উপমহাদের প্রখ্যাত আলেম, হাকিমুল উম্মত হিসেবে খ্যাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রচিত মুসলমানের হাসি বই-এ নাসির গাজীর অনেকগুলো বুদ্ধিদীপ্ত ও শিক্ষণীয় গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পগুলো থেকে শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক হাস্যরসাত্মক শিক্ষণীয় গল্প রয়েছে। সেখান থেকে গল্পগুলো এখানে তুলে ধরা হলো-
অন্তরে আল্লাহর ভয় তৈরি করা
নাসির গাজী ৪ মাস যাবৎ রাজা দরবারে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। অনেক দিন যাবৎ তাকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত এক নির্জন স্থানে তার সন্ধান পাওয়া গেল। ইদানীং তিনি দরবেশের দিকে ঝুকে গেছেন।
একদা বাদশাহ তার রাজ্যের সবচেযে বেশী খোদাভীরু একজন বুযুর্গের সাথে দেখা করতে চাইলেন। মন্ত্রীরা তাকে নাসির গাজীর খানকায় নিয়ে গেল। বাদশাহ দরবেশ রূপী নাসির গাজীকে বললেন, আমি আজাব-গজবের অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু আমার এগুলোতে আল্লাহর ভয় লেশমাত্রও হয়না। আমাকে এমন কোন আমল দিন-যার ফলশ্রুতিতে আমার অন্তরে আল্লাহর ভয় পয়দা হবে। দরবেশ রূপী নাসির গাজী বললেন- আমি এমন কি আর আমল দিবো। তবে একটি আমল আছে, যা নিয়মিত করতে পারলে আশা করা যায় ৪০ দিনে কাজ হবে ইনশাআল্লাহু তাআলা। সেই আমলটা হলো- প্রতিদিন ১০০ বার মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। তখন বাদশাহ ১০০ বার হিসাব রাখার জন্য তাছবিহ একটি কিনে প্রতিদিন মৃত্যু.. মৃত্যু… মৃত্যু… এভাবে জিকির করে মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে লাগলেন।
এভাবে ৪০ দিন পুরা হয়ে গেল, কিন্তু বিন্দুমাত্রও আল্লাহর ভয় তার মধ্যে পয়দা হলো না। তখন বাদশাহ রাগে ক্ষোভে পুনরায় দরবেশ রূপী নাসির গাজীর কাছে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন নাসির গাজী দরবেশ হিসেবে বসা। তা দেখে বাদশাহ তেলে বেগুণে জ্বলে উঠলেন। খুব রাগান্বিত স্বরে বাদশাহ বললেন, কি ব্যাপার, ৪০ দিন পার হয়ে গেল। প্রতিদিন ১০০ বার করে মৃত্যুর কথা স্মরণ করলাম। কই, আমার অন্তরের কিছুই তো পরিবর্তন হলো না। এখানেও বাটপারী? এই আমলে কাজ হবে না। আমল বদলাইয়া দিন।
এবার নাসির গাজী বললেন, এই আমলেই কাজ হবে। হে বাদশাহ! এর আগে আপনি আমল করেছেন ঠিক, কিন্তু এর মধ্যে ছিল না কোন এক্কিন, কোন বিশ্বাস। এজন্যই কোন ফল পাননি।
বাদশাহ বললেন, এখন কি আমল দিচ্ছেন, সেটা বলুন। এবার নাসির গাজী একটু চিন্তা করে বললেন, আরেক উপায় আছে, তা হলো- ৫ দিনের জন্য আপনার বাদশাহী আমাকে দিতে হবে।
বাদশাহ বললেন, ৫ দিনই তো? ঠিক আছে, তা-ই হবে।
তৎক্ষণাৎ বাদশাহ বাদশাহী থেকে ইস্তফা দিয়ে নাসির গাজীকে বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করে দিলেন। এখন সারা দেশের আইন-কানুন, বিচার-আচার তথা সব কিছুই নাসির গাজীর হুকুমে চলতে লাগলো। বাদশাহর কিছুই করার ক্ষমতা এখন নেই। তাই নাসির গাজী সিংহাসনে বসে সিপাহী দলকে হুকুম দিলেন যে, তোমাদের প্রাক্তন বাদশাহকে এই মুহূর্তে জেলে বন্দী কর। তাকে জানিয়ে দাও- আগামী তিনদিন পর তার ফাঁসি হবে।
এদিকে সারা দেশে ঘোষণা করে দেয়া হলো যে, দেশের যত সুন্দরী সুন্দরী নারী আছে, সবাইকে অতি তাড়াতাড়ি শাহী মহলে আসার জন্য। অনেক সুন্দরী রমনী হাজির হলো শাহী মহলে। তখন নাসির গাজী তাদেরকে আদেশ করলো যে, তোমরা জেল খানায় গিয়ে বাদশাহর সামনে সাজ-গোজ করে থাকবে। তার প্রয়োজন অনুযায়ী খেদমতও করবে। অপর দিকে বাদশাহর খাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হলো দেশের সবচেয়ে উন্নত মানের হরেক রকম খাবার।
তিনদিন পর যেদিন বাদশাহকে ফাঁসি দেয়ার কথা, সেদিন সকালে নাসির গাজী গেলেন জেলখানায়। বাদশাহর নিকট গিয়ে দেখেন-সুন্দরী মেয়েরা হুকুম মত সাজ-সজ্জা করে রয়েছে, কিন্তু বাদশাহর যেন সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। আবার তার সামনে যে হরেক রকম সুস্বাদু খাবার রাখা হয়েছে, সেগুলোর দিকেও তিনি যেন তাকাচ্ছেনই না।
একাধারে তিন দিন না খাওয়ার কারণে বাদশার শরীর যে শুকিয়ে কংকালের মত হয়ে গেছে। নাসির গাজী তখন বাদশাহকে সুধালেন- হে বাদশাহ! আপনাকে জেলখানায় (কষ্টের জায়গায়) রাখা সত্ত্বেও আপনার সামনে দেশের সুন্দরী সুন্দরী নারী রাখা হয়েছে। কিন্তু আপনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করছেন না! আপনার সামনে রাখা হরেক রকম সুস্বাদু খাবার। সেগুলোও খাচ্ছেন না! তদুত্তরে বাদ শাহ বললেন- “আমি শুধু একটা চিন্তার কারণেই খাওয়া-দাওয়া, রং-তামাশা দেখার সময় পাচ্ছি না। তাহলো-আজ দুপুরেই আমাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। আজ আমার কোন নিস্তার নেই। আজ মৃত্যু আমার অবধারিত। শুধু এই একটা চিন্তা-ই আমাকে খাওয়া-দাওয়া তথা দুনিয়াবী সমস্ত কাজ হতে বিরত করে দিয়েছে।”
তখন নাসির গাজী বললেন- হে বাদশাহ! প্রথমবার দীর্ঘ ৪০ দিন যাবত প্রতিদিন ১০০ বার মৃত্যুর কথা স্মরণ করেও আপনার শরীর এরকম হলো না। বরং পূর্বাপেক্ষা আরো বেশী মোটা তাজা হয়েছিল। পক্ষান্তরে মাত্র তিনদিন মৃত্যুর কথা চিন্তা করার কারণে আপনার শরীরের অবস্থা এরকম হলো। তার কারণটা কি? তদুত্তরে বাদশাহ বললেন, প্রথম যে মৃত্যুর কথা স্মরণ করেছিলাম, এর মধ্যে ছিল না কোন বিশ্বাস। শুধু তাছবীহ নিয়ে মৃত্যু মৃত্যু জিকির করেছিলাম মাত্র। মৃত্যুর যে আসল চিন্তা, সেটা আমার মাথায় ঢুকেনি। কিন্তু এখন মৃত্যুর বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করছি। এতে অন্তরের পরিবর্তন ঘটেছে। দুনিয়ার ফায়েদা লাভ করার মন-মানসিকতা মন থেকে উঠে গেছে। তখন নাসির গাজী বললেন- হে বাদশাহ! আপনার হাত থেকে বাদশাহীর দায়িত্ব আমার হাতে নিয়ে আপনার উপর ফাঁসির হুকুম জারী করার কারণ এটা নয় যে, আমি আপনার দেশ শাসন করে যাব। বরং একটাই কারণ- তা হলো, আপনার মনে মৃত্যুর চিন্তা ঢুকানো। অতএব, আসল মাকসুদ পূর্ণ হয়েছে। মৃত্যুর চিন্তা মানুষকে প্রাচুর্যের লোভ থেকে সরিয়ে আল্লাহর ভয় অন্তরে এনে দেয়, তা প্রমাণ হয়েছে। এখন আপনার বাদশাহী আপনি নিয়ে নিন।
নাসির গাজীর অন্যান্য গল্পসমূহ
- এক সিংহ ও পথচারীর গল্প ➜ পড়ুন
- জ্বি হুজুর! জ্বি হুজুর!! ➜ পড়ুন
- মূল্যবান সম্পদ ➜ পড়ুন
- আজ নগদ কাল বাকী ➜ পড়ুন
- মাছের মাথা-খাওয়ার লোভ ➜ পড়ুন
- ওয়াজ না করার ফন্দি ➜ পড়ুন
- একসাথে দু’জন ➜ পড়ুন
- হতবাক ইহুদি ➜ পড়ুন
- উচিত বিচার ➜ পড়ুন
- তিন টাকার সদাই ➜ পড়ুন
- বাদশাহ’র ছেলের লেখাপড়া ➜ পড়ুন
- ফুলদানির জন্য মৃত্যুদন্ড ➜ পড়ুন
- পন্ডিত খেতাবের বিড়ম্বনা ➜ পড়ুন
- সৎ লোকের সন্ধানে ➜ পড়ুন
- চৈতন্য ফিরে এল ➜ পড়ুন
- ঝাড়-ফুঁকের এ্যাকশন ➜ পড়ুন
- দিতে জানে না, নিতে জানে ➜ পড়ুন
- সম্পদের ওসীয়তনামা ➜ পড়ুন
- আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যেই করেন ➜ পড়ুন
- সব জায়গায় একই সূত্র ➜ পড়ুন
- চোর ধরার আজব বুদ্ধি ➜ পড়ুন
- দুনিয়া ধ্বংসের আগেই ধ্বংস ➜ পড়ুন
- অল্প সময়ের জন্য বিনা খরচে সুখের আস্বাদ ➜ পড়ুন
- পনের দিনের মজুরীর ভয়ে ➜ পড়ুন
- কুকুর তাড়ানো ভণ্ডপীর ➜ পড়ুন
- সব জায়গায় একই সূত্র ➜ পড়ুন
- পবিত্র কোরআনের আয়াতের ফুঁকের ক্ষমতা