তভাবে বিশ্বমানবকে পারস্পরিক অভিন্নতার এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।
উপসংহার
মানব জীবনে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। মানুষের ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে ধর্মের ব্যাপকতা রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রই ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ধর্মের বাইরে গেলেই মানুষের মাঝে পদস্খলন ঘটে। যাতে ব্যক্তি থেকে আন্তর্জাতিক জীবনে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। তাই ধর্মের ব্যাপকতা সমগ্র জীবন ব্যাপী।
• IST-601 : Study of al Tafsir (Tafsir Ibn Kathir : Surah-al-Maieda verse 1 to 77) • IST-602 : Study of al-Fiqh • IST-603 : Philosophy of religion and Comparative Religion • IST-604 : History of Sufism in Bangladesh and some prominent • IST-605 : Trade, Commerce and Business Studies in Islam •
[…] দ্বীনের সংজ্ঞা দিন। দ্বীন, ধর্ম ও রিলিজিওনের মধ্যে সংজ্ঞাগত মৌলিক পার্থক্যটুকু কী? মানব জীবনে ধর্মের অপরিহার্যতা প্রমাণ করুন। ➔ উত্তর দেখুন […]